অতুলচন্দ্র নাগ, ডোমকল: বাঙালির খাদ্য তালিকায় সবজির একটি বড় ভূমিকা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় সারা বছরই মেলে বেগুন, কুমড়ো, উচ্ছে, শসা, লঙ্কা প্রভৃতি। তাছাড়া, মরশুমি সবজি হিসাবে পাওয়া যায় ঝিঙে, পটল, লাউ, মুলো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, মটরশুঁটি, গাজর, বিট, গাঁটি কচু ইত্যাদি। তবে এর মধ্যে বেগুন অন্যতম জনপ্রিয়। বেগুন ভাজা কিংবা পোড়া যথেষ্ট উপাদেয়। তাছাড়া, ছ্যাঁচড়া বা পাঁচ মিশালি তরকারিতে বেগুন না দিলে জমে না বা ঠিকমতো স্বাদ খোলে না। আর তাই বাজারে সব সময় এই সবজিটির চাহিদা রয়ে়ছে। কিন্তু নিটোল চকচকে বেগুনের পিছনে লুকিয়ে রয়েছে ভয়ঙ্কর বিষ। এ ধরনের বেগুন পেতে প্রচুর কীটনাশক বিষ রাসায়নিক প্রয়োগ করতে হয়। বেগুনের বাঁকা ডগাওয়ালা ছিদ্রকারী পোকা থেকে বাঁচাতে কৃষি বিষের প্রাচুর্যে প্রকৃত কাজের কীটনাশকটি বাছতে হাবুডুবু খেতে হয় কৃষকদের। ওই কীটনাশক বেগুনের মধ্যে দিয়ে পরোক্ষভাবে মানব শরীরে ঢুকে মারাত্মক ক্ষতি করে।
[পরিকাঠামোর অভাব, চাহিদা থাকলেও থমকে চুনো মাছ চাষ]
বেগুন চাষের কীট পোকা গত কয়েক বছরে কৃষি বিষের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছে। রাসায়নিক বিষ তৈরির কোম্পানিগুলি বেগুনের পোকা ধংস করতে একের পর এক বিষ বাজারে আনছে। কিন্তু কিছুদিন তা কাজ করার পর পোকাদের কাছে সেটি সহনশীল হয়ে যাচ্ছে। তখন মাত্রাতিরিক্ত বিষ প্রয়োগ করেও কোনও কাজ হয় না। অথচ ওই বিষ মানুষের শরীরে প্রভূত ক্ষতি করে। এমনকি, ক্যানসার পর্যন্ত হতে পারে বলে মত চিকিৎসকদের। রাজ্যের কৃষি বিজ্ঞানী অথবা উদ্যান পালন আধিকারিকরা কিন্তু বিষয়টি নিয়ে বসে নেই। চাষের কাজে সুবিধার জন্য প্রতিনিয়ত তাঁরা নতুন নতুন পদ্ধতি আবিষ্কার করে চলেছেন।
[অতিরিক্ত লক্ষ্মীলাভে চাষ করুন ছোলা, জেনে নিন পদ্ধতি]
সম্প্রতি বেগুনের ওই পোকা রোধে আবিষ্কার হয়েছে সোলার সিস্টেমে ফেরোমন ট্রাপ বা ফেরোমেন ফাঁদ। রাতে দশ কাঠা জমির জন্য একটি অথবা এক বিঘা জমিতে দু’টি ফেরোমন ফাঁদ জমির দুই প্রান্তে টাঙিয়ে দেওয়া যায়। এই ফাঁদে পড়ে ওই পোকার বংশবৃদ্ধি রদ করা সম্ভব। সেই সঙ্গে রোজ কীটনাশক স্প্রে না করে সাত বা দশদিন অন্তর কীটনাশক স্প্রে করলেই চলবে। বা কোনও কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই বেগুন ফলানো সম্ভব। এভাবে বেগুন চাষের খরচ যেমন কমবে তেমন রক্ষা