মণিশঙ্কর চৌধুরি, নেলি: নেলি নামটির সঙ্গেই মিশে আছে রক্তাক্ত বিভীষিকা। আট-এর দশক গিয়েছে। রক্তের ছিটেতে পড়েছে ফেলে আসা দিনের পলি। পলির আড়ালে প্রায় ঘুমিয়ে সেসব রক্তাক্ত যন্ত্রণার স্মৃতি। জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে চলতে থাকা চাপানউতোর উসকে দিল সেসব দিনের স্বজন হারানো বেদনা। ৩৫ বছর আগের গণহত্যা কাণ্ডের স্মৃতি ভুলে কেমন আছেন নেলির বাসিন্দারা? একুশ শতকের ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় সংবাদ প্রতিদিনের প্রতিনিধির চোখ দিয়ে একবার ঘুরে দেখা যাক।
[সরকার চাইলে এনআরসি-তে নাম থাকত, অনুযোগ বাংলার মেয়ের]
গুয়াহাটি থেকে ১৩০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিলে উঁকি দেয় নেলি। অসমের মরিগাঁওয়ের অন্তর্গত নেলি প্রায় ‘বাপে খেদানো মায়ে তাড়ানো ছেলে’র মতো। দেখেও দেখে না সরকার এমনই অভিযোগ বাসিন্দাদের। গাড়িতে গুয়াহাটি থেকে নগাঁও যাওয়ার পথে জাগীরোড হয়ে নেলি পৌঁছাতে গেলে নজর কেড়ে নেবে রাস্তার দু’ধারের প্রাকৃতিক শোভা। সবুজে মোড়া পাহাড় যেন প্রকৃতির কোলে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। মন হারাবেই। তবে নেলির কথা মনে আসতেই সোজা হয়ে বসলাম। ৮৩-র রক্তাক্ত স্মৃতি ভুলে থাকা মানুষগুলি কি ফের রক্তাক্ত হল? ছাইপাঁশ ভাবতে ভাবতেই পৌঁছে গিয়েছি নেলিতে। চারিদিকে অপার নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। অদূরেই জলাজমির মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে গ্রামের পথ। খড়ের চালার ভিতরে চায়ের হদিশ পাওয়া গেল। খড়ি ওঠা হাতে দ্রুত চায়ের গ্লাস ধুয়ে নিচ্ছেন বৃদ্ধ দোকানি। পায়ের শব্দে চোখ তুলে তাকালেন। বেশ বোঝা গেল ইঞ্জিনের শব্দে আগেই নজর পড়েছে। সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকতেই ভোগডুবি গ্রামের খোঁজ। প্রশ্ন শুনে ভুরু কুঁচকে বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর ধীরে ধীরে উত্তর এল। সেখানে যেতে পারবেন না। বৃদ্ধের উদাস দৃষ্টি বলে দিল এর বেশি উত্তর পাওয়া যাবে না। অগত্যা চলতে শুরু করা। জলা জমির মাঝ বরাবর পায়ে চলা মাটির রাস্তা বর্ষায় যেন গলে গিয়েছে। গাড়ি দূর অস্ত, হেঁটেই যাওয়া যায় না। সাইকেল নিয়ে নেলিতে আসছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা একরাম আলি। তিনিই বাতলে দিলেন ভোগডুবির রাস্তা। গাড়ি রেখে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলি। দু’কিলোমিটার পথ পেরিয়ে অবশেষে নেলির দেখা মিলল। শহুরে বাসিন্দাদের দেখে ততক্ষণে ইতিউতি ভিড় জমেছে। ছড়িয়ে থাকা খড়ের চালের বাড়ি থেকে উঁকি দিচ্ছে চোখ। ফিরে তাকাতেই মুহূর্তে উধাও। যে কজন সামনে এলেন তাঁদের চোখে অবিশ্বাসের ছোঁয়া।
[বঙাল খেদাওয়ের নামে গণহত্যা অতীত, রক্তাক্ত নেলিতে ভবিষ্যৎ গড়ছেন এই মহিলা]
জাতীয় নাগরিকপঞ্জি নিয়ে প্রশ্ন করতেই প্রায় তেড়ে এলেন ৭৫-র বৃদ্ধ। নেলি গণহত্যার সাক্ষী। দেখেছেন বঙালি খেদানোর নামে অত্যাচার। ভোটাধিকার চেয়ে প্রাণের বিনিময়ে শান্তি ফিরেছে। কিন্তু নিশ্চিন্তের আশ্রয় মেলেনি। মুসলিম প্রধান নেলির বাসিন্দাদের পরণে লুঙ্গি, মুখে দাড়ি দেখলেই এখনও ভেসে আসে গালি। ‘মিঞা’ বলে গালি দেওয়া হয়। আবার দাড়ি শেভ করে যখন শার্ট প্যান্ট পরে রাস্তায় বেরলে ফিরেও দেখে না। উগরে দিলেন ক্ষোভ। এনআরসি ইস্যু নিয়ে রাজ্য উত্তাল হতেই দলেদলে তাঁদের দেখতে নেলিকে দেখতে আসছেন সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিরা। চোখ তুলে তাকাতেই একের পর এক ক্যামেরার শাটার পড়ছে। কত ব্যস্ততা। বার বার জানতে চাইছেন জাতীয় নাগরিকপঞ্জিতে নাম এসেছে কিনা। কিন্তু আসলেই বা। হঠাৎ বেড়ে যাওয়া সাংবাদ মাধ্যমের আনাগোনায় কী সুদিন ফিরবে নেলির। ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় যখন পঞ্চায়েতের তরফে পাকা রাস্তা হচ্ছে, গ্রামে বসছে মোবাইলের টাওয়ার, প্রায় সবার হাতে পৌঁছে গিয়েছে স্মার্ট ফোন। সেই ভারতেই রয়েছে নেলি, যেখানে বিদ্যুতের খুঁটি সেভাবে চোখেই পড়ল না। গাড়ি দেখতে পেয়ে শীর্ণ চেহারার অভুক্ত ভারত যেন দল বেঁধে ছুটে এল। যাদের নিয়ে ভবিষ্যতের আখ্যান লিখবে। স্থানীয় বাসিন্দা মহম্মদ খলিলের নাম এনআরসি-তে এসেছে। তবে গোটা নেলি জাতীয় নাগরিকপঞ্জির আওতাভুক্ত হয়নি। ৮৩-র ভারী বাতাস এখনও হাহুতাশের মতো দীর্ঘশ্বাস ফেলে যায়। বিজেপির বিধায়ক শিলাদিত্য দেবের উসকানি মূলক মন্তব্যে সময়ের পলি সরিয়ে উঁকি দেয় গণহত্যার দগদগে ক্ষত। ৩৫ বছরের পরত ভোলাতে পারেনি যন্ত্রণার স্মৃতি। সেদিনের গণহত্যায় প্রাণ গিয়েছিল নেলির ৯০০ বাসিন্দার। তার মধ্যে ছিলেন মহম্মদ খলিলের আত্মীয়। তৎকালীন কংগ্রেস সরকার মৃতদের পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে দায় সেরেছিল। একবারও খোঁজ নেয়নি, স্বজন হারিয়ে কীভাব চলছে দিন।
সেই ৮৩-তেই আটকে গিয়েছে নেলি। বাইরের পৃথিবী বদলে গেলেও নেলি একই আছে। ন্যূনতম পরিষেবার দূর অস্ত, এখানে নেই ভাল স্কুল, বাজারহাট। গড়ে ওঠেনি হাসপাতাল। একপেটা খেয়ে কখনও অভুক্ত থেকেই দিনগত পাপক্ষয়ে জীবন কাটাচ্ছেন বাসিন্দারা। ফের নাগরিকপঞ্জির প্রকাশ সেই দুঃস্বপ্নকেই জাগিয়ে দিয়েছে। সহানুভূতিকে হাতিয়ার করে চলছে খবর সংগ্রহের পালা। এতে কি আদৌ কোনও লাভ হবে নেলির বাসিন্দাদের? সুদিন ফিরবে নেলিতে? নাকি চিত্রগ্রাহকের ক্যামেরায় মুখ দেখিয়ে বড়সড় বিপদে পড়তে চলেছেন? জানেন না কেউ। বঙাল খেদাওয়ের বিভীষিকা তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। তাই বাসিন্দারা চান না বিপদ বাড়াতে বাইরের লোক গ্রামে আসুক। সংবাদ মাধ্যমের ছবিতে বাসিন্দাদের দূরবস্থা কমবে না। দুয়োরানি নেলি রয়ে যাবে একই জায়গায়। তবে কীসের জন্য এসব? উত্তর নেই। কাদামাখা নেলিকে ফেলে ফের সচল হয় গাড়ির ইঞ্জিন। পশ্চিম আকাশ রাঙা হয়ে তখন সূর্য ডুবছে। কুয়াশামাখা অন্ধকারে ঢাকছে দুয়োরানি নেলি।
The post ‘৮৩ কেড়েছে স্বজন, এনআরসি-র খোঁচায় নয়া আতঙ্কে নেলি appeared first on Sangbad Pratidin.