সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: ‘স্বচ্ছ্ব’ করার নামে কেন্দ্রের হাজারো বিধিনিষেধ, কেন্দ্রীয় নজরদারি, শ্রমিকদের মজুরির টাকা আটকে রাখা ইত্যাদি কারণে গ্রামীণ অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অবলম্বন ‘১০০ দিনের কাজ’ প্রকল্প ক্রমেই তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। কেন্দ্রীয় সরকারি তথ্যই বলছে, মহাত্মা গান্ধী ন্যাশনাল এমপ্লয়মেন্ট গ্যারান্টি স্কিমের (১০০ দিনের কাজ) অধীনে পরিবারপিছু কর্মসংস্থানের গড় দিন চলতি আর্থিক বছরে পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্নে নেমে এসেছে।
২০ জানুয়ারি পর্যন্ত হিসাবে পরিবারপিছু গড়ে মাত্র ৪২ দিন কাজ দেওয়া গিয়েছে। ২০২১-’২২ সালে ৫০ দিন, ২০২০-’২১ সালে ৫২ দিন, ২০১৯-’২০ সালে ৪৮ দিন এবং ২০১৮-’১৯ সালে ৫১ দিন ছিল। ২০০৫ সালে দেশের গ্রামাঞ্চলে প্রাপ্তবয়স্ক অদক্ষ কর্মীদের প্রতি আর্থিক বছরে অন্তত ১০০ দিন কাজের নিশ্চয়তা দিতে এই প্রকল্প চালু হয়েছিল। পরবর্তীকালে গ্রামাঞ্চলের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে ‘১০০ দিনের কাজ’ প্রকল্প। তবে, বর্তমান আর্থিক বছরে কাজের দিন কমায় বিভিন্ন মহলে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে। যদিও, কাজের দিন কমা নিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলে কেন্দ্রের আধিকারিকরা দাবি করেছেন, দু’টি করোনা অতিমারীর বছরে ১০০ দিনের কাজের চাহিদা বৃদ্ধি পেয়েছিল। সেই সময় ভিনরাজ্যে কাজ হারিয়ে গ্রামাঞ্চলের বাড়িতে ফিরে আসা বহু মানুষ ১০০ দিনের কাজে যোগ দিয়েছিলেন। সেই নিরিখে বর্তমান আর্থিক বছরে কাজের চাহিদা কমেছে।
একটি সর্বভারতীয় ইংরাজি সংবাদপত্রের প্রতিবেদন অনুসারে, ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত পাওয়া সরকারি পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশের ৯টি রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বেঁধে দেওয়া লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম শ্রমদিবস ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলি হল অরুণাচল প্রদেশ (৬৩.৯২ শতাংশ), ছত্তিশগড় (৬১.৬০ শতাংশ), গোয়া (১৮.০৩ শতাংশ), হরিয়ানা (৫৯.৯০ শতাংশ), মণিপুর (১৪.৫২ শতাংশ), মেঘালয় (৫৫.৬৫ শতাংশ), আন্দামান ও নিকোবর (২৬.৮৪ শতাংশ), দমন ও দিউ (০ শতাংশ) এবং লাক্ষাদ্বীপ (৩৩.৬৩ শতাংশ)। চলতি আর্থিক বছর শেষ হতে আর মাত্র দু’মাসেরও কম সময় রয়েছে। এর মধ্যে এই সব রাজ্য ও কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল লক্ষ্যমাত্রা যে পূরণ করতে পারবে না, তা স্পষ্ট।
[আরও পড়ুন: ‘সাংকেতিক চিহ্নে’ ভরা ধৃত তৃণমূল যুব নেতা কুন্তলের ডায়েরি, ডিকোডের চেষ্টায় ইডি]
কেন্দ্রের গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের এক আধিকারিক বলেন, কেন্দ্রের বরাদ্দ করা শ্রমদিবস ব্যবহার করতে না পারাটা রাজ্যের ব্যর্থতা। যেমন, দমন ও দিউকে ১ লক্ষ শ্রমদিবস বরাদ্দ করা হয়েছিল, তারা সেটাও পূর্ণ করতে পারেনি। অন্যদিকে, মণিপুরকে বরাদ্দ করা হয়েছিল ২.৫ কোটি শ্রমদিবস তৈরি করতে বলা হয়েছিল। তারা মাত্র ১৪.৫২ শতাংশ লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পেরেছে। ওই আধিকারিক বলেন, “আমাদের হাতে আসা পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে এই আর্থিক বছরে কয়েকটি রাজ্যের কাজ বিশেষভাবে খারাপ হয়েছে। সেটা আর্থিক অব্যবস্থাপনার কারণে। শ্রমিকদের মজুরি পেতে ৩-৪ মাসও দেরি হয়।” তেমনই ছত্তিশগড় এবং মেঘালয়ের কাজও বিশেষভাবে উদ্বেগজনক, কারণ দু’টি রাজ্যের আগের বছরগুলিতে একটি শক্তিশালী রেকর্ড ছিল।
কেন্দ্র কাজের চাহিদা কমার বা পরোক্ষে রাজ্যগুলির উপর দায় চাপালেও শিক্ষাবিদ ও সমাজকর্মীরা তা মানতে নারাজ। আজিম প্রেমজি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রাজেন্দ্র নারায়ণ বলেন, প্রকল্পটি পদ্ধতিগত সমস্যা দ্বারা জর্জরিত হয়েছে। যে কারণে গ্রামাঞ্চলের মানুষ প্রকল্পটি সম্পর্কে উৎসাহ হারিয়েছে। বস্তুত, ‘দুর্নীতি-মুক্ত’ করার নামে কেন্দ্র সরকার ১০০ দিনের কাজ প্রকল্পে একাধিক বিধিনিষেধ, নজরদারি শুরু করেছে। অনেকক্ষেত্রে প্রকল্পে রাজ্যগুলির প্রাপ্য টাকা আটকে রাখা হচ্ছে। এই সব কারণে প্রকল্পটি গতি হারাচ্ছে এবং তাতে গ্রামীণ অর্থনীতির ক্ষতি হচ্ছে। অধ্যাপক নারায়ণ বলেন, প্রকল্পের তহবিল আটকে রাখায় কাজের মজুরি প্রদানে যে বিলম্ব হচ্ছে, তার কারণেই মূলত ১০০ দিনের কাজে উৎসাহ হারাচ্ছে গ্রামাঞ্চল। কর্মক্ষেত্রে উপস্থিতির জন্য একটি অ্যাপের মতো অপ্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত জটিলতার প্রবর্তন শ্রমিকদের জন্য আরও বেশি কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।”
মনে করা হচ্ছে, আগামী বছরগুলিতে ১০০ দিনের কাজের সুযোগ আরও সঙ্কুচিত হবে। এর অন্যতম আরেকটি বড় কারণ হল বাজেট বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া। অভিযোগ, প্রকল্পের জন্য রাজ্যগুলি যে শ্রম-বাজেট কেন্দ্রের কাছে পাঠায় কেন্দ্রের তরফে তা ব্যাখ্যা না দিয়েই কাটছাঁট করা হয়ে থাকে। অধ্যাপক নারায়ণ বলেন, প্রকল্প কার্যকরভাবে চালানোর জন্য এবং শ্রমিকরা তাঁদের আইনি বকেয়া পাওয়ার জন্য ন্যূনতম ২ লক্ষ কোটি টাকা বরাদ্দ হওয়া উচিত।