নিরীক্ষিৎ ও অনির্বাণ চৌধুরী: ”রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা”!
শুধুই যাঁরা আজ ‘প্রাক্তন’, তাঁদের নয়। এই হঠাৎ দেখা আসলে দুই নারীর। এক পুরুষকে কেন্দ্রে রেখে জীবন কাটাচ্ছে এবং কাটিয়েছে যারা। মালিনী আর সুদীপার।
হঠাৎ দেখা ফেলে আসা জীবনের সঙ্গেও।
এ ভাবেই নিজেদের নতুন ছবির চিত্রনাট্য সাজালেন নন্দিতা রায় আর শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়। কিন্তু, এটুকুতেই শেষ নয়।
ছবিতে হঠাৎ দেখা এক জুটির সঙ্গেও। দীর্ঘ দিন এক সঙ্গে না দেখায় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও কখন যেন প্রাক্তন জুটি হয়ে গিয়েছেন।
তার পর?
কিছুটা ‘ইজাজত’, কিছুটা ‘নায়ক’, কখনও বা ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’! এই সব ছবি কোনও না কোনও দিক থেকে সামান্য হলেও ছাপ রেখে গিয়েছে নন্দিতা-শিবপ্রসাদের ‘প্রাক্তন’-এর গায়ে।
যেমন ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’-র মেমোরি গেম এই ছবিতে এসেছে গানের লড়াই হয়ে। ‘নায়ক’-এ অদিতি যখন অরিন্দমের সঙ্গে ট্রেনের দরজার সামনে দেখা করতে যাওয়ার সময়ে চশমাটা খুলে নেয়, এসেছে সেই দৃশ্যও।
মজা হল, অভিযোগ বড় সহজেই তোলা যায়। বলাই যায়, এই সব প্রভাব সমেত ছবির কাঠামো মূলত এগিয়েছে রেখা আর নাসিরুদ্দিন শাহ-র ‘ইজাজত’-কে নিয়ে। সেই হঠাৎ দেখা, ফ্ল্যাশব্যাক। ফ্ল্যাশব্যাকে কলহমুখর দাম্পত্য, কান্না, বার বার চেয়েও একসঙ্গে থাকতে না পারা। এবং, ঠিক ‘ইজাজত’-এর মতোই একটা শেষ চেষ্টা করা দাম্পত্য টিকিয়ে রাখার! দু’জনে মিলে একসঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার চেষ্টা করা। চেষ্টা ব্যর্থ হলে ‘ইজাজত’-এর মতোই এই ছবিতে সুদীপার উজানকে ছেড়ে যাওয়া!
টুকলি? না কি সব প্রাক্তন প্রেমের গল্পই কোথাও একটা গিয়ে এক হয়ে যায়?
কিন্তু, সে কথা আপাতত থাক! বরং, নন্দিতা-শিবপ্রসাদের ছবির যা একেবারে নিজস্ব, তাকানো যাক সে দিকে।
নন্দিতা-শিবপ্রসাদ খুব সুন্দর করে ছবিতে তুলে এনেছেন সম্পর্ক ভাঙা এবং গড়ার দিকটাকে। সেই জন্য রেলগাড়ির একেকটা কামরায় ভিড় করে থাকে একেকটা সম্পর্ক। বর্ষীয়ান দম্পতির সম্পর্ক, যারা আজও নিজেদের ছেড়ে কোথাও যায়নি। সদ্য বিবাহিত এক দম্পতি, যাদের সম্পর্ক সবে শুরু হচ্ছে, ধীরে ধীরে ভালবাসা আসছে। আর গান নিয়ে চার বন্ধু, যাদের মধ্যে একজন অনুপস্থিত প্রিয় বন্ধুকে চোখে হারাচ্ছে! প্রাক্তন হয়ে গিয়েছে পরস্পরের কাছে।
এই পুরোটা নিয়ে নানা তুলনা টেনেও ‘প্রাক্তন’ দেখতে ভালই লাগবে! বোঝা যাবে, কখন কী হতে চলেছে। কিন্তু, তার জন্য ছবি দেখার টানটা পুরোপুরি জলে যাবে না। হিসেব মিলিয়ে নেওয়ার মজাটা পাওয়া যাবে ষোল আনা।
