অজিত পাওয়ারকে মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসিয়ে বিজেপি এক ঢিলে অনেকগুলি পাখি মারার চেষ্টা করেছে। গত বছর উদ্ধব ঠাকরের সরকার ভেঙে ‘মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়ি’ জোটকে প্রথম ধাক্কাটা দিয়েছিল বিজেপি। এবারে শিবসেনা-র পাশাপাশি এনসিপি-ও অস্তিত্বহীনতার দিকে ঢলে পড়ল। বিশ্লেষণে সুতীর্থ চক্রবর্তী
এপ্রিলে যখন প্রথমবার অজিত পাওয়ার বিদ্রোহের ইঙ্গিত দিয়ে চুপ করে গিয়েছিলেন, তখন শরদ-কন্যা সুপ্রিয়া শূলে মন্তব্য করেন, ‘এখন সূর্য উঠেছে, কিন্তু ১৫ মিনিট পরেই বৃষ্টি নামবে কি না, তা বলা যায় না!’ মহারাষ্ট্রের রাজনীতি কতটা অনিশ্চয়তায় ঢাকা, তা বোঝাতে এর চেয়ে উপযুক্ত মন্তব্য কী হতে পারে!
অজিতের দল-ভেঙে বিজেপির সঙ্গে যাওয়া যে সময়ের অপেক্ষা, সুপ্রিয়ার মন্তব্যে সেই ইঙ্গিতও স্পষ্ট ছিল। ফলে, ভাইপো অজিতের গতিবিধি সম্পর্কে তিনি সম্পূর্ণ অন্ধকারে ছিলেন বলে ‘মারাঠা স্ট্রংম্যান’ শরদ পাওয়ার যে দাবি লাগাতার করে চলেছেন, তা মোটেই বিশ্বাসযোগ্য হচ্ছে না রাজনৈতিক মহলের। মহারাষ্ট্রের ঘটনাবলি কতখানি ‘পাওয়ার প্লে’-র অন্তর্গত, এখন প্রশ্ন সেখানেই।
মহারাষ্ট্রে যা ঘটল, তা একবছর আগের ‘অপারেশন লোটাস’-এর পুনরাবৃত্তি। এক্ষেত্রে হোটেলের নাটক, আস্থা ভোট, কোর্টের হস্তক্ষেপ, রাজভবনের তৎপরতা ইত্যাদির প্রয়োজন হয়নি। কিন্তু গত বছরের মতোই গোটা বিষয়টি ইডি-নিয়ন্ত্রিত। একনাথ শিন্ডেকে দিয়ে উদ্ধব ঠাকরের সরকার ও শিবসেনা ভাঙতে যেভাবে ইডিকে হাতিয়ার হিসাবে কাজে লাগানো হয়েছিল, এক্ষেত্রেও অজিত পাওয়ার ও প্রফুল্ল প্যাটেলকে দিয়ে এনসিপি ভাঙতে একইরকম সক্রিয় ইডি। ভাইপোকে বিজেপির দিকে ভিড়িয়ে দিয়ে মারাঠা স্ট্রংম্যান নিজেও ইডির নজরের বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করলেন বলে দাবি রাজনৈতিক মহলের বড় অংশের। ৪ বছর আগে মহারাষ্ট্র বিধানসভা ভোটের মুখে ইডি ‘মহারাষ্ট্র স্টেট কোঅপারেটিভ ব্যাংক’-এর ২৫ হাজার কোটি টাকা তছরুপের মামলায় অজিত পাওয়ারের সঙ্গে অশীতিপর শরদের নামও জুড়েছিল। মামলার গতি শিথিল করতে ইডির চাপে কাকা-ভাইপোর সম্মিলিত কৌশল, তথা ‘পাওয়ার পাঞ্চ’ কাজ করছে কি না, প্রশ্ন সেখানেই।
ইডি-সিবিআইকে ব্যবহার করে সরকার ও দল ভাঙার খেলাকে এক শৈল্পিক স্তরে নিয়ে গিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা। কেন্দ্রে ক্ষমতায় থাকার সময় ক্ষেত্রবিশেষে যে কংগ্রেস এই খেলা খেলেনি, তা নয়। কিন্তু বিজেপির মতো খুল্লমখুল্লা পর্যায়ে তা অতীতে কেউ নিয়ে যায়নি। এই কাজ করতে গিয়ে বিজেপি কোনও নীতি, নৈতিকতার ধার ধারছে না। উপহাসে পরিণত