পাবে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যাবহার। রক্ষা পাবে মানুষের শরীর। তবে ফোরোমন ফাঁদের ক্ষেত্রে ফানেল ট্র্যাপে পোকা পড়লেও তার পরিমাণ খুব বেশি হয় না। সে জায়গায় অত্যাধুনিক ফানেল ট্র্যাপ হিসেবে বাজারে সহজ প্রযুক্তির সোলার লাইট যুক্ত ট্র্যাপ এসেছে। এতে একটি পলিথিন পাত্রের উপর সোলার সেল যুক্ত আলোর ব্যাবস্থা ও সঙ্গে দু’টি ফেরোমন কিওর থাকছে। ফসলে ক্ষতিকারক কীটগুলি সূর্য ডোবার পরেই আপনা আপনি জ্বলে ওঠে। ওই আলোয় আকৃষ্ট হয়ে পোকার দল এসে সোলার লাইটের নিচে রাখা কেরোসিন বা অল্প কীটনাশক রাখা পাত্রে এসে পড়ে ও মারা যায়। এতে তেমন প্রচুর পরিমাণ বিষের দরকার হয় না। জানা গিয়েছে, এর উদ্ভাবক উত্তর ২৪ পরগনা জেলার সহকারী উদ্যান পালক ডঃ শুভদীপ নাথ। তাঁর আবিষ্কৃত ওই পদ্ধতি উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় জনপ্রিয় হওয়ার পাশাপাশি বর্তমানে তা মুর্শিদাবাদেও ছড়িয়ে পড়েছে। ডোমকলের কৃষক হামিদ বিশ্বাস বলেন, “মুর্শিদাবাদে থাকার সময়েই শুভদীপ নাথের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল। তাঁর পরামর্শে চাষ আবাদ করে আমরা উপকৃত হয়েছি। জেলা থেকে চলে যাওয়ার পরেও তাই এখনও যোগাযোগটা রয়েই গিয়েছে।’’ গত মরশুমে বেগুনের বিষ স্প্রে করা নিয়ে খুব কষ্টে ছিলেন বলেও জানান তিনি।
[মালদহে সফল অস্ট্রেলিয়ান প্রযুক্তিতে চাষ, জেনে নিন পদ্ধতি]
শুভদীপবাবু সোলার সিস্টেম নিয়ন্ত্রিত ফেরোমন ট্র্যাপ প্রসঙ্গে বলেন,‘‘এটি ব্যবহার করে কৃষকরা খুবই উপকৃত হচ্ছেন। চাষের মাঠে ওই পদ্ধতি ব্যবহারের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষকেরা জানান, এ ধরনের পদ্ধতি ব্যবহারে ক্ষতিকারক পোকা ওই আলোর আকর্ষণে ট্র্যাপের কাছে আসছে আর কেরোসিন বা কীটনাশক দেওয়া জলে পড়ে মারা যাচ্ছে।’’ ‘আত্মা’ প্রকল্পের মাধ্যমে মুর্শিদাবাদ জেলার রঘুনাথগঞ্জ এলাকাতেও এই ফাঁদের ব্যাবহার বাড়ছে। উদ্যান পালন দপ্তরের ডেপুটি ডিরেক্টর হৃষিকেশ খাঁড়া জানান, “উত্তর ২৪ পরগনা জেলায় ইতিমধ্যেই সোলার সিস্টেমে ফেরোমন ট্রাপ বা ফেরোমেন ফাঁদ বিষয়টি বেশ জনপ্রিয় হয়েছে। কৃষকেরা ওই পদ্ধতি ব্যবহার করে শুধু বেগুন নয়, অন্যান্য চাষেও পোকা মারতে ও বংশবৃদ্ধি রোধে সফল হচ্ছেন। এতে ফসলে রাসায়নিক বিষ বা কীটনাশকের প্রয়োগের হারও কমছে।”
The post ফসলে পোকা রুখতে কৃষকের ভরসা ‘ফেরোমেন ট্র্যাপ’ appeared first on Sangbad Pratidin.