সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ঘোরতর অস্বস্তিতে মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিং। মণিপুর হিংসার তদন্তে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের গঠিত তদন্ত কমিশনের হাতে একটি অডিও ক্লিপ এসেছে। যেখানে বেছে বেছে কুকি এলাকায় বোমা হামলার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। ওই অডিওর কণ্ঠস্বর মুখ্যমন্ত্রীর বলে দাবি করা হচ্ছে। দাবিটি সত্য হলে, গত বছরের ৩ মে থেকে চলা মণিপুরের গৃহযুদ্ধ সামাল দিতে সরকারের ‘ব্যর্থতার প্রমাণ’ হিসাবে গণ্য হতে পারে। এমনকী এই প্রশ্নও উঠছে, কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর নির্দেশ উপেক্ষা করেই রাজ্যে যথেচ্ছ বোমাবাজির অনুমোদন দিয়েছিলেন মেইতেই জনজাতির ‘প্রতিনিধি’ এন বীরেন সিং।
‘দ্য ওয়্যার’-এর একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৪৮ মিনিটের বিস্ফোরক অডিওটিতে মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিং যে মন্তব্য করেছেন, তাতে ওই হিংসায় তাঁর পক্ষপাতিত্বের ইঙ্গিত মিলেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে আশঙ্কায় নাম গোপন রাখার শর্তে একটি সূত্র জানিয়েছে, এই অডিওটি তদন্ত কমিশনে জমা দেওয়া হয়েছে এবং তার সঙ্গে এর সত্যতা প্রমাণ-সহ একটি হলফনামাও দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি, যাঁরা অডিওটি জমা দিয়েছেন, তাঁর কমিশনের কাছে তাঁদের নাম গোপন রাখার এবং নিরাপত্তার নিশ্চয়তাও চেয়েছেন। হলফনামায় রেকর্ডিংয়ের তারিখ এবং সময়, সেই সঙ্গে যে পরিস্থিতিতে এটি রেকর্ড করা হয়েছিল তা হলফনামায় কমিশনকে জানানো হয়েছে। তবে ‘দ্য ওয়্যার’ সেই সব বিবরণ প্রকাশ করেনি, যা থেকে সক্ষীর বা সাক্ষীদের পরিচয় প্রকাশ হয়ে যেতে পারে এবং তাঁদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হতে পারে। জানা গিয়েছে, রাজ্যে চরম বিশৃঙ্খলা চলার সময় মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের সরকারি বাসভবনে একটি বৈঠকে তিনি এই মন্তব্য করেছিলেন। ওই বৈঠকেই সাক্ষী বা সাক্ষীরা তাঁর মন্তব্যগুলি রেকর্ড করেন। যদিও, মণিপুর সরকার এই অডিও টেপকে ‘সাজানো’ বলে দাবি করেছে।
[আরও পড়ুন: অসুস্থ সীতারাম ইয়েচুরি, ভর্তি হাসপাতালে]
মণিপুরে ২০২৩-এর ৩ মে থেকে চলা মেইতেই ও কুকি-জো সম্প্রদায়ের মধ্যে জাতিদাঙ্গায় সরকারি হিসাবে ২২৬ জনের মৃত্যু হয়েছে, ৩৯ জন নিখোঁজ। দুই সম্প্রদায়ের অন্তত ৬০ হাজার মানুষে সেই সময় ঘর ছাড়া হয়েছে এবং এখনও তারা কেউ ঘরে ফিরতে পারেনি। সরকারি আশ্বাস সত্ত্বেও বিজেপি নেতৃত্বের কেন্দ্র ও রাজ্য সরকার মণিপুরে রক্তপাত বন্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ, তারা মেতেই এবং কুকি-জো সম্প্রদায়ের মধ্যে দ্বন্দ্ব মেটাতে সেভাবে কোনও উদ্যোগই নেয়নি।
