বিশ্বদীপ দে: গত মাসের কথা। আফগানভূম (Afghanistan) থেকে পুরোদমে সরানো শুরু হয়ে গিয়েছে মার্কিন (US) সেনা। তালিবানের (Taliban) ফের কাবুল (Kabul) দখলের সম্ভাবনা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হতে শুরু করেছে। ঠিক এই সময় মার্কিন জঙ্গিবিরোধী সংগঠনের বিশেষজ্ঞদের নজরে পড়ল এক অদ্ভুত বিষয়। চার বছর পরে প্রকাশিত হয়েছে এক অনলাইন ম্যাগাজিনের নতুন সংখ্যা। নাম ‘ইন্সপায়ার’। যা দেখে চক্ষু চড়কগাছ মার্কিন গোয়েন্দাদের। কেননা সেই পত্রিকাটি এমন এক জঙ্গি গোষ্ঠীর, যারা কার্যত ঘুমন্ত দৈত্য! তাদের নাম আল কায়দা (Al-Qaeda)।
সৌদি আরব ও ইয়েমেনের আল কায়দার জঙ্গি নেতৃত্বের পরিচালনায় প্রকাশিত সেই পত্রিকার নতুন সংস্করণ বুঝিয়ে দিল দৈত্যরা বুঝি আবার জেগে উঠছে। আর তখন থেকেই ক্রমশ জেগেছে ভয়। সব আশঙ্কা সত্যি করে আফগানিস্তানের দখল নিয়ে নিয়েছে তালিবানরা। এবার কি তবে স্বরূপ ধারণ করবে আল কায়দাও? আগামীর পৃথিবীর জন্য তা যে এক ঘোর অশনি সংকেত! তালিবান শেষ পর্যন্ত যতই ভয়ানক হোক, ‘গ্লোবাল জেহাদ’-এর দুঃস্বপ্নের আসল কাণ্ডারি কিন্তু আল কায়দাই। তাই তাদের শক্তিবৃদ্ধির এমন ইঙ্গিত ভয় ধরিয়েছে আমেরিকার বুকে। কেবল আমেরিকাই নয়, গোটা বিশ্বের কাছেই আসলে আল কায়দা এক অভিশাপের নাম। ৯/১১-র নিঃসীম আতঙ্ক এখনও চেপে বসে রয়েছে পৃথিবীর হৃদয়ে।
[আরও পড়ুন: Taliban Terror: অবশেষে ‘বোধোদয়’, যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্তানে অস্ত্র বিক্রি বন্ধ করল আমেরিকা]
তবে আল কায়দার পয়লা নম্বর শত্রু যে আমেরিকা, তাতে সন্দেহ নেই। নতুন সংখ্যায় সেই ইঙ্গিতও রয়েছে। সেখানে আমেরিকার আগ্নেয়াস্ত্র আইনের ফাঁকফোকরকে কাজে লাগিয়ে আরও বেশি খুনোখুনি, হত্যালীলাকে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। কলোরাডোয় বন্দুকবাজের গুলিতে ১০ জনের মৃত্যুতে কার্যত উল্লাস প্রকাশ করা হয়েছে।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট আল কায়দাকে পাত্তা দিতে খুব একটা রাজি নন। কিন্তু তিনি যাই মনে করুন, জঙ্গি কার্যকলাপ বিশেষজ্ঞরা নিশ্চিত যে আল কায়দা রীতিমতো জেগে উঠেছে। তারা কেবল অপেক্ষায় রয়েছে প্রকৃত সুযোগের। আফগানিস্তান তালেবদের কবজায় চলে যাওয়ার পরে সেই সুযোগ বহুগুণে বেড়ে গিয়েছে। আফগানিস্তান হয়ে উঠতে চলেছে জঙ্গিদের ‘স্বর্গ’। সেখানে আল কায়দা ছাড়াও দাপিয়ে বেড়াবে আইএস কিংবা আরও সব জঙ্গি গোষ্ঠী। যা বিশ্বশান্তির জন্য খুব ভাল খবর নয়।
[আরও পড়ুন: Taliban Terror: ভারতীয় দূতাবাসে তালিবানের হানা, নেপথ্যে পাক গোয়েন্দা সংস্থা ISI]
ওয়াশিংটনের বাসিন্দা চার্লস লিস্টার, যিনি মধ্যপ্রাচ্যের জঙ্গিবিরোধী কর্মসূচির অন্যতম কর্তাব্যক্তি, তাঁর কথায়, ”আল কায়দার কাছে এটা রীতিমতো ‘ড্রিমস কাম ট্রু। ৯/১১ পরবর্তী সময়ে এই প্রথম তারা নতুন করে অক্সিজেন পেল।” কথাটা সত্যিই। সেই দু’দশক আগে টুইন টাওয়ার ধ্বংসের ভয়াবহতার রেশ কাটতে সময় নেয়নি। আফগানিস্তানের মাটিকে ব্য়বহার করেই হামলার ব্লু প্রিন্ট ছকা হয়েছিল। মার্কিন সেনার আফগানিস্তান আক্রমণের পরে সব কিছুই এলোমেলো হয়ে যায়। তালিবান আধিপত্য হারায়। মারা যায় বহু তালিবান নেতা। একই অবস্থা হয়েছিল আল কায়দারও। ২০১১ সালে নিকেশ হয় খোদ লাদেন। পাশাপাশি দলীয় কোন্দল কিংবা আইএসের মতো আরও উগ্র জেহাদি গোষ্ঠীর দাপটে ধীরে ধীরে জমি হারায় আল কায়দা।
