shono
Advertisement

Breaking News

‘নন্দ ঘোষ’ খোঁজার চেষ্টা

দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে তিনবার নিজের বয়ান বদলেছেন রেলমন্ত্রী।
Posted: 11:24 AM Jun 06, 2023Updated: 11:24 AM Jun 06, 2023

করমণ্ডল দুর্ঘটনার দায় এড়াতে নাশকতা, সিবিআই তদন্তর মোড়ক এবং হিউম‌্যান এররের তত্ত্ব খাড়া করছেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে তিনবার নিজের বয়ান বদলেছেন। কার্যত ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছেন নিরাপত্তাজনিত কাঠামোয় গাফিলতি। ভারতীয় রেলের আসল চেহারা নগ্ন হয়ে যায় এই ধরনের দুর্ঘটনা ও চাপানউতোরে, বারবার। কলমে সুতীর্থ চক্রবর্তী

Advertisement

রমণ্ডল দুর্ঘটনার দায় কে নেবে, তা নিয়ে এখন জল্পনা তুঙ্গে। রেলের নিরাপত্তাজনিত নিয়ম-কানুন সঠিকভাবে পালন করা হয়ে থাকে কি না, সেই প্রশ্ন যাতে আড়ালে চলে যায়, তার জন‌্য প্রাথমিক তদন্তর আগেই সামনে চলে এসেছে নাশকতার তত্ত্ব। রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব বালেশ্বরের বাহানাগা বাজার রেল স্টেশনের দুর্ঘটনাস্থলে টানা ৩৬ ঘণ্টা থেকে দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে তিনবার বয়ান বদল করেছেন। অবশেষে সিবিআই তদন্তর সুপারিশ করে পুরো ঘটনা আপাতত ধামাচাপা দেওয়ার রাস্তা তৈরি করেছেন।

করমণ্ডল দুর্ঘটনার সঙ্গে বারবার জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার তুলনা টানা হচ্ছে। জ্ঞানেশ্বরীতে সিবিআই তদন্তর নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। মাও-জঙ্গি অধ্যুষিত যে-অঞ্চলে জ্ঞানেশ্বরীর দুর্ঘটনা ঘটেছিল এবং সে-সময় ওই অঞ্চলের রাজনৈতিক আবহ যা ছিল, তাতে অন্তর্ঘাতের আশঙ্কা কখনওই উড়িয়ে দেওয়ার ছিল না। জ্ঞানেশ্বরীর দুর্ঘটনায় নাশকতা বা অপরাধমূলক কাজকর্মর যাবতীয় উপাদান হাজির থাকলেও, গত ১২ বছরে সিবিআই কোনও রহস‌্য ভেদ করতে পারেনি। অপরাধমূলক ঘটনার ক্ষেত্রে সিবিআই তদন্ত বাঞ্ছনীয় হলেও, দেখা যাচ্ছে, দুর্ঘটনাতেও তড়িঘড়ি সিবিআই গোয়েন্দাদের টানা হচ্ছে। যার প্রতিবাদে সরব হয়েছে বিরোধী দলগুলি। রেলের যাত্রী নিরাপত্তাজনিত কাঠামোয় গাফিলতি কীভাবে সিবিআই গোয়েন্দারা খুঁজে বের করবেন, প্রশ্ন সেখানেই। ফলে সিবিআই তদন্তর সুপারিশ থেকেই স্পষ্ট, গোটা ঘটনাটিকে একটা রহস্যে মুড়ে আড়াল করাই এই মুহূর্তে সরকারের মূল উদ্দেশ‌্য।

[আরও পড়ুন: করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা ও ‘সেভিং প্রাইভেট রায়ান’]

৩৬ ঘণ্টার মধ্যে করমণ্ডল দুর্ঘটনা নিয়ে যে-রেলমন্ত্রী তিনবার বয়ান বদল করেছেন, তিনি কেন দায় নিয়ে পদত‌্যাগ করবেন না, সেই প্রশ্ন এখন গোটা দেশেই মুখে মুখে ঘুরছে। দুর্ঘটনার পরপরই প্রযুক্তিবিদ রেলমন্ত্রীর প্রথম চেষ্টা ছিল ব‌্যক্তিবিশেষের ঘাড়ে গোটা দায়টা চাপিয়ে দেওয়া। পয়েন্ট ও সিগন‌ালিং ব‌্যবস্থার মধ্যে গন্ডগোলের জেরেই যে করমণ্ডলের দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা এখন জলের মতো স্পষ্ট। আপ লাইনে সিগন‌াল সবুজ দেওয়া থাকলেও করমণ্ডলের পয়েন্ট দেওয়া ছিল লুপ লাইনে। যে-লুপ লাইনে লৌহ আকরিক ভর্তি মালগাড়িটি দাঁড়িয়েছিল। প‌্যানেল ইন্টারলকিং ঠিকঠাক কাজ করলে এই ঘটনা কোনওভাবেই ঘটা সম্ভব নয়। প‌্যানেল ইন্টারলকিং ব‌্যবস্থার মাধ‌্যমে স্টেশন মাস্টার তাঁর ঘরে বসে স্পষ্ট দেখতে পান পয়েন্টের রুট। পয়েন্টের রুট তৈরি হলেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিগন‌াল সবুজ হয়। অর্থাৎ পয়েন্ট ও সিগন‌ালের মধ্যে তালমিলের অভাব থাকার কথা নয়। গোলমাল একমাত্র তখনই ঘটতে পারে, যখন রেলের নিজস্ব স্বয়ংক্রিয় ব‌্যবস্থায় রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের কারণে কোনও ত্রুটি ঘটে। এই ত্রুটি শর্টসার্কিট থেকে হতে পারে, পয়েন্টের সঙ্গে যুক্ত তারের নেটওয়ার্কে কোনও গন্ডগোলের কারণে হতে পারে বা অন‌্য কোনও প্রযুক্তিগত কারণে। প্রযুক্তিগত গন্ডগোলের কারণেই রুট রিলে ব‌্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পয়েন্ট ও সিগন‌ালের তালমিলের অভাব ঘটিয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে ওয়াকিবহাল মহলের ধারণা। সংবাদমাধ‌্যমের বিভিন্ন প্রতিবেদনে তেমনটাই উঠে আসছে।

কিন্তু রেলের তরফে গোড়া থেকেই বিষয়টিতে একটা রহস‌্যর মোড়ক আনার চেষ্টা চলছে। রেল বোর্ডের জনৈক কর্তার সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব রেলের এক ম‌্যানেজারের যে কথোপকথনের অডিও ক্লিপ ফাঁস হয়েছে, তাতে গোড়াতেই উল্লেখ করা হয়েছে, পয়েন্টে যাঁরা কাজ করছিলেন, তাঁদের তরফে কিছু কলকাঠি নাড়া হয়ে থাকতে পারে। গন্ডগোল করা হয়ে থাকতে পারে স্টেশন মাস্টারের ঘরেও। অর্থাৎ, শুরু থেকেই রেলের তরফে যেন একটা ‘নন্দ ঘোষ’ খোঁজার চেষ্টা। রেলের কাজের সঙ্গে যুক্ত অনেকের ধারণা, পয়েন্টের কর্মীরা ট্রেন না থামিয়ে দ্রুত কাজ করে সরে যাওয়ার লক্ষ‌্য নিয়ে হয়তো রিলে ব‌্যবস্থা সাময়িক অকেজো করে রেখেছিলেন। ফলে পয়েন্টের সঠিক তথ‌্য স্টেশন মাস্টারের ঘরে পৌঁছয়নি। কাজ শেষ করার পর পয়েন্ট ঠিক করতে হয়তো ভুলে যান ওই কর্মীরা। এইরকম নানা সম্ভাবনার কথাই ঘুরছে সংবাদমাধ‌্যমে। রেলের সেফটি কমিশনারের তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত কাঠামোগত এই ত্রুটিগুলি জানা সম্ভব নয়। কিন্তু সেই কাজটি শেষ হওয়ার আগেই নাশকতার তকমা লাগিয়ে যেন গোটা ঘটনাটিকে রহস্যে মোড়ার একটা চেষ্টা।

