shono
Advertisement

পশ্চিমবঙ্গে কি ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করবে কেন্দ্রীয় সরকার?

তা হলে রাজ্যের দশ কোটি মানুষ যে রায় দিলেন, তার কী হবে?
Posted: 04:03 PM Jun 16, 2021Updated: 04:49 PM Jun 16, 2021

সংবিধানে ৩৫৬ ধারা একটি অতীব জরুরি পদক্ষেপ হলেও কালক্রমে এটি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক হাতিয়ার। ১৯৮৪ সালে চারশোর বেশি আসন নিয়ে দিল্লিতে ক্ষমতায় আসার পর এই ধারার ভয়ংকর অপব্যবহার করে প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সরকার। লিখছেন কিংশুক প্রামাণিক

Advertisement

 

কালান্তক করোনা আর রাজনীতির সীমাহীন অস্থিরতার মধ্যে আচমকা টিভির পর্দায় মেসি-রোনাল্ডোদের উদ্ভাসিত দেখে মনে হল- যাক বাবা, ক’টা দিন তবু শান্তি। একটু ফুটবল নিয়ে মেতে থাকা যাবে। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা, জার্মানি-ইংল্যান্ড নিয়ে ঝগড়াঝাঁটি করে মাসখানেক কাটবে।

শুরু হয়ে গিয়েছে ইউরো কাপ ও কোপা আমেরিকা। পৃথিবীর দুই প্রান্তে দুই বিশ্বযুদ্ধ। হাজার হাজার মাইল দূরের সেই মহাযজ্ঞে ভারত নেই তো কী, ফুটবল তো আছে। তাই যে-যার মতো করে মোহনবাগান, ইস্টবেঙ্গলের ‘বিকল্প’ খুঁজে নেওয়া। রাত জেগে বিদেশি পতাকা হাতে নিয়ে এমন আহ্লাদ করতে হবে, যেন মেসি আপন মায়ের পেটের ভাই, রোনাল্ডো-নেইমারের সঙ্গে সম্পর্ক চিরদিনের। তবু স্বস্তি কোথায়! ভোট মিটল তো দলবদল শুরু হল। যাঁরা ‘দমবন্ধ’ হওয়ার অজুহাতে মাস তিনেক আগে চলে গেলেন, তাঁরাই ফিরে আসতে চান পুরনো দলে। এবার তাঁদের শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ওদিকে। এ তো মামাবাড়ির আবদার!

[আরও পড়ুন: মোদি-যোগী দ্বৈরথের ভবিষ্যৎ কী?]

শাসক দল এখনও পুরো দরজা খোলেনি। বিশাল ফটকটা একটু ফাঁক করে মুকুল রায়ের মতো হেভিওয়েটকে নিয়েছে যেই, অমনি টিকা নেওয়ার মতো লম্বা লাইন। সবাই আবার তৃণমূল (Trinamool Congress) হতে চান। গ্রামাঞ্চল অবশ্য কলকাতার দিকে তাকিয়ে নেই। মাইকে প্রচার করে গেরুয়া শিবির ছাড়ছেন দলত্যাগীরা। এর মধ্যে বিরোধী দলনেতার সভায় ২৪ বিধায়কের অনুপস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে, গেরুয়া শিবিরে চোরাস্রোত বইছে। গঙ্গার ভাঙনের মতো এই ভাঙন কতদূর যাবে, কী পরিস্থিতি দাঁড়াবে তা দেখতে আরও খানিকটা অপেক্ষা করতে হবে।

এ তো গেল দলবদলুদের কথা। যাঁরা ভেবেই ফেলেছিলেন মন্ত্রী হবেন, জিতে গিয়ে তৃণমূলকে দেখে নেবেন, তাঁরা এখন ক্ষমতা না পেয়ে দিশেহারা। এঁরা তৃণমূলে যেতে চান না। বরং চান, ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করে সদ্য-নির্বাচিত সরকারকে ফেলে দিক কেন্দ্রীয় সরকার। এ কি ছেলের হাতের মোয়া! এত বড় রায়ের পর ১০০ দিন কাটল না, ৩৫৬-র দাবি? তাহলে রাজ্যের দশ কোটি মানুষ যে রায় দিলেন, তার কী হবে? প্রবল সংক্রমণের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাঁরা লাইনে দাঁড়িয়ে ভোট দিলেন, তাঁদের অংশগ্রহণ কি তাহলে মূল্যহীন?

