কুণাল ঘোষ, মাদ্রিদ, মুখ্যমন্ত্রীর সফরসঙ্গী: বোমারু বিমান ধ্বংস করে দিচ্ছে একটা সমৃদ্ধ গ্রাম। নিরীহ নারী, পুরুষ, শিশু কিছু বোঝার আগেই বৃষ্টির মতো বোমা। রক্ত, আর্তনাদ, মৃত্যুর মিছিল, হাহাকার। না, তখন ঠেকানো যায়নি সেই গণহত্যা।একবছর পর শিল্পীর ছবিতে ফুটে উঠল প্রতিবাদ। বিশাল ছবি আঁকলেন পাবলো পিকাসো (Pablo Picasso)। স্পেনীয় শিল্পী আঁকলেন প্যারিসে বসে। চমকে উঠল গোটা বিশ্ব। শিল্পী বলে দিলেন, যতদিন আমার দেশেও হিংসার পূজারীরা ক্ষমতায় ততদিন যেন সেখানে না ঢোকে ছবি।
ক্রমে জেনারেল ফ্রাঙ্কোর মৃত্যু। চিরবিদায় নিলেন পিকাসোও। তারপর স্পেন সরকার দুনিয়া কাঁপানো ছবিটি দেশে আনল। ১৯৯২ থেকে সেটি মাদ্রিদের জাদুঘরের মূল আকর্ষণ। শনিবার বিকেলে যখন দাঁড়িয়েছি সেই ছবির সামনে, মৃত্যুপুরী সেই গ্রামের নামেই ছবি, গুয়েরনিকা, বিশ্বাস করুন, গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। আমি শিল্পবোদ্ধা নই। কিন্তু উত্তর স্পেনের এই গ্রাম ধ্বংসের বিরুদ্ধে পিকাসোর প্রতিবাদী ছবির কথা শুনেছিলাম। শুধু ওই ছবিটি দেখতেই সারাদিন কাজের পর জাদুঘরে যাওয়া। এবং যাওয়া সার্থক।
১৯৩৬/’৩৭-এর কথা। গৃহযুদ্ধে উত্তাল স্পেন। স্পেনের বাহিনীই গুয়েরনিকার সাধারণ মানুষের উপর লেলিয়ে দিয়েছিল জার্মানি আর ইতালির হিংস্র বাহিনীকে। তাদের বিমানবাহিনী শেষ করে দেয় জনপদটিকে। অথচ তার কোনও সামরিক গুরুত্ব ছিল না। পিকাসো তখন প্যারিসে। স্পেনীয় হলেও কৈশোর থেকে ফ্রান্সে। ক্ষিপ্ত হয়ে তিনি ছবি এঁকেই প্রতিবাদ করলেন। রঙিন নয়, সাদা, নীল আর কালোর শেডের ছবি। বিরাট ছবি। স্পষ্ট বোঝা যায় উথালপাথাল।
ছবিতে নারী, আগুন, ঘোড়া, ষাঁড়। বিশেষজ্ঞরা বলেন, হিংসার বিরুদ্ধে বার্তা।
গাইড বললেন, “সারা দুনিয়াতে এনিয়ে কত আলোচনা। কিন্তু পিকাসো নিজে প্রতীক নিয়ে আলোচনা করেননি। যখন প্রশ্ন করা হয়েছে ষাঁড় বা ঘোড়ার ওই চেহারা কীসের প্রতীক, উনি বলতেন, ষাঁড় হল ষাঁড়, আর ঘোড়া হল ঘোড়া। আসলে উনি চাইতেন ছবিটার ভাষা সবাই বুঝুক। সেটা মুখে বলে বোঝাতে হবে কেন?”
[আরও পড়ুন: বার্সেলোনায় প্রবাসী ভারতীয় সম্মেলনে দেশের নেত্রী মমতা]
ছবিটি বহু স্থান ঘুরে এখন রেইনা সোফিয়া জাদুঘরে এসেছে। আসল ভিড়টা এই গুয়েরনিকার সামনেই। ইউরোপের বহু দেশ ঘুরে বহু প্রদর্শনীতে বহু ভালো কাজে অর্থ সংগ্রহ করেছে এটি। এত বড়, তাই এটি নিয়ে ঘোরা সমস্যা ছিল। গোল করে পাকিয়ে নিয়ে ঘুরতে কিছু ক্ষতিও হয়েছিল। এখন সেসব প্রশ্ন নেই। জাদুঘরের পেল্লায় একটা দেওয়ালে একাই বিরাজমান গুয়েরনিকা। এবং অবাক বিস্ময়ে দেখলাম, তার ঠিক উলটোদিকের দেওয়ালে কয়েকটি ছোট ছবি। এই পেল্লায় ছবি আঁকার আগে এর বিভিন্ন অংশ, ঘোড়া, নারী, অস্ত্র, এসবের খসড়া এঁকেছিলেন পিকাসো। সেগুলি সযত্নে, সসম্মানে দুনিয়া কাঁপানো ছবিটির সামনের দেওয়ালে রাখা আছে, এবং তাতেও দারুণ ভিড়।
আসলে ১১ ফুট লম্বা আর সাড়ে ২৫ ফুট চওড়া এই ছবিটি, যতটা না ছবি, তার চেয়ে অনেক বেশি একটি বিশ্বকে নাড়া দেওয়া যুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক বিবৃতি। ছবিটি যখন প্রথম প্রদর্শিত হয়, প্রতিক্রিয়া ছিল মিশ্র। সমালোচনা ছিল বেশ কিছু। পিকাসো তোয়াক্কাও করেননি। কিন্তু এ ছবি যত ঘুরতে শুরু করেছে, ততই কেঁপে উঠেছে দুনিয়া। যুদ্ধের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার হাতিয়ার হয়ে উঠেছে এ ছবি। পিকাসো জীবিত থাকতে দেখে যেতে পারেননি তাঁর অমর সৃষ্টি তাঁর মাতৃভূমিতেই স্থান পাচ্ছে।
এ ছবি একবারে দেখার নয়। এর প্রতিটি অংশ, প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি ভঙ্গি, এমনকী মানুষের পাশাপাশি অন্য প্রাণীগুলিও কিছু বোঝাতে চাইছে। আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়, উজ্জ্বল সিনহা-সহ আমরা কয়েকজন সম্মোহিতের মতো শুনলাম গাইডের ধারাভাষ্য। আর লক্ষ করলাম, শনিবারের পড়ন্ত বেলাতেও যে দেশবিদেশের দর্শকরা আসছেন, জাদুঘর, বলা ভালো সংগ্রহশালায় পা দিয়ে সটান চলে আসছেন গুয়েরনিকার সামনে। এ ছবির চৌম্বকীয় ক্ষমতা আছে।