দেখা গেল, দুই রেলকর্তার কথোপকথনে যে-ইঙ্গিতটি মিলেছিল বয়ান বদলে বদলে ঠিক সেই জায়গাতেই এসে দাঁড়ালেন রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব। যান্ত্রিক ত্রুটির সম্ভাবনা প্রায় খারিজ করে প্রথমে তিনি বললেন, মানুষের ভুল। পরে দিনের শেষে চলে গেলেন নাশকতা বা অন্তর্ঘাতের তত্ত্বে। কেন, কী উদ্দেশ্যে এই অন্তর্ঘাত হবে, তার কোনও ব‌্যাখ‌্যা নেই। শুরুতেই যদি অন্তর্ঘাতের তত্ত্ব জুড়ে দেওয়া যায়, তাহলে অন‌্য সব কারণই সহজে আড়ালে চলে যায়। এই দুর্ঘটনার গোড়া থেকেই প্রশ্ন উঠেছে ‘কবচ’ ব‌্যবস্থা কোথায় গেল? ‘অ‌্যান্টি কলিশন ডিভাইস’ তথা ‘এসিডি’ কোথায় গেল? গতবছরই রেলমন্ত্রক তাদের ‘অটোমেটিক ট্রেন প্রোটেকশন’ ব‌্যবস্থা তথা ‘কবচ’ খুব ঢাকঢোল পিটিয়ে চালু করেছিল। বলা হয়েছিল ‘কবচ’ ব‌্যবস্থায় দুই ট্রেনের মধ্যে আর সংঘর্ষের সম্ভাবনা রইল না। একই লাইনে দু’টি ট্রেন চলে এলেও ‘কবচ’ ব‌্যবস্থা সংঘর্ষ ঘটতে দেবে না। ‘কবচ’ ব‌্যবস্থায় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্রেক কষা হবে। করমণ্ডলের দুর্ঘটনায় এতগুলো প্রাণ চলে যাওয়ার পর এখন জানা যাচ্ছে, রেলমন্ত্রকের ‘কবচ’ নিয়ে এই প্রচার ঢক্কানিনাদ ছাড়া কিছুই নয়। দেশে ৬৮ হাজার কিলোমিটারের উপর রেলপথ। কিন্তু, ‘কবচ’ ব‌্যবস্থা নাকি এখনও পর্যন্ত চালু করা গিয়েছে দক্ষিণ-মধ‌্য রেলের মাত্র ১০৯৮ কিলোমিটার পথে। মাত্র ৬৫টি ট্রেন এই ‘কবচ’ ব‌্যবস্থার আওতায় এসেছে। অর্থাৎ, ‌এক শতাংশের সামান‌্য বেশি রাস্তায় ‘কবচ’ চালু করেই রেলের তরফে এমন প্রচার করা হয়েছে, যাতে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে, গোটা রেল ব‌্যবস্থাই সংঘর্ষজনিত দুর্ঘটনা থেকে সুরক্ষিত।

২০১৬-তেই নরেন্দ্র মোদির সরকার ঘোষণা করেছিল রেললাইনের রক্ষণাবেক্ষণ, আধুনিকীকরণ ও পুনর্নবীকরণের জন‌্য সরকার এক লক্ষ কোটি টাকা খরচ করবে। করমণ্ডল দুর্ঘটনার পর জানা যাচ্ছে, গত সাত বছরে হাজার কোটির সামান‌্য বেশি টাকা সরকার খরচ করতে পেরেছে। অর্থাৎ, রেলমন্ত্রকের কাজে এক চরম গাফিলতি। ট্রেনের গতি ও সংখ‌্যা বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে লাইনের রক্ষণাবেক্ষণ ও আধুনিকীকরণের কাজ সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে। ‘কবচ’ ব‌্যবস্থার জন‌্য প্রতি কিলোমিটারে ৫০ লক্ষ টাকা খরচ। প্রধান প্রধান রুটে গুরুত্বপূর্ণ ট্রেনগুলিতে এই ‌ব‌্যবস্থার আওতায় আনতে গেলে অন্তত ৩০ হাজার কিলোমিটার পথে ‘কবচ’ চালু করা প্রয়োজন। রেলের লক্ষ‌্য নাকি সেটাই। অর্থাৎ, এই কাজে আপাতত ১৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করলেই চলবে। কিন্তু, সেটাতেও কেন্দ্রের অনীহা। সেন্ট্রাল ভিস্তায় মোদি সরকার ২০ হাজার কোটি টাকা খরচ করছে। যেটা সাধারণ মানুষের কোনও কাজে লাগবে না। অথচ দেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ যে রেল ব‌্যবস্থার উপর নির্ভরশীল, তাদের নিরাপত্তার জন‌্য দ্রুততার সঙ্গে ১৫ হাজার কোটি টাকা জোগাড় হচ্ছে না।