লাদেনের মৃত্যুর পর আল কায়দার রাশ ধরে আয়মান আল জওয়াহিরি। কিন্তু গত কয়েক মাসে তার দেখা মেলেনি। ফলে মার্কিন ড্রোন হামলা বা বিরোধী শিবিরের হাতে তার মৃত্যু হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না। কিংবা গুরুতর জখম হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। যেটাই সত্যি হোক, জাওয়াহিরি পরবর্তী আল কায়দা নেতৃত্বে তেমন জাঁদরেল নেতার যে সত্য়িই অভাব রয়েছে, সেটা অস্বীকার করা যায় না।
কিন্তু তাহলে এত আতঙ্ক কেন আমেরিকার মনে? আসলে তালিবানের আফগানিস্তান দখলই সমীকরণ বদলে দিয়েছে। আল কায়দা ও আইএসের মতো জঙ্গি সংগঠন যে কোনও সময়ে ফুলে ফেঁপে উঠতে পারে, এটা ওয়াকিবহাল মহলের ভালই জানা। আর সেই কারণেই আশঙ্কার কালো মেঘ ক্রমেই ঘন হচ্ছে।
ঠিক এই মুহূর্তে কী অবস্থা আল কায়দার? আফগানিস্তানে মোতায়েন মার্কিন সেনা সূত্র বলছে মেরেকেটে ৩০০ থেকে ৫০০-র বেশি আল কায়দা জঙ্গি এই মুহূর্তে আফগানিস্তানে নেই। যা একেবারেই ধর্তব্যের মতো নয়। কিন্তু এবার মার্কিন সেনা হঠে যাওয়ার পরে এবং তালিবানরা এসে যাওয়ায় বিশেষত পূর্ব আফগানিস্তানে রাতারাতি শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে আল কায়দা।
গত সপ্তাহেই কাবুলে থাকা এক মার্কিন সেনাকর্মী ফ্র্যাঙ্ক ম্যাকেঞ্জির মতে, ”কেবলই সময়ের অপেক্ষা। রাতারাতি ওরা ফের ক্ষমতাবান হয়ে উঠতে পারে। বড়জোর এক বছর। তার মধ্যেই ফের আমেরিকাকে লক্ষ্য করে মতলব ভাঁজতে শুরু করে দিতে পারে আল কায়দা। ওদের পরিকল্পনাই হল,আগে স্থানীয় সংগঠনগুলি একে একে পোক্ত করা। আর তারপর নিজেদের ক্ষমতা ফিরে পেলেই গ্লোবাল জেহাদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়া।”
এফবিআই-এর এক অফিসার আলি সোফিয়ান জানাচ্ছেন, আল কায়দার সংগঠন এখনও পুরোদস্তুর রয়েছে সোমালিয়া, ইয়েমেন, উত্তর আফ্রিকায় ও অন্যত্র। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব পুরোপুরি যোগাযোগ রেখেছে এই সব শাখার সঙ্গে। ফলে যে কোনও সময় সেই সব শাখার আরও পরিপুষ্ট হয়ে ওঠাটা আশ্চর্যের কিছু নাও হতে পারে।
তালিবানের সঙ্গে আল কায়দার অতীতে কিছু সমস্যা দেখা দিয়েছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তারা যে আল কায়দাকে কোনও ভাবে বাধা দেবে না তা পরিষ্কার। মুখে তারা আফগানিস্তানের মাটিকে ব্য়বহার করে অন্য দেশের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক চক্রান্ত করতে বাধা দেবে না বললেও আসলে তালেবরা কী চায় সকলেই জানে। যদিও ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে হওয়া শান্তি চুক্তিতে তালিবানরা কথা দিয়েছিল আল কায়দা-সহ অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীগুলিকে আশ্রয় দেবে না। কিন্তু গত জুনেই বহু প্রমাণ মিলেছে দুই গোষ্ঠীর মধ্যে দিব্যি আঁতাত রয়েছে।
গত সোমবার বাইডেন অবশ্য জানিয়ে দিয়েছেন, আল কায়দা কিংবা তালিবান ফের মার্কিনদের বিরুদ্ধে কোনও হামলা করতে এলে যথাযথ জবাব দেওয়া হবে। কিন্তু যতই তিনি হুঁশিয়ারি দিন, ভুলে গেলে চলবে না আফগান মাটিতে আর তাঁর সেনাদের উপস্থিতি নেই। যে ক’জন আছেন তাঁদেরও দ্রুত সরিয়ে নেওয়া হবে। ফলে পরিস্থিতি যে ক্রমশ জটিল হতে বসেছে তা পরিষ্কার। আর সেখান থেকেই জন্ম নিয়েছে আতঙ্ক। ফের কি ফিরে আসবে আল কায়দার ভয়ংকর সেই সব দিন? আর যাই হোক, তা যেন সত্যি না হয় সেটাই সারা বিশ্বের শুভাকাঙ্ক্ষী মানুষের প্রার্থনা।