অরিঞ্জয় বোস: সে বহুকাল আগের কথা। নয়ের দশকের শেষের দিক। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পেরিয়ে দেশ তখন এক বাঁকবদলের মুখে দাঁড়িয়ে। সামনে এক অচেনা শতাব্দী। নতুন দশক। অগণন মানুষের ভিড়ে সভ্যতার নতুন সোপান রচনা চলছে। নতুন চাহিদা, ভিন্নতর ভাবনা জমা হচ্ছে ভারতীয় উপমহাদেশের আকাশে বাতাসে। দেশের রাজনীতি তখন টালমাহাল। নয়ের দশকের শুরুতে ঘটে যাওয়া রাজীব-হত্যার অভিঘাত তখনও কাটেনি। মুছে যায়নি বাবরি-পর্ব থেকে মুম্বই নাশকতার জেহাদি চিহ্ন। তবু সেই সন্তপ্ত-দাগ বুকে নিয়ে দিল্লি দরবারে শতরঞ্চের ঘুঁটি বদল চলছে। যেন এক মাৎস্যন্যায়। আজ যে রাজা, কাল সে ফকির। স্থায়ী সরকারের পলেস্তরা খসে গিয়ে যত মাথাচাড়া দিচ্ছে আঞ্চলিক স্বার্থ, তত খানখান হয়ে যাচ্ছে ভারতের ঐক্যতান। সেই ঘোলাটে সময়ে ছায়া দীর্ঘ হচ্ছে অটলবিহারী বাজপেয়ী নামক এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের। তাঁর পরবর্তী ইতিহাস সময়ের পাতায় লিপিবদ্ধ।
দেশের প্রাণকেন্দ্রে যখন এমন টালমাহাল পরিস্থিতি, কেমন কাটছে তখন কলকাতার দিনযাপন? সময়ের অভিঘাত দমকা হাওয়ার মতো কি ধাক্কা দিচ্ছে না তিলোত্তমার হৃদয়ে? দিচ্ছে তো। কিন্তু তা বিষাদের নয়, অনিশ্চয়তার নয়, বরং তা আনন্দের, হর্ষ-উল্লাসের। ফুটবলের মক্কা হিসেবে ততদিনে বিশ্বমাঝারে নিজের পরিচিতি গড়ে তুলেছে এই শহর। ময়দানের সবুজ ঘাসে জমে থাকা ইতিহাস ফিসফিসিয়ে গল্প বলে সেই গৌরবের। সেই নরম ঘাসে কান পাতলে একটা নামই প্রতিধ্বনিত হয়– ‘মোহনবাগান... মোহনবাগান...’।
[আরও পড়ুন: ‘আমার কেরিয়ারে মোহনবাগানই সেরা দল’, খেতাব জিততে নিজেকে উজাড় করে দেবেন পেত্রাতোস]
হবে নাই বা কেন! বাংলা ফুটবলের বিজয়কেতন তো পালতোলা নৌকার মাস্তুলে বাঁধা। ২২ মার্চ, ১৯৯৮। জাতীয় লিগ জয় মোহনবাগানের, বাংলার প্রথম দল হিসেবে। অবিন্যস্ত যুবভারতীতে সেদিন সত্তর হাজারের জনস্রোত অন্য আবহ নির্মাণ করে। তারপর গঙ্গা দিয়ে বয়ে গিয়েছে আরও জল। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সাফল্যের শিখর স্পর্শ করেছে সবুজ-মেরুন। আবেগে স্নাত হয়েছে মোহনবাগান সমর্থকরা। সে এক সোনালি অতীত। ইতিহাসের ভূর্জপত্রে তা অমলিন। যার কেবল উদযাপন চলে। আর চলে বলেই আজও ময়দানের নরম ঘাসে কান পাতলে একটা নাম দৈববাণীর মতো শোনা যায় অন্তরে, ‘মোহনবাগান... মোহনবাগান...’।