মনে হচ্ছে না মানুষের রায় থেকে প্রধান বিরোধী দল কোনও শিক্ষা নিয়েছে। যেনতেন প্রকারেণ ক্ষমতা পেতেই হবে তাদের। এই প্রবণতা মানুষের কাছ থেকে তাদের আরও দূরে ঠেলে দিতে পারে। ক্ষমতার জন্য মানুষের রায়কে পদানত না করে বিরোধী দলের উচিত ‘চিন্তন বৈঠক’ করা। কী করে মানুষের মনে ফিরে আসা যায়, সেই অঙ্ক কষা। কেন দশ বছর পরও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে (Mamata Banerjee) মানুষ ৪৮ শতাংশ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনল, তার মূল্যায়ন করা।

এবার নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা প্রবলভাবে সমালোচিত হয়েছে। তাদের অনেক সিদ্ধান্ত দেখে মনে হয়নি, নিরপেক্ষতার উপর দাঁড়িয়ে তাঁরা চলছেন। তবু এটা মানতেই হবে, এবার কয়েকটি ক্ষেত্র ছাড়া প্রায় সর্বত্র নিজের ভোট নিজে দিয়েছেন মানুষ। এমনভাবে রাজ্য পুলিশকে সরিয়ে কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ভোট হয়েছে, তার সঙ্গে রাষ্ট্রপতি শাসনের ভোটের কোনও ফারাক নেই। বিজেপির একটা সময় দাবি ছিল, রাষ্ট্রপতি শাসনে ভোট করার। তৃণমূল শহিদ হয়ে যাবে, সেই আশঙ্কায় তারা পিছিয়ে যায়। কিন্তু যে-কায়দায় ভোট হল, তাতে রাজ্যের শাসক দল ছিল অসহায়। এরপরও ৩৮ শতাংশের বেশি এগতে পারেনি বিজেপি। অর্থাৎ, রাজ্যের ৬২ শতাংশ মানুষ চাননি, বাংলায় কোনও ‘ডাবল ইঞ্জিন’ সরকার আসুক।

এই ফল বাস্তব। মেনে নিতে অসুবিধা কোথায়? লোকসভা ভোটে বিজেপিকে ৪০ শতাংশ ভোট ও ১৮টি আসন মানুষ দিয়েছিল। এই ভোটে মানুষ মনে করেছে, তৃণমূল থাক, বিজেপিকে দরকার নেই। মানুষের এই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত আগে মূল্যায়ন করুক বিজেপি নেতৃত্ব। তারা খুব মন দিয়ে ভোটটা করেছিল। কোনও কিছুর অভাব ছিল না। তবু মানুষ কেন নিল না? কোন স্লোগানে ভুল ছিল, কোন ইস্যুর কাউন্টার করতে পারেননি, তা নিয়ে বিস্তারিত আলাপ-আলোচনা যখন করা উচিত, তখন তারা পিছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতা পাওয়ার কথা বলছে। যা এককথায় অসম্ভব। কাশ্মীর-মণিপুর-ত্রিপুরা নয় বাংলা, যে সরকার ফেলে দেওয়া যাবে। তা-ও আবার দুই-তৃতীয়াংশ গরিষ্ঠতা নিয়ে আসা সদ্য-নির্বাচিত সরকার।

জোয়ারে অনেক কিছুই ভেসে আসে। আবার ভাটায় চলে যায়। যে-অংশ মজবুত, তা রয়ে যায়। গণতন্ত্রেও শেষকথা বলে মানুষ, আয়ারাম-গয়ারাম নয়। বিজেপির উচিত, মানুষের রায় মেনে নিয়ে যেটুকু শক্তি মানুষ তাদের দিয়েছে- তাই নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করা। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ৭৪ জন (তিনজন কমে) বিধায়ক কম নয়। সংবিধানে ৩৫৬ ধারা একটি অতীব জরুরি পদক্ষেপ হলেও কালক্রমে এটি হয়ে ওঠে রাজনৈতিক হাতিয়ার। ১৯৮৪ সালে চারশোর বেশি আসন নিয়ে দিল্লিতে ক্ষমতায় আসার পর এই ধারার ভয়ংকর অপব্যবহার করে প্রয়াত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সরকার। কংগ্রেসকে ক্ষমতায় বসানোর জন্য একের পর এক রাজ্যে সরকার ফেলে দেওয়া হয়েছিল। যদিও তা বুমেরাং হয়। ১৯৮৯ সালে এর মূল্য দিতে হয় কংগ্রেসকে। পর্যুদস্ত হন রাজীব গান্ধী।

বিজেপি সে-ই ইতিহাস নিশ্চয় জানে। তাই সংসদে সাড়ে তিনশো আসন থাকলেও তারা কংগ্রেসের মতো ৩৫৬-র অপব্যবহারে যায়নি। বরং বিভিন্ন রাজ্যে হেরে গিয়েও তারা সরকার গড়েছে বিরোধী দল ভাঙিয়ে। সেক্ষেত্রে তাদের দাবার ঘোড়া হয়েছেন রাজ্যপাল।
বাংলায়ও একই কারণে রাজ্যপাল সক্রিয়। কিন্তু এখানকার পরিস্থিতি সেরকম নয়। মমতা ২১৩ আসন পেয়ে বসে আছেন। তদুপরি ৩৫৬ প্রয়োগের মতো ভুল নরেন্দ্র মোদি (Narendra Modi), অমিত শাহ করবেন বলে তো মনে হয় না।

ভোটের ফল বেরনোর পর রাজনৈতিক হিংসা হয়েছে। মৃত্যু, ঘরছাড়া হওয়ার ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু বিজেপি নেতাদেরও বোঝা উচিত, যেভাবে ‘২ মের পর দেখে নেওয়া’-র হুমকি তাঁরা দিয়েছিলেন, তার জন্য বিপরীত প্রতিক্রিয়া বেশি হয়েছে। হাওয়া তাঁরা-ই গরম করেছিলেন।
তৃতীয়বার তৃণমূল সরকার আসার পর রাজ্যে এত বড় কোনও ঘটনা ঘটেনি যে, সদ্য-নির্বাচিত একটি সরকারকে ফেলে দিতে হবে। ২১ জুলাইয়ের গুলিচালনা থেকে নন্দীগ্রাম কাণ্ড, ভয়ংকর অধ্যায়- বাংলায় অনেকবারই ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের দাবি জানিয়েছেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেই দাবি পূরণ হবে না- তা মমতাও জানতেন। কিন্তু তিনি লড়াইটা জারি রাখতেন। বিজেপি কি সেই পন্থা নিতে ৩৫৬-র কথা বলছে? হতে পারে। কিন্তু সত্যিকথা বলতে কী, এখন এসব করার সময় নয়।

কখনও কখনও গণতান্ত্রিক কারণে ৩৫৬ ধারা প্রয়োগের প্রয়োজনীয়তা আসে। যখন রাজ্যের আইনসভায় অচলাবস্থা হয়, তখন রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করা ছাড়া কোনও উপায় থাকে না। বাংলায় এইভাবেই ১৯৬৬ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার আসা থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত চারবার সরকার বদল হয়। কোনও দল একক গরিষ্ঠ না হওয়ার জন্য চারবার সেই সরকার পড়ে যায়। প্রতিবারই পরের ভোট না-হওয়া পর্যন্ত রাষ্ট্রপতি শাসন জারি করতে হয়। তারপর ১৯৭২-’৭৭ কংগ্রেস, ১৯৭৭-২০১১ বামফ্রন্ট ও ২০১১ থেকে আজ অবধি তৃণমূল সরকার চলছে। সবক’টি সরকারের নিরঙ্কুশ গরিষ্ঠতা ছিল বা রয়েছে। বামফ্রন্ট সরকারের ৩৪ বছরের শাসনে বারবার রাষ্ট্রপতি শাসনের দাবি উঠেছে। মমতার সময়ও উঠছে। এটা গণতান্ত্রিক দাবি। এর বেশি কিছু না হওয়াই বাঞ্ছনীয়।

যতদূর মনে হয়, দলের ভাঙন নিয়ে বিজেপি খুবই চিন্তিত। তারা ভাবছে গোটা দলটা তৃণমূল গ্রাস করবে। তাই হয়তো এই দাবি তুলছে। কিন্তু আবার তাদের বোঝা উচিত, শেষ বিচার করে মানুষ। নেতা নন। মানুষই ভোট দেয়, তাদের ভোটে ইতিহাস রচনা হয়। একুশের ভোটে নিজের মেয়েকে ফিরিয়ে প্রয়াত জ্যোতি বসুর সেই মহান বাণীটিকে আবার সত্য প্রমাণ করছে বাংলার জনতা। কঠিন বাস্তব মেনে নিয়ে বিরোধী দলের কাজ শুরু করুক বিজেপি নেতৃত্ব। গণতন্ত্রে বিরোধীদের ভূমিকার দিকেই বেশি নজর দেয় মানুষ।

[আরও পড়ুন: ছুঁয়েছিলেন সমুদ্রের রহস্যকে! টাইটানিক ডুববে, জানতেন তিনি?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement