রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়, রাঁচি: মাহি মার রাহা হ্যায়…মাহি মার রাহা হ্যায়…।
উঁহু, এমএস ধোনি বায়োপিক প্রদর্শিত মেঠো পথ ধরে জনৈক স্কুল পডুয়া উপরের লাইনটা বলতে বলতে বৃহস্পতিবার একেবারেই ছুটে আসছিল না। ঝাড়খণ্ডের ঝাঁ চকচকে জেএসসিএ স্টেডিয়ামে ওসব গ্রাম্য পথঘাটের গল্পই নেই। কিন্তু দুপুর-দুপুর বেশ কিছু কিশোরকে দেখা গেল ভীমবেগে স্টেডিয়ামের ভেতরে ঢোকার আপ্রাণ চেষ্টা করতে। ফাঁকফোঁকর দিয়ে তাণ্ডব চোখে পড়েছে বুঝি! তাদের হাতে মোবাইল, চোখে প্রিয় মাহি ভাইয়ার সঙ্গে একটা ছবি তোলার তীব্র অভিলাষ, আর ঠোঁটে বায়োপিকের পর আসমুদ্রহিমাচলে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া সেই চিরআবেগের সংলাপ।
মাহি মার রাহা হ্যায়! ঝাড়খণ্ড স্টেডিয়ামের ‘পেয়াদা’র রক্তচক্ষু সমেত ছুটে আসাতেও দেখা গেল বিশেষ কাজ হল না। স্বাভাবিক। সিনেমা কেমন হবে, তার ট্রেলার একটা আন্দাজ দেয়। কিন্তু ক্রিকেটে অত ট্রেলার চলে না। ক্রিকেটার নেটে রাজত্ব করলেও বাইশ গজে সেই রাজপাট অনেক সময় জলে যেতে পারে। কিন্তু ক্রিকেট নেট অবশ্যই ক্রিকেটারের প্রাক যুদ্ধ মননের একটা প্রতিরূপ দিয়ে যায়। আর সেটা ধরলে, অস্ট্রেলিয়ার জন্য প্রার্থনা করা ছাড়া বোধহয় বিশেষ উপায় নেই। মহেন্দ্র সিং ধোনি যা মারছিলেন!
আর মহেন্দ্র ধোনি এদিন যা মারছিলেন, সব নর্থ প্যাভিলিয়নের দিকে উলটো মুখ করে। সাউথ প্যাভিলিয়নের দিকটায়। যে প্যাভিলিয়নের নাম আপাতত পালটে এমএস ধোনি প্যাভিলিয়ন করে দেওয়া হয়েছে। তা, গোটা পনেরো বল বিভিন্ন গ্যালারির কোলে আশ্রয় নিল, তিন-চারটে মাঠের বাইরে ছিটকে বেরোল সুপারসনিক গতিতে। পরে ভুবনেশ্বর কুমার হাসতে হাসতে বলছিলেন যে, ধোনি চেষ্টা করছিলেন তাঁরই নাম লেখা গ্যালারি টার্গেট করতে! অর্থাৎ, গ্যালারির যে অংশে তাঁর নাম অধুনা জ্বলজ্বল করছে, সপাট ছক্কায় তার গায়ে নিজ পরিচিতির সিলমোহর বসিয়ে দিতে! কিন্তু তারপরেও ভারতীয় পেসারের কথা পুরো বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। কারণ- বৃহস্পতিবারের ভারতীয় নেট। যেখানে ধোনির আক্রোশের লক্ষ্যবস্তু ছিল স্পিন বোলিং। আর স্ট্যাটসবুক বলছে, দু’দিন আগে নাগপুর ওয়ানডে-তে যে ভদ্রলোক ধোনিকে প্রথম বলে তুলে নিয়েছিলেন, তাঁর নাম অ্যাডাম জাম্পা। অস্ট্রেলীয় লেগস্পিনার। মহেন্দ্র ধোনি ঘরের মাঠে সেই জাম্পা বধের মহড়া আগাম সেরে রাখলেন না তো?
