পদপিষ্ট বা স্ট্যাম্পেডের প্রধান কারণ প্যানিক। বাস্তব বুদ্ধি হারিয়ে দলে দলে মানুষ পরিত্রাণ পেতে চায়, আর নিজ-বিপদ বাড়িয়ে তোলে।
নয়ের দশক। মুম্বইয়ের অন্ধকার জগতের মস্ত বড় ‘ডন’ সিনেমা দেখতে গিয়েছে। ইন্টারভ্যালে বেরল হল থেকে বান্ধবীর সঙ্গে। ঠান্ডা পানীয় খাবে, পপকর্ন কিনবে। ওই দশ-বারো মিনিটের জন্য বেরনোটাই তো আনন্দ। সিনেমা দেখার আসল মজা। এটা-সেটা কিনে তড়িঘড়ি সিটে ফিরে গিয়ে হঁাপ ছেড়ে বঁাচা যে, যাক পরের অর্ধ শুরু হয়নি। তারপর নিজেদের নির্বুুদ্ধিতায় হেসে ওঠা। এই করতে করতেই প্রেক্ষাগৃহের চড়া আলো নেভে, শুরু হয় শো।
কিন্তু সেদিন যা কিছু স্বাভাবিক, তা যেন হওয়ার নয়। কেননা, কুখ্যাত ডনকে সবান্ধব দেখে ফেলল আর-একজন। সে-ও অপরাধী। তবে ছোট মাপের। এই ডনের হাতে সে যারপরনাই বেইজ্জত হয়েছিল অতীতে একবার। এত দিনে এসেছে বদলা নেওয়া দিন। এই ‘ছোট’ মস্তানটি অটো ধরে ছোটে পুলিশ স্টেশন। ডেকে আনে পুলিশকে। খবরে চুক নেই। পুলিশকে এ-যাবৎ ঘোল খাইয়ে আসা প্রবল প্রতাপশালী ডন রয়েছে প্রেক্ষাগৃহের তলপেটে। পুলিশ সারা সিনেমা হল ঘিরে নেয়। ‘এক্সিট’ বা দর্শকদের জন্য বেরিয়ে আসার ‘গেট’ বন্ধ করে দেয়। কেবল একটি খোলা রাখে। তারপর তদন্তকারী অফিসার দর্শকদের অনুরোধ করেন, একে একে বেরিয়ে আসতে। এবার ডন পালাবে কোথায়? তাছাড়া, তাকে শনাক্ত করার জন্য পুলিশের পাশেই দণ্ডায়মান ওই ‘ছোট’ মস্তান।
[আরও পড়ুন: আড়িয়াদহ কাণ্ডে পুলিশের জালে মূল অভিযুক্ত জয়ন্ত সিং, গ্রেপ্তারি না আত্মসমর্পণ, প্রশ্ন বিরোধীদের]
কিন্তু ‘বড়’ ডন প্রমাণ করে দেয়– আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার কদর এমনি-এমনি নয়। সে যেমন বেপরোয়া, তেমনই ঠান্ডা বুদ্ধির। অযথা উদ্বিগ্ন না হয়ে, বান্ধবীকে কিচ্ছুটি বুঝতে না দিয়ে, সে আশপাশের লোকের বাইরে আসার চঞ্চল উন্মাদনাকে কাজে লাগায়। হলের ভিতরেই রিভলভার থেকে ব্ল্যাঙ্ক ফায়ার করে। এরপর যেটা হওয়ার, তা-ই হয়। পুলিশের কথার তোয়াক্কা না করে, কোনও সাবধান বাণী না শুনে, সমবেত জনতা হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসে হল থেকে, আর পদপিষ্ট হতে থাকে। সেই মানুষী হুড়ুমতালে ডন-ও ‘কেটে পড়ে’ অক্ষত, বান্ধবীকে নিয়ে। অপরাধী ধরা দূরে থাক, দায়িত্বে থাকা অফিসার খোদ বিচার বিভাগীয় তদন্তে অপরাধী সাব্যস্ত হন– এত নিরপরাধ প্রাণের মৃত্যুর জন্য, বালকোচিত পদক্ষেপের জন্য।
রামগোপাল ভার্মা ‘সত্য’ থেকে এই কাল্পনিক আখ্যানটি তুলে ধরা হল। যঁারা ‘সত্য’ দেখেছেন, এবং যঁারা দেখেননি, উভয়ই বুঝবেন, পদপিষ্টের ঘটনার অবিসংবাদী কারণটি আকস্মিক উৎকণ্ঠা, প্যানিক। যা মাটিলগ্ন বিষয়বুদ্ধির বিলোপ ঘটায়, মানুষ পরিত্রাণের জন্য এমন পড়িমড়ি ভাব করে যে, হিতে বিপরীত হতে বাধ্য। ঐতিহাসিকভাবে বহু নজির আছে, যেখানে একলপ্তে বিপুল সংখ্যক মানুষ দৌড়ে পালাতে গিয়ে একে-অপরের প্রাণঘাতী সাব্যস্ত হয়েছে। ১৯৯০ সালের ৩ জুলাই, হজের সময়, মক্কায় ১৪০০-র বেশি মানুষ পদপিষ্ট হয়ে মারা যায়। হাথরাসে সদ্য এমনই একটি ঘটনা ঘটেছে। ধর্মের শান্তরস সেখানেও ‘প্যানিক’ জয় করতে পারেনি।