ইতিহাসকে, সাফল্যের উষ্ণতাকে সবসময় দু’হাতে আগলে রেখেছে মোহনবাগান, সমর্থকদের আবেগকে শিরোধার্য করে। ফেলে আসা দশকের মতোই মেরিনার্সের বিজয়গাথা নিশান মেলেছে এই শতকেও। ২০১৫-র ৩১ মে। বেঙ্গালুরুর কান্তিরাভায় সেদিন সাফল্যের নতুন সূর্যের উদয় দেখেছিল সবুজ-মেরুন জনতা। সুনীল ছেত্রীদের বেঙ্গালুরু এফসি-র স্বপ্ন ভেঙে আই লিগ জয় করে ছিল মোহনবাগান। যে ফুটবলটা খেলেছিল, তা আজও ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাসে প্রত্যাবর্তনের অন্যতম সেরা দৃষ্টান্ত রূপে পরিগণিত। ফুটবল বিধাতা সেদিনও বাংলা ফুটবলের সাফল্য-বাহক হিসেবে, ঋত্বিকরূপে বেছে নিয়েছিল মোহনবাগানকেই। বোঝা গিয়েছিল, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের চিন্তাধারা পাল্টায়, বদলায় দুনিয়া। বদলায় না কেবল সবুজ-মেরুন সমর্থকের প্রাণের আবেগ আর ভালোবাসার রং। হৃদয়ে কান পাতলে প্রতিধ্বনিত হয় সেই নাম– ‘মোহনবাগান... মোহনবাগান...’।
শতাব্দীপ্রাচীন মোহনবাগানে সাফল্যের স্মারক শতাধিক। গৌরবগাথাও ততগুণ। কিন্তু একুশ শতকে মোহনবাগানের প্রথম আই লিগ জয় বুঝিয়ে গিয়েছিল নিভু নিভু আই লিগে এখন আশার সন্ধ্যাপ্রদীপ হয়ে জ্বলছে মোহনবাগান, আর কেউ নয়। পেশাদারিত্বের সোনালি মোড়কে চোখ জ্বলসে দেওয়া বেঙ্গালুরুর স্বপ্ন ছিনিয়ে আই লিগ জেতাটা কোনও কাকতালীয় ঘটনা ছিল না সবুজ-মেরুন যোদ্ধাদের, পরের বছর ফেডারেশন কাপ জিতে তা প্রমাণ করে দিয়েছিল মোহনবাগান। গুয়াহাটির আকাশে সেদিন ডানা মেলেছিল সবুজ-মেরুন আবির। সাফল্যের গর্ভগৃহে নতুন করে খোদাই হয়েছিল মোহনবাগানের নামটা। ভারতীয় ফুটবলের অন্তরাত্মা টের পেয়েছিল, মোহনবাগান নামটার গভীরতা কতটা অতলান্ত। যেমনটা অনুভূত হয়েছিল ২০২০-তে, মোহনবাগানের দ্বিতীয় আই লিগ জয়ে।
করোনা নামক মহামারি তখন তার করালগ্রাস বিছিয়ে দেয়নি এই মহাবিশ্বে। বাংলার বুকে তখন দামাল ঘোড়ার মতো ছুটছে মোহনবাগান। পাসের ফুলঝুরি, জোসেবা বেইতিয়া-ফ্রান গঞ্জালেসদের প্রাণবন্ত ফুটবলে তখন গ্যালারি জুড়ে সবুজ-মেরুন হিল্লোল। কল্যাণী কল্যাণময়। রাজ্যের শিল্পনগরী কখনও পুরো দস্তুর মোহনবাগান ডেরা। সেই শহরতলির প্রাণকেন্দ্রে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ শুনেছিল ভারতীয় ফুটবল। এক ম্যাচ বাকি থাকতে ছিনিয়ে নিয়েছিল আই লিগ শিরোপা। দ্বিতীয়বারের জন্য। সমর্থকদের উল্লাসের প্লাবন দেখেছিল সেদিনের কল্যাণী। বাঁধ ভেঙেছিল আবেগের। ভারতীয় ফুটবলে সাফল্যের দ্যোতক হিসেবে প্রাণপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল মোহনবাগান। যদিও খেলা হয়নি লিগের শেষ ম্যাচ, কোভিডের রক্তচক্ষুতে। বলা ভালো, সেই প্রয়োজনটুকুই রাখেনি মোহনবাগান।