[বিশ্বকাপের পরই অবসর ধোনির! কী বলছেন সৌরভ?]
আসলে এদিন সকাল থেকে যেভাবে সব চলছে একের পর এক, তারপর বিশদ বিশ্লেষণে না গিয়ে পরপর ছবি তুলে দেওয়াই শ্রেয়। ক্রিকেটের অরণ্যপ্রবাদ- এটা টিমগেম। ‘আমি’ নয়, ক্রিকেটে প্রাধান্য পায় ‘আমরা।’ কিন্তু দিনভর রাঁচিতে যা চলল তাতে ক্রিকেটের আপ্তবাক্য পালটে ফেলতে ইচ্ছে করবে। আমরা-টামরা নয়। রাঁচিতে পুরোটাই ‘আমি’- মহেন্দ্র সিং ধোনি। ভারতের এদিন অপশনাল প্র্যাকটিস সেশন ছিল। বিরাট কোহলিরা না এলেও শিখর ধাওয়ান, যুজবেন্দ্র চাহালরা ছিলেন। কিন্তু ধোনি কিছুক্ষণের মধ্যে ব্যক্তিগত ল্যান্ডরোভার চালিয়ে স্টেডিয়ামে ঢুকে পড়ার পর শিখরের অফ ফর্ম থেকে বেরনোর প্রাণান্ত প্রয়াস আর তখন কে দেখবে? মিডিয়ার পুরো ঝাঁকটা সটান ঘুরে গেল ধোনির দিকে। ঘরের মাঠে জীবনের শেষ ম্যাচ খেলতে নামছেন ভূমিপুত্র! প্রতিটা মুহূর্ত লেন্সবন্দি না করে উপায় আছে?
আর ধোনি শুরুটাও করলেন পুরোদস্তুর ‘বরকর্তা’র মেজাজে। কী চলছে না চলছে, সব যেন তাঁকে জানতে হবে পুঙ্খানুপুঙ্খ। দেখতে হবে, তাঁর গৃহে টিমের যেন বিন্দুমাত্র অসুবিধে না হয়। মাঠে ঢুকে সোজা পিচের পাশে চলে গেলেন ধোনি। নির্নিমেষ দেখে চললেন বাইশ গজ। কিছুক্ষণের মধ্যে ভারতের হেড কোচ রবি শাস্ত্রী তাঁর সঙ্গে জুড়লেন। ধোনি এরপর ঝুঁকে পড়ে পিচ টিপেটুপে দেখতে লাগলেন। কিছু নির্দেশও দিতে দেখা গেল কিউরেটরকে। পরে শোনা গেল, রাঁচি পিচে কিছু ঘাস ছাড়া ছিল। ধোনি নাকি দেখামাত্র তা ওড়াতে নির্দেশ দিয়েছেন। কিউরেটরদের নাকি বলেছেন, প্র্যাকটিস পিচের সঙ্গে ম্যাচ পিচের সামঞ্জস্য নেই। প্র্যাকটিস পিচে ‘রাফ’। আসল পিচে ঘাস। ভারত নামবে দুই স্পিনার নিয়ে। সেখানে এত ঘাস রেখে হবেটা কী? এরপর দু’টো ব্যাট নিয়ে শ্যাডো করতে করতে নেটে ঢোকা এবং স্পিনারদের পূর্ব বর্ণিত বেদম প্রহার।
দেখেশুনে কে বলবে, কাল এখানে একটা আন্তর্জাতিক ম্যাচও আছে। যেখানে ভুবনেশ্বরকে টিমে ফিরিয়ে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সিরিজ জয়ের যুদ্ধে নামতে চলেছে ভারত? কিন্তু ঘরের মাঠে ধোনির শেষ ম্যাচ ঘিরে এত মাতামাতি, এত আবেগ চারদিক থেকে ছুটে এসে আশপাশ ছেয়ে ফেলছে যে, রাঁচি ওয়ানডে-তে কেএল রাহুল, না টানা ব্যর্থ আম্বাতি রায়ডুকে খেলবেন- কারও আগ্রহ নেই। ধোনি ‘না’ করে দেওয়ায় তাঁর নামাঙ্কিত প্যাভিলিয়ন উদ্বোধন কাউকে দিয়ে আর করানো হচ্ছে