বিশ্বজ্যোতি ভট্টাচার্য, শিলিগুড়ি: বিধ্বংসী হড়পা বানের বিপর্যয় কি উত্তরেও আসন্ন! সম্প্রতি কেরল, উত্তরাখণ্ড এবং হিমাচল প্রদেশে মেঘভাঙা বৃষ্টির জেরে ভয়ংকর বিপর্যয় দেখে ওই প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে শুরু করেছে উত্তরের নদী গবেষক মহলে। কারণ, উত্তরেও পালটেছে বৃষ্টির মতিগতি। যখন হচ্ছে অতিভারী। আবার ভরা বর্ষাতেও বৃষ্টির আকাল দেখা দিচ্ছে। এখানেও যে অতিরিক্ত ভারী অথবা মেঘভাঙা বৃষ্টি হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়! যদি হয় সেই জল কি নদীগুলো বহন করতে পারবে! তাই জবরদখলের শিকার হয়ে উত্তরের বেশিরভাগ নদীর রুদ্ধশ্বাস দশা দেখে শঙ্কা বেড়েছে ভয়ংকর হড়পা বানের।
বিশেষজ্ঞদের দাবি, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ার-সহ কোনও শহর এখন আর সুরক্ষিত নেই। সিকিম ও ভুটান পাহাড়ে ১০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেই বিপদ বাড়ছে। ২০০ থেকে ৩০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হলে কি পরিস্থিতি দাঁড়াবে! এমনিতেই প্রতিটি নদীবক্ষের উচ্চতা শহরের ভূপৃষ্ঠ ছাড়িয়েছে। তাই শহর-গ্রাম হড়পা বানে বিধ্বস্ত হতে বাধ্য। প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি জমি জবরদখল মুক্ত করার অভিযান চললেও বিপদ এড়াতে উত্তরের পাহাড়ি নদীগুলোকে কেন এখনই দখল মুক্ত করা হবে না! নদী দখল করে গড়ে ওঠা বহুতল, হোটেল, রেস্তরাঁ-সহ বসতি সম্প্রসারণ ঠেকাতে কেন আইনি পদক্ষেপ করবে না প্রশাসন!
শিলিগুড়ির মহানন্দা এবং বালাসন নদীকে রীতিমতো বিপজ্জনক মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দা তথা ময়নাগুড়ি কলেজের ভূগোল বিভাগের প্রধান মধুসূদন কর্মকার। ওই দুই নদীর চর এলাকা বিক্রি ঘিরে সিন্ডিকেট কারবার চলছে। সেখানেই মাথা তুলছে বহুতল, হোটেল, রেস্তোরাঁ, গ্যারাজ, পানশালা, বসতি। নদী ক্রমশ সঙ্কুচিত হয়ে শীর্ণকায় হয়েছে। অভিযোগ, সম্প্রতি সমরনগর সংলগ্ন মহানন্দা তীরের সাতমাজুয়া দ্বীপে বিঘার পর বিঘা সরকারি জমি বেদখল হয়েছে। নদীর গা ঘেঁষে নদীর চরে তৈরি হয়েছে বাড়ি। ওই পরিস্থিতিতে নদীর গতিপথ পালটে যাওয়ার শঙ্কা বেড়েছে।
[আরও পড়ুন: ‘আমরা রিল বানাই না, কঠোর পরিশ্রম করি’, বিরোধীদের ‘রিল মিনিস্টার’ কটাক্ষের জবাব রেলমন্ত্রীর]
মধুসূদনবাবু অবশ্য মনে করেন, শিলিগুড়ির যে প্রায় ১৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে মহানন্দা রয়েছে পুরোটাই এখন বিপজ্জনক। পাহাড়ে তেমন ভারী বর্ষণ হলে গতিপথ পালটে নদী কোনদিকে ঢুকে তান্ডব চালাবে ঠিক নেই। কেরালা, উত্তরাখণ্ড এবং হিমাচল প্রদেশের ভূমিধস এবং হড়পা বানের বিপর্যয় পুরোটাই প্রাকৃতিক নয় বলে দাবি মধুসূদনবাবুর। তার মতে অনেকটাই 'ম্যান মেড'। নদী উপত্যকা দখল করে যেখানে-সেখানে বসতি গড়ে ওঠায় প্রাণহানি বেড়েছে। তিনি বলেন, "উত্তরে এই ধরনের বিপর্যয়ে লোকসান অনেক বেশি হবে। তাই প্রশাসনের উচিত এখনই ব্যবস্থা গ্রহণ করা।"
তবে শুধু মহানন্দা, বালাসন, জোরাপানি নয়। জলপাইগুড়ির তিস্তা, করতোয়া, করলা, ধরধরা, কুমলাই, আলিপুরদুয়ারের কালজানি, ডিমা, নোনাই, চেকো, সাপকাটা, মুজনাই, গদাধর, কোচবিহারের সংকোশ, রায়ডাক-১/২, মানসাই, বুড়া ধরলা অথবা উত্তর দিনাজপুরের শ্রীমতি, কুলিক, সুই, সুদানি, বীণা যেদিকে চোখ যায় একই ছবি। নদী চুরি করে বেড়েছে কংক্রিটের বসতি, দোকান, চাষের মাঠ। নদী গবেষক তথা উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তন প্রধান সুবীর সরকার জানান, ২০০০ সালে তিস্তায় সমীক্ষা চালানোর সময় নদী এলাকায় দ্বিতল বাড়ি গড়ে উঠতে দেখেছেন। ব্যাপক ধান চাষ হচ্ছে। এরপর দুই দশকে পরিস্থিতি পুরোটাই পালটেছে।
তিস্তা সেতুর দুপাশে নদীর বাড়তি জল খেলার জন্য যে 'নো ম্যানস ল্যান্ড' ছিল দুই দশকের মধ্যে সেটা দখল করে বসতি এলাকা গড়ে উঠেছে। সেখানেও হোটেল, রেস্তরাঁ মাথা তুলেছে। লোনার্ক বিপর্যয়ের পর এমনিতেই তিস্তাবক্ষ দেড় মিটারের বেশি উঁচু হয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে সিকিম পাহাড়ে ফের অতিরিক্ত ভারী বৃষ্টি হলে জলপাইগুড়ি শহরের পরিস্থিতি দাঁড়াবে! হিমালয়ান নেচার অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চার ফাউন্ডেশনের মুখপাত্র অনিমেষ বসু বলেন, "পরিস্থিতি খুবই উদ্বেগজনক। এখনই প্রশাসন ও সাধারণ মানুষ নদী রক্ষায় এগিয়ে না এলে যে কতটা বিপদ বাড়বে উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ প্রমাণ।"