সাফল্যের এই রাজপথ ধরেই আইএসএলে এগিয়েছে পালতোলো নৌকা। কোভিডের জেরে দীর্ঘসময় দল এবং সমর্থকের দ্বৈত উপস্থিতি ব্যাহত হয়েছে স্টেডিয়ামে। কিন্তু আবেগের স্পন্দন থেমে যায়নি। সেই ফল্গুস্রোতকে বুঝতে সমস্যা হয়নি জনি কাউকো, দিমিত্রি পেত্রাতোসদের। যার নিটফল ২০২৩-এর আইএসএল শিরোপা জয়। অনেক চড়াইউতরাই পেরিয়ে সাফল্যের সেই সিংহদুয়ার স্পর্শ করেছিল সবুজ-মেরুন। গোয়ায় গ্যালারি হয়ে উঠেছিল সবুজ-মেরুন আবিরে অনাবিল। তবে বাকি ছিল আরও কিছু। চলতি বছর ২০২৪, মোহনবাগান দল হিসেবে নিজেদের সেই উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছে, যেখানে নোঙর বাঁধতে পারেনি ভারতীয় ফুটবলের অন্য কোনও টিম। এই অনন্যতা অর্জন মোহনবাগানের জার্সির পক্ষেই সম্ভব, মোহনবাগান বলেই সম্ভব। মরশুমের শুরুতে যে তারকার সম্মিলনে চকমকি ঠুকেছিল সবুজ-মেরুন ম্যানেজমেন্ট, তাই দীপ্তিচ্ছটা মেলেছে মরশুম শেষে। ডুরান্ড কাপ দিয়ে যার শুরু, তারপর বহুআকাঙ্ক্ষার আইএসএল-শিল্ড জয়। যে গৌরবে এএফসি চ্যাম্পিয়ন্স লিগে খেলার যোগ্যতা আজ মেরিনার্সের মুঠোবন্দি।
কথায় বলে, মধুরেণ সমাপয়েৎ। ৪ মে, যুবভারতী সেই মুহূর্তের প্রতীক্ষায়। যেখানে আরও একবার আইএসএল খেতাব জয়ের লক্ষ্যে নামবে মোহনবাগান। মরশুমে ত্রিমুকুট জয়ের লক্ষ্য নিয়ে। ট্রফি আর মোহনবাগানের মধ্যে বাধা বলতে মুম্বই সিটি এফসি। সেই মুম্বই, যারা অতীতে সাফল্যের গ্রাস কেড়েছে সবুজ-মেরুন জনতার হৃদয়স্তব্ধ করে। কিন্তু ইতিহাসের পালা বদলে দেওয়াটাই মোহনবাগানের স্বধর্ম। সেই আত্মাভিমান নিয়েই তো ব্রিটিশ রাজের বিরুদ্ধে সাফল্যের নিশান মেলে ধরা। স্বাধীনতা-উত্তরকালে বিশ্বের দরবারে ভারতের পরিচিতি হয়ে ওঠা। জুয়ান ফেরান্দো হয়ে ব্যাটন এবার অ্যান্তোনিও হাবাসের হাতে। শনিবাসরীয় রাত কি দেখবে মোহনবাগানের সাফল্যের নতুন উদ্ভাস। যদি হয় সেই সোনালি রাত? তবে? তাহলে কান পেতে শুনো ওই সবুজ ঘাসে– দৈববাণীর মতো শুনতে পাবে একটাই শব্দ!
‘মোহনবাগান... মোহনবাগান...’!