অডিওতে মুখ্যমন্ত্রীর মন্তব্যগুলি সাম্প্রদায়িক বিভাজনমূলক এবং উত্তেজক, যা হিংসা বিধ্বস্ত রাজ্যে প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। এটি প্রমাণ করছে যে, প্রশাসন পক্ষপাতমূলক এবং মেতেই এবং কুকি-জোর মধ্যে বিদ্যমান মেরুকরণকে নিরাময়ের পরিবর্তে আরও তীক্ষ্ণ করার দিকেই ঝুঁকছে। অডিওতে শোনা গিয়েছে, একজন বলছেন (যা বীরেন সিংয়ের কণ্ঠ বলে দাবি করা হয়েছে), ‘অমিত শাহ যখন এখানে এসেছিলেন, আমাকে বলেন, আরে তুমি বোমা মারছ নাকি? মানে, সেদিন থেকেই তিনি (আমাকে) বোমা ব্যবহার বন্ধ করার নির্দেশ দেন। তিনি ডিজিপি এবং আমাদের সকলকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। তিনি (শাহ) চলে যাওয়ার পর আমি বলেছিলাম, হোই! চুপকে সে করনা হ্যায়, ওপেন নাহি করনা হ্যায় (এটি গোপনে করা উচিত, প্রকাশ্যে নয়।) আপনি যদি বিশ্বাস না করেন তবে ফ্রন্টলাইনে কমান্ডোদের জিজ্ঞাসা করুন।’ উল্লেখ্য, ২০ মে থেকে তিনদিনের সফরে মণিপুরে গিয়েছিলেন অমিত শাহ। এখানে শাহর সেই সফরের কথাই উল্লেখ করা হয়েছে। মণিপুরে হিংসার সময় কুকি অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে যথেচ্ছ বোমার ব্যবহার হয়েছে। পুলিশ অস্ত্রাগার থেকে অস্ত্র লুঠ করার পরেই ৫১ মিমি মর্টার বোমা ইত্যাদি ব্যবহার হয়েছে। অবশ্য, এক উচ্চপদস্থ পুলিশ আধিকারিক বলেছেন, কমান্ডোদের এমন কোনও নির্দেশ দেওয়া হয়নি।
৭ আগস্ট, কুকি স্টুডেন্টস অর্গানাইজেশন (কেএসও) একটি প্রেস বিবৃতিতে রেকর্ডিংয়ের সংক্ষিপ্ত অংশ লিখিত আকারে প্রকাশ করে। এরপর সেটি বেশ কয়েকটি সোশাল মিডিয়া হ্যান্ডল ছড়িয়ে পড়ে। এরপর রাতারাতি মণিপুর সরকার একটি বিবৃতি জারি করে দাবি করে যে, এটি মুখ্যমন্ত্রী বীরেন সিংয়ের কণ্ঠস্বর নয় এবং রেকর্ডিংটি ‘সাজানো’। সরকারি বিবৃতিতে বলা হয়, সরকারের নজরে এসেছে যে, একটি অডিও রেকর্ডিং মুখ্যমন্ত্রীর বলে মিথ্যা দাবি করে সোশাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে প্রচার করা হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক হিংসা উসকে দেওয়ার বা একাধিক স্তরে শুরু হওয়া শান্তি প্রক্রিয়াকে লাইনচ্যুত করার জন্য এই সাজানো অডিওটি নির্দিষ্ট কিছু অংশের একটি দূষিত প্রচেষ্টা।
[আরও পড়ুন: ওজন ঠিক রাখা উচিত ছিল ভিনেশেরই, ২৪ পাতার রিপোর্টে জানিয়ে দিল ক্রীড়া আদালত]
অবশ্য ‘দ্য ওয়্যার’-এর দাবি, অডিওটি মূলত মেইতেই ভাষার, তবে তাতে কিছু হিন্দিও ব্যবহার হয়েছে। রেকর্ডিংটি মেইতেই এবং কুকিদের মধ্যে জাতিগত হিংসার মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে বীরেন সিংয়ের ভূমিকা নিয়ে এই প্রশ্নই তুলেছে যে তিনি কি বিপর্যস্ত রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করার জন্য তার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করছেন নাকি তিনি তার প্রমাণপত্রগুলি পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করছেন?