হয়েছে গণতান্ত্রিক রাজনীতির সমস্ত রীতি ও মূল্যবোধ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি প্রকাশ্য সভায় যে নেতাদের ‘সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ’ বলছেন, মাত্র কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই আবার তাঁদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে রাজ্যে রাজ্যে সরকার গড়ছেন। বিরোধীরা বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রচারে ‘ওয়াশিং মেশিন’ তত্ত্ব হাজির করেছে। মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক ঘটনার ক্ষেত্রেও বিজেপির ‘ওয়াশিং মেশিন’ সক্রিয়।
[আরও পড়ুন: যুদ্ধ কেড়েছে শৈশব! রাশিয়ায় ‘আটকে’ ৭ লক্ষ ইউক্রেনীয় শিশু]
অজিত পাওয়ারকে মহারাষ্ট্রের উপমুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসিয়ে বিজেপি এক ঢিলে অনেকগুলি পাখি মারার চেষ্টা করেছে। গত বছর উদ্ধব ঠাকরের সরকার ভেঙে ‘মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়ি’ জোটকে প্রথম ধাক্কাটা দিয়েছিল বিজেপি। কালক্রমে উদ্ধবের হাত থেকে শিবসেনা দলটাই চলে গেল। এবার অজিত পাওয়ারকে দিয়ে এনসিপিকে ভেঙে ‘মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়ি’-কে সবচেয়ে বড় ধাক্কাটা মারল বিজেপি। মহারাষ্ট্রের দু’টি প্রধান আঞ্চলিক দলই কার্যত ছত্রখান হয়ে গেল। কংগ্রেস, এনসিপি ও শিব সেনা হাত মিলিয়ে ‘মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়ি’ জোট তৈরি করার পর থেকেই বিজেপির রাতের ঘুম চলে গিয়েছিল। কয়েক বছরের মধ্যে পরিস্থিতি যা দাঁড়াল, তাতে ‘মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়ি’ জোটের অস্তিত্ব নিয়েই প্রশ্ন। এনসিপির ৫৩ জন বিধায়কের ৪০ জন অজিত পাওয়ারের সঙ্গে রয়েছেন বলে দাবি। শরদের সঙ্গে মাত্র ১৩ জন। যদি ধরে নেওয়া হয় যে, শরদের সঙ্গে বোঝাপড়া না করেই অজিত দল ভেঙেছেন, তাহলেও শরদের হাতেগড়া এনসিপি কার্যত অস্তিত্বহীনতার দিকেই চলে গেল। শিবসেনার ক্ষেত্রে যেমন ঘটেছে, শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ বিধায়কই নয়, দলের সংগঠনের সিংহভাগই চলে গিয়েছে একনাথ শিন্ডের সঙ্গে। শরদ পাওয়ারের বয়স এখন ৮৩ বছর। শরদ ছাড়া এনসিপির জননেতা একমাত্র অজিত-ই। ফলে, দলের পুরো কাঠামোটাই যে অজিতের দিকে ঝুঁকবে, তা বলা বাহুল্য। কয়েক দিন আগে শরদ দলের সাংগঠনিক নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন অজিতকে। মেয়ে সুপ্রিয়া শূলে ও প্রফুল্ল প্যাটেলকে দলের কার্যকরী সভাপতি বানিয়েছিলেন। এই দু’জনেরই মহারাষ্ট্রে জনভিত্তি নেই। দলের সংগঠনেও এঁদের প্রভাব নেই। প্রফুল্ল তো আবার অজিতের সঙ্গেই হাত মিলিয়েছেন। সুপ্রিয়াকে সামনে রেখে ৮৩ বছরের শরদের পক্ষে দলকে শূন্য থেকে ফের দাঁড় করানো কীভাবে সম্ভব, তা কারও কাছেই বোধগম্য নয়। ইডির হাত থেকে বাঁচতে আপাতত পাওয়ার তাঁর রাজনৈতিক কেরিয়ার ও গুরুত্বকে দাঁওয়ের উপর চড়ালেন কি না, প্রশ্ন সেখানেই।
মহারাষ্ট্র বিকাশ আঘাড়ি জোটকে পরপর দু’টি ধাক্কা মেরে কার্যত অস্তিত্বহীন করা ছাড়াও বিজেপি একই ঢিলে ধাক্কা দেওয়ার চেষ্টা করেছে বিরোধী জোটকে। পাটনার বিরোধী জোটের বৈঠকের ঠিক পরেই অজিত পাওয়ারের এই খেলা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। মহারাষ্ট্রের ঘটনাক্রম যে অন্য আরও দু’-একটি রাজ্যে ঢেউ তুলবে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ইতিমধ্যে বিহারে নীতীশ কুমার তাঁর দলের বিধায়ক ও সাংসদদের সঙ্গে আলাদা আলাদা করে বৈঠক শুরু করেছেন। বিহারেও বিজেপি ‘অপারেশন লোটাস’ করার ছক করছে বলে সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশ হয়েছে। নীতীশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড ‘অপারেশন লোটাস’-এর সম্ভাবনাকে উড়িয়ে দিলেও স্বস্তিতে নেই। মহারাষ্ট্রের পর উত্তরপ্রদেশে সমাজবাদী পার্টিকে ভাঙতে বিজেপি সক্রিয় বলে বিভিন্ন মহলে প্রচার চলছে। ফলে মহারাষ্ট্রের দৃষ্টান্ত দিয়ে িবরোধী জোট সম্পর্কে একটা নেতিবাচক প্রচার গেরুয়া শিবির থেকে শুরু হয়ে গিয়েছে।
অজিত পাওয়ারের ঘটনায় বিজেপি একইসঙ্গে একনাথ শিন্ডেকেও চাপে ফেলে দিয়েছে বলে রাজনৈতিক মহলের অভিমত। বস্তুত, অজিত পাওয়ারকে উপমুখ্যমন্ত্রী করার পর শিন্ডের উদ্দেশ্যে বিজেপির বার্তা হল, সব সম্ভাবনাই খোলা। শিন্ডের বিধানসভার সদস্যপদ ঝুলে রয়েছে বিজেপির স্পিকারের হাতে। উদ্ধব-পন্থী শিব সেনা নেতা সঞ্জয় রাউত দাবি করেছেন, শিন্ডেকে দ্রুত মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে সরাবে বিজেপি। অজিত পাওয়ারকেই মুখ্যমন্ত্রীর পদে আনা হবে। ২৮৮ আসনের মহারাষ্ট্র বিধানসভায় বিজেপির বিধায়ক ১০৬ জন। অজিত পাওয়ারের দাবি তাঁর সঙ্গে রয়েছেন এনসিপির ৪০ জন বিধায়ক। ফলে, সংখ্যাগরিষ্ঠতার জন্য প্রয়োজনীয় ১৪৫ সংখ্যাটা জোগাড় করতে অজিত পাওয়ার ও বিজেপির সমস্যা হবে না।
শিন্ডেকে সরানো হোক, না হোক, লোকসভা ভোটের আগে মহারাষ্ট্রের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে যে ক্ষমতার পুরো রাশ বিজেপির হাতে চলে এসেছে, তা নিয়ে সংশয় নেই। ইডি, সিবিআইকে কাজে লাগিয়ে মহারাষ্ট্রের মতো আর কোথাও ‘অপারেশন লোটাস’ কার্যকর করা হয় কি না, এখন রাজনৈতিক মহলকে সেদিকে নজর রাখতে হবে।
(মতামত নিজস্ব)