মোদি লোকসভা ভোটের আগে দেশের ২০০টি শহরকে ‘বন্দে ভারত’ দিয়ে জোড়ার প্রকল্প গ্রহণ করেছেন। একেকটি ‘বন্দে ভারত’ ট্রেন নির্মাণে খরচ হচ্ছে ১১৫ কোটি টাকা। প্রতি সপ্তাহে প্রায় দু’টি করে ‘বন্দে ভারত’ চালু করা হচ্ছে। ‘বন্দে ভারত’ যে ভোটের আগে একটা চমক ছাড়া কিছু নয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। সংবাদমাধ‌্যমে এটাও জানা যাচ্ছে যে, সেদিন লুপ লাইনে যদি লৌহ আকরিক ভর্তি মালগাড়িটি দাঁড়িয়ে নাও থাকত, তাহলেও করমণ্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনায় পড়তে পারত। কারণ, দুর্ঘটনার সময় করমণ্ডলের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১২৮ কিলোমিটার। লুপ লাইনটির এত প্রবল গতির ট্রেন ধারণ করার ক্ষমতাই ছিল না। ফলে করমণ্ডল পয়েন্টের বিভ্রাটে লুপ লাইনে ঢুকে এমনিতেই লাইনচ্যুত হত। করমণ্ডল দুর্ঘটনার পরে ভারতীয় রেলের পরিকাঠামোর যে ছবি সামনে আসছে, তাতে বোঝাই যাচ্ছে, কোটি কোটি যাত্রী প্রতিদিন যে রেলযাত্রা করছে, তার নিরাপত্তা ব‌্যবস্থা কার্যত সরু সুতোয় ঝুলছে। দুর্ঘটনা যে কোনও সময়ই ঘটতে পারে। অথচ গত কয়েক দশক স্রেফ বিজ্ঞাপনী চমক দিতেই রেলের একটা ঝাঁ-চকচকে ছবি তুলে ধরার চেষ্টা হচ্ছে। বুলেট ট্রেন বা বন্দে ভারতের মতো দু’-একটা ট্রেন চালিয়ে দেখানো হচ্ছে ভারতীয় রেল আন্তর্জাতিক স্তরে পৌঁছে গিয়েছে। ভারতীয় রেলের আসল চেহারাটা বেআবরু হয়ে যায় এই ধরনের দুর্ঘটনায়।

সুতরাং, সিবিআই তদন্তর মোড়ক দিয়ে, হিউম‌্যান এররের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করে, নিজের প্রযুক্তিবিদ ও দক্ষ প্রশাসক ভাবমূর্তি দিয়ে অশ্বিনী বৈষ্ণব রেল‌ ব‌্যবস্থার ত্রুটি আড়াল করতে পারবেন না। তাঁকে মানতেই হবে যে, এই দুর্ঘটনার দায় একান্তভাবেই রেল ব‌্যবস্থার। এই ভয়াবহ দুর্ঘটনার দায় নিয়ে আজ না হোক, কাল রেলমন্ত্রীকে পদত‌্যাগ করতেই হবে।

[আরও পড়ুন: হিন্দুত্বের জিগিরে কি চলছে ইতিহাস মোছার চেষ্টা?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement