shono
Advertisement

Breaking News

মণিপুরে ‘হকের লড়াই’ না সাম্প্রদায়িকতার বিষ?

এখনও পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন পঞ্চাশ জনেরও বেশি মানুষ। জারি কারফিউ।
Posted: 04:30 PM May 08, 2023Updated: 04:34 PM May 08, 2023

মণিপুরে ট্রাইবাল বা আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই নতুন কিছু নয়। কয়েকশো বছর ধরে তা চলছে। তবে এবার তা ভিন্ন মাত্রা ধারণ করেছে। বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, মণিপুরে সংখ্যাগুরু মেতেইরা তফসিলি উপজাতির তকমা দাবি করে বারুদের স্তূপে আগুন দিয়েছে। এর ফলে, কুকি-ঝাোমি ও টাংখুল, নাগাদের মতো রাজ্যের সংখ্যালঘু আদিবাসীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেছে। কলমে মণিশংকর চৌধুরী

Advertisement

 

৫ জুলাই, ২০০৪। ইম্ফলে অসম রাইফেলসের সদর দপ্তরের সামনে ব্যানার হাতে দেখা যায় ১২ জন বিবস্ত্র মহিলাকে। সেখানে লেখা ছিল ‘রেপ আস ইন্ডিয়ান আর্মি’। বিভিন্ন জনজাতির পারস্পরিক বিরোধ দুরে ঠেলে থাংজাম মনোরমার জন্য ন্যায় ও আফস্পার বিরুদ্ধে মণিপুরের এককাট্টা প্রতিবাদ ছিল তা। কিন্তু, দু’দশকের মধ্যে এমন কী ঘটল যে পাহাড়ি রাজ্যটিতে আজ কার্যত গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি?

গত সপ্তাহ থেকেই মণিপুরে সংখ্যাগুরু মেতেই জনজাতির সঙ্গে রক্তাক্ত সংঘাত চলছে কুকি-ঝোমি ও অন্য আদিবাসীদের। এখনও পর্যন্ত প্রাণ হারিয়েছেন পঞ্চাশ জনেরও বেশি মানুষ। জারি কারফিউ। বন্ধ ইন্টারনেট। বিরোধীদের চাপ ও সমালোচনার মুখে অবশেষে মৌনব্রত ভেঙেছেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ (Amit Shah)। এই বিষয়ে তাঁর বক্তব্য, পরিস্থিতি এখন নিয়ন্ত্রণে। সাধারণ মানুষের কাছে তাঁর আহ্বান, সকলে শান্তি বজায় রাখুন। তবে ইম্ফলে মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের জন্য যে পরিস্থিতি সুখকর নয়, তা স্পষ্ট।

[আরও পড়ুন: মিথ্যে বেচার কৌশল! ক্রেমলিনে ড্রোন আক্রমণের নেপথ্য কাহিনি কী?]

মণিপুরে ট্রাইবাল বা আদিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে লড়াই নতুন কিছু নয়। কয়েকশো বছর ধরে তা চলছে। তবে এবার তা ভিন্ন মাত্রা ধারণ করেছে। বিশ্লেষকদের অনেকেই বলছেন, মণিপুরে সংখ্যাগুরু মেতেইরা তফসিলি উপজাতির তকমা দাবি করে বারুদের স্তূপে আগুন দিয়েছে।গত এপ্রিল মাসে রাজ্য সরকারকে মেতেইদের দাবি খতিয়ে দেখার নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট।  এর ফলে, কুকি-ঝাোমি ও টাংখুল নাগাদের মতো রাজ্যের সংখ্যালঘু আদিবাসীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতে শুরু করেছে। কারণ, সংখ্যাগুরুর বিরুদ্ধে ‘শিডিউল ট্রাইব স্ট্যাটাস’ই তাদের রক্ষাকবচ। সেটা না থাকলে পাহাড় ও উপজাতিদের জন্য সংরক্ষিত অন্যান্য এলাকায় অবাঞ্ছিত প্রবেশ ঘটবে মেতেইদের। সংখ্যাগুরুর ভৌগলিক ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে অস্তিত্ব লোপ পাবে সংখ্যালঘুর। সেই ভয় অযৌক্তিকও নয়। গত মার্চ মাসে একতরফা ভাবে সশস্ত্র কুকি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট (UPA) ও কুকি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন (KNO)-এর বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে বীরেন সিংয়ের বিজেপি সরকার। তারপর, সম্প্রতি ইম্ফল ইস্ট জেলার সরকারি জমিতে ‘বিনা অনুমতিতে’ তৈরি তিনটি গির্জা গুঁড়িয়ে দেয় প্রশাসন। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে ১৯৭৪ সাল থেকেই নাকি ওই গির্জাগুলি রয়েছে! তাই আচমকা এই অভিযানে খ্রীস্ট ধর্মাবলম্বী কুকিদের মধ্যে ক্ষোভ বেড়েছে। বিশেষ করে চূড়াচাঁদপুর ও টেংনোপল জেলায় বীরেন সিং সরকারের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ চলছে।

