দুলাল দে, দোহা: এই কিছুদিন আগেও মরক্কো মানে ছিল, অন্য কোনও ম্যাচে টিকিট না পেলে গিয়ে দেখা যাক পর্যায়ের। কিন্তু সেই মরক্কো সেমিফাইনালে উঠতেই টনক নড়ে গিয়েছে সবার। আফ্রিকার প্রথম দেশ হিসেবে কী করে সম্ভব হল এতটা উপরে উঠে আসা? যত খোঁজ নেওয়া, ততই উঠে আসছে নতুন নতুন তথ্য। অঘটন বা ফ্লুক হওয়ার কোনও সম্ভাবনাই নেই। বরং সকলের অগোচরে রীতিমতো পরিকল্পনা করেই তারা খেলতে এসেছে কাতারে। সেই কারণে, ফরাসি কোচ দিদিয়ের দেশঁও এখন সম্ভ্রম করছেন মরক্কোকে।
অঘটন এক-আধবার হয়। যেমন হয়েছিল আর্জেন্টিনার (Argentina) বিরুদ্ধে সৌদি আরবের প্রথম ম্যাচে। কিন্তু বারবার হলে সেটা অঘটন নয়। সেটা পরিকল্পনামাফিক কৌশল। মরক্কোর ম্যাচ ধরে ধরে বিশ্লেষণ করার পর ফুটবল বিশেষজ্ঞদের নোটবুকে উঠে এসেছে কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুইয়ের অসম্ভব টাইট, টেকনিক্যাল স্ট্র্যাটেজি। সেই স্ট্র্যাটেজি অনুযায়ী, প্রতিপক্ষের জন্য কোনও ফ্রি জোন বরাদ্দ নেই যে তারা বল ধরে দৌড়বে। ভাবতেও অবাক লাগে, কাতারের আগে মাত্র দু’টো ম্যাচে মরক্কোর কোচ হিসেবে ডাগআউটে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়েছিলেন ওয়ালিদ!
[আরও পড়ুন: পরিচয় লুকিয়ে হিন্দু মেয়েকে বিয়ের ছক, ধর্মান্তকরণের চেষ্টার অভিযোগে হাজতে মুসলিম যুবক]
বিশ্বকাপে (FIFA World Cup) মরক্কোর কোচের হটসিটে থাকার কথা ছিল বসনিয়ার ভাহিদ ভালিহোদজিরগের। কিন্তু কয়েকমাস আগে হঠাৎ করেই জাতীয় দলের ফুটবলারদের সঙ্গে সম্পর্ক মারাত্মক খারাপ জায়গায় চলে যায় ভাহিদের। অথচ তাঁর কোচিংয়েই কাতার বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছিল মরক্কো। তবে পরিস্থিতি এতটাই খারাপ জায়গায় চলে যায় যে, নেদারল্যান্ডসের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়েও না করে আসা চেলসির হাকিম জিয়েখ মার্চ মাসেই অবসর নিয়ে নিলেন! বিদ্রোহ করে বসেন আরও অনেকে। তাতেই মরক্কোর ফুটবল কর্তারা সিদ্ধান্ত নেন, অবিলম্বে সরাতে হবে ভাহিদকে। আগস্টে দায়িত্ব দেওয়া হল ওয়ালিদকে। তাহলে কি শুধু কোচ বদলেই কাতার বিশ্বকাপের শেষ চারে উঠে আসা? একদমই নয়। এর পিছনে রয়েছে মরক্কো ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের পরিকল্পনা।
যে দলটার বিশ্বকাপে আগে সাফল্য বলতে ছিল, একবার দ্বিতীয় রাউন্ডে পৌঁছনো। সেই দলটাই স্পেন, পর্তুগাল সবাইকে হারিয়ে একেবারে শেষ চারে! খতিয়ে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বকাপে মরক্কো দলের ২৬ জন ফুটবলারের মধ্যে ১৪ জনই খেলেন ইউরোপ নাহলে মরক্কোর (Morocco) বাইরে অন্য কোনও উন্নত লিগে। স্পেনে জন্মানো দেশের তারকা ফুটবলার আশরাফ হাকিমি খেলেন পিএসজিতে। চলতি বিশ্বকাপে এখনও পর্যন্ত ‘এক’ গোল খাওয়া গোলকিপার ইয়াসিন বোনোর জন্ম কানাডায়। এই বিশ্বকাপে মরক্কোর মাঝমাঠের স্তম্ভ সোফিয়ান আমরাবাত জন্মেছেন নেদারল্যান্ডসে। সোফিয়ান বুফাল ফ্রান্সে। হাকিম জিয়েক নেদারল্যান্ডসে।
মরক্কোর ফেডারেশনের কর্তারা এক সমীক্ষায় দেখেন, ইউরোপ জুড়ে প্রায় ৫০ লক্ষ মরক্কান বসবাস করেন। তখন একটা টেকনিক্যাল কমিটি ঠিক হয়, যারা ইউরোপের দেশগুলিতে খুঁজে খুঁজে দেখবে, কোন দেশের লিগে মরক্কোর কেউ ভাল খেলছে কি না। সেভাবেই প্রতিভার অন্বেষণ চলল। কিন্তু ভাল ফুটবলার ইউরোপের কোনও দল ছেড়ে মরক্কোর জাতীয় দলে কেন খেলবেন? তখন তাঁদের পরিজনদের দিয়ে মাতৃভূমির কথা বলে উদ্বুদ্ধ করা হয় মরক্কোর হয়ে খেলার জন্য। কারণ, এই ফুটবলাররা ইউরোপে বড় হলেও দেখা যায়, পরিবারের অনেকেই মরক্কোয় বসবাস করেন। আর তাই দ্বৈত নাগরিকত্বের সুবিধে নিয়ে ইউরোপিয়ান সার্কিটে খেলা ফুটবলাররা মরক্কোর হয়ে খেলতে রাজি হয়ে যান। বাকিটা? বাকিটা ইতিহাস।