জাতীয় নাগরিকপঞ্জি তৈরি করে অনুপ্রবেশ ঠেকানোর পথ দেখিয়েছিলেন তিনি। এনিয়ে প্রায় এক দশকের নানা উত্থান-পতনের পর অবশেষে বহু প্রতীক্ষীত তালিকা প্রকাশ এবং অপ্রত্যাশিতভাবে তাতে বিস্তর গলদ। ৩১ আগস্ট এনআরসির চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশের পর থেকেই রাজনৈতিক মতভেদ নির্বিশেষে অসন্তুষ্ট সকলে। চাপা ক্ষোভে ফুটছে অসম। এই পরিস্থিতিতেই এনআরসির মূল প্রস্তাবক অসমের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈকে পাওয়া গেল তাঁর গুয়াহাটির বাড়িতে। সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি প্রাণ খুলে জানালেন নিজের মতামত। শুনলেন মনিশংকর চৌধুরি।
সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালে স্বাগত, নমস্কার। আপনি তো অসম রাজনীতি বহু পর্যায় দেখেছেন। রক্তাক্ত ছয়, সাতের দশক, অল অসম স্টুডেন্টস ইউনিয়নের দাবি, আন্দোলেন। জাতির দলিল বা জাতির রক্ষাকবচ যে এনআরসি আজকে আমরা পেলাম, তা কেমন? কী বলবেন?
– হ্যাঁ, আমরাই আগে থেকে বলেছিলাম, চেয়েছিলাম জাতির দলিল বা রক্ষাকবচ তৈরি হবে, অসমে যে বিদেশি অনুপ্রবেশ নিয়ে সমস্যা ছিল, তা থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। বিদেশিদের নাম বাদ দিতে হবে। আর যারা প্রকৃত ভারতীয় তাদের নাম এনআরসিতে থাকবে। এই পদ্ধতি আমিই শুরু করেছিলাম। ২০০৫ সালে আমিই প্রস্তাব দিয়েছিলাম আসুকে। বলেছিলাম, একটা এনআরসি করা হোক। তাহলে আমরা সিদ্ধান্ত
নিতে পারব। একটা নথিও পাওয়া যাবে। আর কেউ করেনি। এজিপি (অসম গণ পরিষদ) বা বিজেপি করেনি। আমরা প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে ত্রিপাক্ষিক বৈঠক করে এই প্রস্তাব দিই। তারপর পাইলট প্রজেক্ট শুরু হয়। কিন্তু বরপেটায় একটা সমস্যার জন্য তা আটকে যায়। আজ যেভাবে কাজটা করা হল, তাতে আমার মনে হয়, কাজটা নষ্ট হয়েছে। ওরা যখন খসড়া তালিকা প্রকাশ করে ৪০ লক্ষকে বাদ দিয়েছিল, তখনই বলেছিলাম, এতে কাজের কাজ কিছু হবে না।
[ আরও পড়ুন: ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি! শ্রীনগরের রাস্তায় পাকিস্তানপন্থী পোস্টার ]
যেখানে বিজেপি বারবার বলছিল, বিশেষত মন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেছিলেন যে এতে হিন্দু বাঙালিদের স্বার্থ রক্ষিত হবে। কিন্তু এনআরসি তালিকা প্রকাশের পর তা বিজেপির কাছেই বুমেরাং হয়ে এল না কি?
– স্বাভাবিকভাবে বুমেরাং হয়েছে। যে হিন্দু বাঙালিরা ভোট দিয়ে ওদের এনেছিল, তাদের বেশিরভাগের নাম নেই। হিন্দিভাষী, গোর্খা, মুসলিম অনেকেরই নাম নেই। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, এই নাম বাদ যাওয়ার তালিকায় সংখ্যাগুরু অংশই হিন্দু বাঙালি। ওরা আমাকে ভোট দেয়নি। ওরা হিন্দুর নামে ভোট দিয়েছে, আর ওদেরই সবচেয়ে খারাপ করেছে বিজেপি। এখানে হিন্দু বাঙালিরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। যারা ভারতীয় নাগরিক, যাদের নাম ভোটার তালিকায় ছিল, তাদের কারা বিদেশি বলে দেগে দিল?
এখানে একটা কথা আসছে। হিমন্ত বিশ্বশর্মা অভিযোগ করেছেন, রাজনৈতিক স্বার্থে একটা অংশ হিন্দু বাঙালিদের প্রতি কিছুটা বিরাগভাজন।
– হতে পারে, কেউ কেউ মুসলিমদের প্রতি বিরাগভাজন। কারও আবার হিন্দিভাষী বা গোর্খাদের প্রতি বিদ্বেষ আছে। কিন্তু সরকার হিসেবে একটা দায়িত্ব নিতে হবে যে কারা কারা প্রকৃত নাগরিক, তা খুঁজে বের করার। এখানে হিন্দুবিরোধ বা মুসলিম বিদ্বেষ বা খ্রিস্টান বিরোধিতা করলে চলবে না।
আপনার কি মনে হয় যে এই গোটা এনআরসি পদ্ধতি, যেটা প্রতিটি রাজ্যে হওয়া আবশ্যক, তা কোথাও কোথাও ধর্মীয় মেরুকরণের ভিত্তিতে হয়েছে?