তাই রাজ্য ও কেন্দ্রকে প্রতিবাদী বার্তা দিতেই ৩ মে ‘ট্রাইবাল সলিডারিটি মার্চ’ শুরু করে ‘অল ট্রাইবাল স্টুডেন্টস ইউনিয়ন অফ মণিপুর’। মেতেইদের তফসিলি উপজাতির তকমা না দেওয়ার দাবিতেই ছিল এই মিছিল। ক্রমেই তা হিংসাত্মক আকার ধারণ করে। মেতেই সংখ্যাগুরু ইম্ফল উপত্যকায় বেশকিছু বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়। আর এর প্রতিক্রিয়াও হয় প্রায় সঙ্গে সঙ্গে। গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে হিংসা।

বিশ্লেষকদের একাংশের মতে, ‘হকের লড়াই’ লড়ছে মেতেইরা। রাজ্যের মোট জনসংখ্যার ৫০ শতাংশের বেশি হলেও তারা ক্রমে আগ্রাসনের শিকার হয়ে আসছে। পাহাড়ে বা মূলত কুকি-ঝাওদের এলাকায় মেতেইরা জমি কিনতে পারে না। অথচ, উপত্যকায় বা মেতেইদের জায়গায় জমি কেনার অধিকার রয়েছে কুকিদের। বিগত দিনে, মায়ানমার থেকে আসা অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় দিয়ে পাহাড়ে নিজেদের জনসংখ্যা বাড়াতে তৎপর হয়েছে কুকি-ঝোমি ও নাগারা। উল্লেখ্য, মণিপুরে ভারত-মায়ানমার সীমান্তের দু’ পাশই কুকি-ঝোমি ও নাগাদের বসতি রয়েছে। এদের অনেকেই আবার আত্মীয়। তাছাড়া, পাহাড়ে ‘ড্রাগ কার্টেল’ বা মাদক চক্রের রমরমা বাড়ছে। এবং পাহাড় থেকে মেতেইদের উচ্ছেদ করা হচ্ছে। কুকি সন্ত্রাসবাদীদের নিশানায় রয়েছে মূলত বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী মেতেইরা।

লক্ষণীয় ভাবে, ২০১৬ সাল থেকেই কুকি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে আলোচনায় আগ্রহ দেখিয়েছে কেন্দ্রের মোদি সরকার। ফলে দিল্লি দরবার থেকে শান্তিচুক্তির পাশাপাশি অসমের বড়োদের মতোই স্বায়ত্বশাসনের উপহার মেলার আশাও করছিল কুকি-ঝোমিরা। কিন্তু বীরেন সিংয়ের রাজ্য সরকার কুকি বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে অভিযান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে সেই আশায় জল ঢেলে দিয়েছেন। উল্লেখ্য, মুখ্যমন্ত্রী নিজেও মেতেই।খুব স্বাভাবিক ভাবেই, রাজ্যের সংখ্যাগুরু হিন্দু ধর্মাবলম্বী মেতেইদের মন পেতেই মুখ্যমন্ত্রীর এই পদক্ষেপ। তাছাড়া, বিগত দিনে মেতেইদের মধ্যে হিন্দুত্ববাদীদের গতিবিধি বেড়েছে। কয়েক দশক পুরনো চার্চকে এখন নিশানা করাও এই ঘটনাবলীর নেপথ্যে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত থাকার সম্ভাবনা যথেষ্ট রয়েছে। সবমিলিয়ে, মণিপুরে ‘হকের লড়াই’ চলছে না রাজ্যটিকে গ্রাস করেছে সাম্প্রদায়িকতার বিষ. সেই প্রশ্নের উত্তর সময়ই দেবে।

[আরও পড়ুন: ডাবল ইঞ্জিনের দাক্ষিণাত্য! কর্ণাটকে শেষ হাসি হাসবে কে?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement