সংবাদ প্রতিদিন ব্যুরো: ২০ সপ্তাহে নয়। শর্তসাপেক্ষে ২৪ সপ্তাহেও গর্ভপাত করা যাবে। নতুন এই সময়সীমা বেঁধে দিয়ে মঙ্গলবার রাজ্যসভায় (Rajya Sabha) পাস হয়ে গেল মেডিক্যাল টার্মিনেশন অফ প্রেগন্যান্সি (MTP) আইন। এখন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের (Ram Nath Kovind) সইয়ের অপেক্ষা। তারপরই দেশজুড়ে এই নতুন আইন কার্যকর হবে।
মূলত, ধর্ষিতা, অত্যাচারিতা, নাবালিকা হবু মা এবং গর্ভস্থ ভ্রূণের ত্রুটি থাকলে গর্ভসঞ্চারের কয়েক মাস পর গর্ভপাত (Abortion) করার প্রয়োজন পড়ে অনেকের। তাঁদের কথা মাথায় রেখে এই নতুন আইন। নতুন এই আইনে যাঁর গর্ভপাত হচ্ছে, তাঁর পরিচয়ও গোপন থাকবে।
নয়া বিলে বলা হয়েছে, সময়ের সঙ্গে চিকিৎসা বিজ্ঞান উন্নত হয়েছে। এখন মেয়েদের জীবনের কথা ভেবে (পড়ুন নির্যাতিতা) গর্ভপাতের সময়সীমা বাড়ালে অনেকের সুবিধা হবে। প্রসঙ্গত, এখন থেকে ২০ সপ্তাহের আগে গর্ভপাত করাতে হলে একজন চিকিৎসকের মত জানা দরকার। ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহে দু’জন চিকিৎসকের মতামত জানতে হবে। কোনও বিশেষ পরিস্থিতিতে ২৪ সপ্তাহের বেশি হলে অন্তঃসত্ত্বার স্বাস্থ্যের কথা মাথায় রেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেন্দ্রীয় নারী ও শিশুকল্যাণ মন্ত্রক, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং নীতি আয়োগ যৌথ উদ্যোগে এই আইনের খসড়া তৈরি করে। গত বছর মার্চ মাসে লোকসভায় বিলটি পেশ করা হয়। সে সময় কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. হর্ষবর্ধন জানিয়েছিলেন, এমন কোনও আইন আনা হবে না যা মহিলাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর।
মঙ্গলবার রাজ্যসভার ডেপুটি চেয়ারম্যান হরিবংশ নারায়ণ সিং জানান, বিলটি রাজ্যসভার সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর দাবি উঠেছিল। তবে তা ধ্বনিভোটে নস্যাৎ হয়ে যায়। এছাড়াও বিলে কিছু সংশোধনী আনার কথাও বলা হয়েছিল, যা ভোটাভুটিতে বাতিল হয়। এমটিপি-র নতুন আইনে বলা হয়েছে, বিশেষ পরিস্থিতিতে গর্ভপাতের সময় ২৪ সপ্তাহের বেশি হলে রাজ্যে চিকিৎসক দল গঠন করতে হবে। এই পাঁচ সদস্যের এই টিমে থাকবেন স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ, শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ, রেডিওলজিস্ট, সোনোলজিস্ট। স্বীকৃত চিকিৎসকের সায় থাকলে গর্ভপাত করাতে পারেন। তাছাড়া, গর্ভনিরোধক ওষুধ কাজ না করায় যদি গর্ভসঞ্চার হয় এবং পরে গর্ভপাতের প্রয়োজন হয়, সেক্ষেত্রেও আইনসঙ্গতভাবে গর্ভপাত করতে পারবেন। এতদিন দেশে কেবল বিবাহিতরাই আইনত গর্ভপাত করাতে পারতেন।
[আরও পড়ুন: পদত্যাগ করলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির প্রধান উপদেষ্টা! কারণ ঘিরে জল্পনা]
রাজ্যসভার সদস্য তথা তৃণমূল নেতা ডা. শান্তনু সেন রাজ্যসভায় জানান, এই আইনে যৌনকর্মীদের কথাও বলা উচিত ছিল। সেই সঙ্গে তিনি আরও জানান, দেশে ৫৬ শতাংশ গর্ভপাতে সমস্যা দেখা যায়। অবিলম্বে গর্ভপাত করার বিশেষ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা উচিত। ডা. সেন আরও জানান, গর্ভপাতের জন্য যে দল গঠনের কথা বলা হচ্ছে, তাতে অবশ্যই একজন ভাল আনাস্থেটিস্ট এবং মনোবিজ্ঞানী থাকা প্রয়োজন। যাতে অস্ত্রোপচার চলাকালীন বা আগে ও পরে মহিলার কোনও জরুরি অবস্থা তৈরি না হয়। তিনি আরও জানান, হাথরাস বা বলরামপুরের মতো নাবালিকা নির্যাতিতার জন্য সে অন্তঃসত্ত্বা কি না, সময়মতো জানা মুশকিল। তাই দরকার ফাস্ট ট্র্যাক আদালত গঠন।
ন্যাশনাল মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. আরতি বিশ্বাসের কথায় “অত্যন্ত ভাল খবর। কারণ, ২৪ সপ্তাহ না হলে গর্ভস্থ শিশুর ফুসফুস-সহ অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিকশিত হয় না। হৃদযন্ত্রও ২৪ সপ্তাহের পর তৈরি হয়। তাই গর্ভপাত করা যেতেই পারে। আবার গর্ভস্থ শিশুর হৃদযন্ত্রে কোনও সমস্যা থাকলে তা জানতে ‘ফিটাল ইকোকার্ডিওগ্রাফি’ করতে হয়। কিন্তু ২০ সপ্তাহ পরেই করা সম্ভব। তার আগে করা যায় না। কিন্তু আগের নিয়মে তা সম্ভব হত না। ঠিক এই জন্যই আইন সংশোধন অত্যন্ত ভাল পদক্ষেপ।” আগের আইনে গর্ভসঞ্চারের ২০ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাতে অনুমতি দেওয়া হত। এমটিপি আইন, ১৯৭১-এর সেকশন ৩(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, “দু’টি কারণে চিকিৎসকের সাহায্যে গর্ভপাত করা যেতে পারে। এক, গর্ভাবস্থার সময়সীমা ১২ সপ্তাহের কম থাকে। দুই, সময়সীমা কুড়ি সপ্তাহের বেশি না হয়। তবে সেক্ষেত্রে দু’জন চিকিৎসকের মতামত বাঞ্ছনীয়।”
উল্লেখ্য, গর্ভাবস্থার সময়ে অন্তঃসত্ত্বার জীবন ও স্বাস্থ্যের মারাত্মক ঝুঁকি থাকে। যদি অন্তঃসত্ত্বার শারীরিক কোনও অসামঞ্জস্য থাকে, সেক্ষেত্রে শিশুর জন্মের সময় শারীরিক ও মানসিক অস্বাভাবিকতা দেখা দিতে পারে।গর্ভপাতের সময়সীমা ২০ থেকে ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেওয়ায় চিকিৎসক ও সমাজকর্মীরা নতুন আইনকে স্বাগত জানিয়েছেন। তাঁদের ধারণা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের সামাজিক অবস্থানও পরিবর্তিত হয়েছে। তাই নতুন আইনের দরকার ছিল।
নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজের স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রুণা বল বলেন, ‘‘২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত গর্ভপাত আইনসিদ্ধ হলে আখেরে ভালই হবে। কারণ, ২০ সপ্তাহে গর্ভস্থ শিশুর অ্যানোম্যালি স্ক্যান হয়। রিপোর্ট আসতেও অনেকটা দেরি হয়। রিপোর্টে অনভিপ্রেত কিছু থাকলে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়া সুবিধাই হল।’’ বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, ১৪ থেকে ১৬ সপ্তাহে আল্ট্রাসাউন্ড করে গর্ভস্থ ভ্রূণের প্রকৃত অবস্থা জানাটা খুব জরুরি। তাই শহর, শহরতলির পাশাপাশি গ্রামগঞ্জে উপযুক্ত স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তৈরি করা জরুরি। তাহলেই সাধারণ কাউকে ২৪ সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষাও করতে হবে না। কারণ, সময় বাড়লে মায়ের প্রাণসংশয়ও হতে পারে।