সেই মিলিয়ে নেওয়ার ব্যাপারটা বড় সহজ হয়ে ধরা দেবে ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত আর প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়ের রসায়নে। অনেক দিন পরে ফিরে এলেন তাঁরা। মনে হল, যেখানে থেমে গিয়েছিল জুটির রসায়ন, ঠিক সেই জায়গা থেকেই শুরু হয়েছে।
ফলে, সুদীপা আর উজানকে কখনই মেকি মনে হয় না। ঝগড়ার দু-একটা জায়গা ছাড়া। সেই জন্য ফ্ল্যাশব্যাকের গল্পে কিছু অস্বস্তি থাকলেও বর্তমানে এসে তা উধাও হয়ে যায়। ছবি দেখার মজাও বাড়ে বিরতির পর থেকে।
আসলে, চিত্রনাট্য নয়, অভিনেতারাই এই ছবির ইউএসপি। ঋতুপর্ণা আর প্রসেনজিতের রসায়ন তো মুগ্ধ করবেই! পাশাপাশি, সদ্য বিবাহিত দম্পতির চরিত্রে বিশ্বনাথ বসু আর মানালি দে খুব বিশ্বস্ত ভাবেই কমিক রিলিফ দেবেন। স্বস্তি মিলবে সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায় আর সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের যুগলবন্দিতে। মনে হবে, অনেকটা বয়স পেরিয়ে এসে দাম্পত্য এরকমই হোক!
ভাল লাগবে চার বন্ধুর গানের দলকেও। তাঁরা ‘ভূমি’-র সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়, ‘চন্দ্রবিন্দু’-র অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায় আর উপল সেনগুপ্ত। এবং সঙ্গে অনুপম রায়। তাঁরা অভিনয় করেছেন নিজেদের চরিত্রেই। ফলে একটা চমৎকার বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। তাঁদের জীবনের ঘটনা সরাসরি তুলে এনে সেটাকে জমাট করেছেন নন্দিতা-শিবপ্রসাদ।
কিন্তু, সবাইকে ছাপিয়ে গিয়েছেন স্রেফ একজন। মালিনীর চরিত্রে অপরাজিতা আঢ্য। শুধু তাঁর জন্য বার বার দেখা যায় ‘প্রাক্তন’। সবাই মনে হয়েছে অভিনয় করেছেন, বিশ্বাসযোগ্য ভাবে! কিন্তু, অপরাজিতা তার ধার-কাছ দিয়েই যাননি। তিনি একান্ত ভাবেই মালিনী। দেখতে দেখতে একবারের জন্যও তাঁকে ছবির চরিত্র বলে মনে হবে না। তিনি এতটাই সাবলীল! বলাই যায়, তাঁর সঙ্গত পেয়েছে বলেই চমকে দিয়েছেন শিশুশিল্পী অভীপ্সা বসাকও!
সব মিলিয়ে তাই ‘প্রাক্তন’ দেখতে খারাপ লাগবে না! ঘুরে আসতেই পারেন। একা বা বর্তমান সঙ্গী/সঙ্গিনীর সঙ্গে।
কে জানে, ছবি আর জীবন তো হাঁটতেও পারে পাশাপাশি!
ছবি: প্রাক্তন
পরিচালনা: নন্দিতা রায় এবং শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়
অভিনয়: ঋতুপর্ণা সেনগুপ্ত, অপরাজিতা আঢ্য, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মানালি দে, অভীপ্সা বসাক, প্রসেনজিৎ চট্টোপাধ্যায়, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, বিশ্বনাথ বসু, অনুপম রায়, সুরজিৎ চট্টোপাধ্যায়, অনিন্দ্য চট্টোপাধ্যায়, উপল সেনগুপ্ত প্রমুখ
৫/১০
The post ছবি আর জীবন পাশাপাশি হাঁটল ‘প্রাক্তন’-এ appeared first on Sangbad Pratidin.