না। বলাবলি চলছে, স্টেডিয়ামের এক কফিশপ উদ্বোধন করতে বলায় কাউকে সময় না জানিয়ে ফিতে কেটে চলে গিয়েছিলেন ধোনি! কেউ আগাম কোনও খবর পায়নি। সেই লোক তাঁর নামাঙ্কিত গ্যালারি উন্মোচন নিয়ে কোনওরকম ঢক্কানিনাদ যে পছন্দ করবেন না, লিখে দেওয়া যায়। কিন্তু ম্যাচে চমক আনতে ঝাড়খণ্ড আনছে ডায়না এডুলজিকে। ভারতের মহিলা ক্রিকেটের বৃহৎ নক্ষত্র এবং বর্তমান সিওএ সদস্যকে দিয়ে নাকি ম্যাচে টস করানো হবে। অস্ট্রেলীয় স্পিনার নাথন লায়নকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ধোনির নামে স্ট্যান্ড দেখে মনে হয় না আমারও তো এরকম হতে পারত? উত্তরে সশ্রদ্ধ লায়ন বলে দিলেন, এ সব স্ট্যান্ড-প্যাভিলিয়নের অলঙ্কার ধোনিকেই মানায়। তাঁকে নয়। কারণ ধোনি কিংবদন্তি, তিনি নন। আর আবেগ? নিজভূমিতে ধোনির শেষ ম্যাচ ঘিরে রাঁচির পরস্পরবিরোধী মত পাওয়া গেল এদিনও।
[রাঁচির স্টেডিয়ামে নিজের নামে স্ট্যান্ড উদ্বোধন থেকে সরে এলেন ধোনি]
একদল মিডিয়ার উপর ক্ষিপ্ত। এঁরা নাকি বুঝে পাচ্ছেন না, কী করে লেখা হচ্ছে রাঁচিতে ধোনির এটাই শেষ? যে প্রশ্নটা ভুবনেশ্বর কুমারকেও পালটা করতে শোনা গেল সাংবাদিককুলকে। আর ঝাড়খণ্ড কর্তারা বলছেন, অক্টোবরে আরও একটা ওয়ানডে ম্যাচ পাওয়ার কথা রাঁচির। সেখানে ধোনি খেলবেন না, কে গ্যারান্টি দিচ্ছে? কিন্তু এমনও কিছু ধোনি-ঘনিষ্ঠ পাওয়া গেল, যাঁরা প্রিয় মাহির অবসর-জীবন নিয়ে আলোচনা শুরু করে দিয়েছেন। এঁদের ধারণা, বিশ্বকাপ খেলে অবসরের পর দু’টো কাজ করবেন ধোনি। প্রথমত, নিজের স্পোর্টস স্কুল তৈরির কাজ শেষ করবেন। দুই এবং ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ দুই, সম্ভবত রাজনীতিতে যোগ দেবেন। এঁরা কেউ কেউ শুনেছেন, মাস তিনেক আগে দেশের শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক দলের হেভিওয়েটদের সঙ্গে নাকি বৈঠক করেছেন ধোনি। ভবিষ্যতে তাঁর রাজ্যসভা এমপি হওয়া নিয়ে নাকি হাওয়া আছে। এহেন চর্চার কতটা সত্যি, কতটা অতিরঞ্জিত কল্পনা বলা মুশকিল। তার চেয়ে ছাড়ুন ও সব। নেটে হাঁকানো ছক্কাগুলোর ট্রেলারের ওম নিয়ে শুক্রবার রাঁচির মাঠে আসল পিকচার-এ অপেক্ষায় থাকা যাক না অত্যাশ্চর্যের প্রত্যাশায়!
আজই তো রাঁচিতে ওয়ান লাস্ট টাইম মহেন্দ্র সিং ধোনি!
The post ঘরের মাঠে অন্তিম ম্যাচের আগে ধোনি যেন ‘বরকর্তা’ appeared first on Sangbad Pratidin.