– এগুলো কে শুরু করল? ওরা কী বলল? বলল যে, যারা হিন্দু বাঙালি, তাদের ভাবনার কিছু নেই। হিমন্ত বিশ্বশর্মাও তো বললেন যে যারা দুর্গাপুজো, শিবপুজো করেন, তাদের চিন্তা করতে হবে না। এই আশ্বাসটা কে দিল? আর তাদেরই নাম বাদ চলে গেল! আর অমিত শাহই বা কী বলেছিলেন? বলেছিলে, কংগ্রেস নাকি সাহস করে এসব করতে পারেনি। যখন খসড়া প্রকাশিত হয় তখন তো বেশ বলেছিলেন, এরা বিদেশি। ওদের নিজেদের দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। এরা কারা? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীও জানেন না।
১৯৬০এর পর যারা এদেশে এসেছে, বিশেষত হিন্দু বাঙালি, তাদের তো রিফিউজি সার্টিফিকেট দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এনআরসি পদ্ধতি চলাকালীন সেই সার্টিফিকেট গ্রাহ্য হয়নি…
– না, তার দরকার নেই। কারণ, আমরা তো একাত্তরের আগে মানে ১৯৭১এর ২৪ মার্চের আগে যারা এসেছিল, তাদের নাগরিকত্বই দিয়েছি। এটা কেউ দেয়নি। বাংলা দেয়নি, বিহার দেয়নি। কিন্তু একমাত্র অসম দিতে পেরেছে অসম অ্যাকর্ড চুক্তি অনুযায়ী। শুধু হিন্দু বাঙালিদের নয়, সবাইকে নাগরিকত্ব দিয়েছি। মুক্তিযুদ্ধের পর তো বেশিরভাগ হিন্দু বাঙালিই চলে এসেছে। তাদের সবাই নাগরিকত্ব পেয়েছে। এরা কিন্তু আমাদের ভোট দেয়নি। তখনও ওদের জন্য লড়েছি। আর আজও ওরা ভোট দেয় না। তবু লড়ব।
অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ হিসেবে আপনার কি এটা মনে হচ্ছে না যে বর্তমানে ধর্মের ভিত্তিতে যেখানে রাজনীতি চলছে, সেখানে হিন্দুদের থেকে কংগ্রেসের কিছুটা দূরত্ব বেড়ে গিয়েছে?
– হ্যাঁ সেই অভিযোগ তো উঠছেই। আমরা মুসলিম তোষণ করে তাদের ভোটে ক্ষমতায় থেকেছি, এই অভিযোগ তো আমার বিরুদ্ধেই উঠেছে। মোদি এখানে এসে কী বলেছেন? বলেছেন, ‘এখানে লক্ষ লক্ষ মুসলমান আছে, যারা এখানে এসে অসমীয়াদের ভাত কেড়েছে, জমি কেড়েছে, চাকরি কেড়েছে।আমরা ক্ষমতায় আসলে এদের ফেরত পাঠিয়ে দেব।’ এখন কী প্রমাণিত হল? এটাই প্রমাণিত হল যে এদের মুখে হিন্দুত্বের বুলি শুধুই ক্ষমতার জন্য, হিন্দুদের ভালর জন্য নয়। তাহলে ওরা হিন্দুদের চাকরি নিশ্চিত করত। তা পারেনি।
আপনিই একবার বলেছিলেন, ২০১০ সাল পর্যন্ত যারা এখানে এসেছে, তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হোক।
– আমি তো এখনও বলি, ২০১৯ পর্যন্ত যাদের নাম ভোটার তালিকায় আছে, তাদের সবাইকে নাগরিকত্ব দেওয়া হোক। কারণ তারা তো এখানকার নাগরিক। এদের ভোট দেওয়ার অধিকার দিয়েছে ভারতীয় সংবিধান। একদিকে ভোট দেওয়ার অধিকার দিয়েছে, আরেকদিকে ওরা বলছে বিদেশি! এটা তো বড় দ্বন্দ্বের বিষয়।
পরবর্তীকালে আপনি বলেছিলেন, অসমে একটাও বাংলাদেশি নেই…
– না, আমি একথা বলিনি। আমি কিছু অঞ্চলের ভিত্তিতে বলেছিলাম যে ওই নির্দিষ্ট এলাকায় বাংলাদেশি নেই। যদি গোটা রাজ্যে বিদেশি না থাকে, তাহলে আমার সময়ে আমি ফরেনার্স ট্রাইব্যুনাল তৈরি করব কেন? তবে পরবর্তী সময়ে আমাদের রাজ্যে অনুপ্রবেশের সমস্যা কমেছে।
এবার ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের প্রশ্নে আসি। এই মুহূর্তে এখানে ২০০ টি ট্রাইব্যুনাল কাজ করছে। ধাপে ধাপে আরও ১০০০টি তৈরি হবে। কিন্তু আপনার কি মনে হয়, ১৯ লক্ষ মানুষ যে এনআরসি থেকে বাদ পড়েছেন, তাঁদের জন্য এই ট্রাইব্যুনাল পর্যাপ্ত?
– এর আগে আমার একটা প্রশ্ন আছে। ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে কারা যায়? যারা বিদেশি বা যারা সন্দেহভাজন। তাদের নিজেদের পরিচয় নিশ্চিত করার জন্য ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে গিয়ে নথিপত্র পেশ করে। কিন্তু এঁরা কি বিদেশি? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক তো তা বলছে না। তাহলে এরা কেন যাবে ট্রাইব্যুনালে? আমার মতে, তাদের ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে যাওয়া উচিত নয়।
[ আরও পড়ুন: আপাতত তিহার জেল নয়, চিদম্বরমকে আরও তিনদিন সিবিআই হেফাজতের নির্দেশ]
খুবই উল্লেখযোগ্য প্রশ্ন রাখলেন আপনি। আরেকটা বিষয় উঠে আসছে। প্রতীক হাজেলা, এনআরসি কো-অর্ডিনেটর, তাঁর বিরুদ্ধে হোজাইয়ের বিধায়ক শিলাদিত্য দেব অভিযোগ করছেন, বাংলাদেশিদের কাছ থেকে খুনের হুমকি পেয়ে তিনি আতঙ্কে তাঁদের নাম এনআরসিতে তুলে দিয়েছেন।
– তো এই অভিযোগ তাঁরা আগে করলেন না? কেন প্রতীক হাজেলাকে সরিয়ে অন্য কাউকে আনার দাবি তুললেন না? কেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকে আবেদন জানাননি? আমার তো বিধায়ক শিলাদিত্যর কাছে প্রশ্ন যে উনি নিজের এলাকার প্রকৃত ভারতীয়দের নাগরিকত্ব পাইয়ে দিতে তাঁদের নথিপত্র নিয়ে হাজেলার কাছে যাননি কেন? হাজেলা ঠিকমতো নথি হাতে পেলেই তালিকায় নাম তুলবেন।
তার মানে আপনি কি বলতে চাইছেন যে বিজেপির সদিচ্ছা ছিল না?
– না, সদিচ্ছা তো ছিলই না। তারা একবার বলছে এনআরসির কথা, একবার বলছেন নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের কথা। ওরাই চায়নি যে একটা ঠিকঠাক এনআরসি প্রকাশিত হোক। কারণ, ওরা মুসলিমদের তাড়াতে চেয়ে এটা করেছিল। কিন্তু মুসলিমদের নাম থাকল আর বাদ চলে গেল হিন্দুদের নামই। এবার ওদেরই খুঁজে বার করতে হবে, এর জন্য কারা দায়ী।
আমার শেষ প্রশ্ন, এই ১৯ লক্ষ মানুষের জন্য কংগ্রেসের ভূমিকা কী হতে চলেছে?কারণ, ভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসের একটা বড় অবদান আছে।
– তালিকা প্রকাশের ১ঘণ্টার মধ্যে সোনিয়া গান্ধী দিল্লিতে বৈঠক করেছেন। সেখানে দলের শীর্ষ নেতারা সকলেই ছিলেন। নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে আমরা ঠিক করেছি, আমরা প্রকৃত ভারতীয় নাগরিকদের পক্ষে থাকব ধর্ম, ভাষা, জাতি নির্বিশেষে। তাদের সবরকম সাহায্য করতে প্রস্তুত। আমরা নিজেদের অবস্থানে স্থির যে অসম অ্যাকর্ড অনুযায়ী, একাত্তরের ২৪ মার্চের আগে যারা এদেশে এসেছেন, তাদের সবার নাম এনআরসিতে থাকা উচিত।
দেখুন পূর্ণাঙ্গ সাক্ষাৎকার:
The post ‘মুসলিম তাড়াতে চেয়ে এনআরসির পরিকল্পনা বিজেপির কাছে বুমেরাং’, মন্তব্য তরুণ গগৈর appeared first on Sangbad Pratidin.