সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: বিখ্যাত গয়নার দোকানে ডাকাতির ঘটনার তদন্তে বড়সড় সাফল্য পেল রাজ্য পুলিশ। সুদূর বিহারের বেযুর জেলে বসে এই অপরাধ সংগঠিত করা মাস্টারমাইন্ডকে নিজেদের হেফাজতে নিল পুরুলিয়া জেলা পুলিশের সিট। পুরুলিয়া ও রানাঘাটে বিখ্যাত স্বর্ণ বিপণিতে ডাকাতির ঘটনায় প্রায় দেড় মাসের বেশি সময় ধরে তদন্ত চালানোর পর এই সাফল্য মিলল। চলতি মাসের ১৯ তারিখ ধৃত মাস্টারমাইন্ড রবি গুপ্তাকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করে পুরুলিয়া আদালতে তোলা হলেও বুধবার তা সামনে আনে পুলিশ। তার ১৪ দিন পুলিশ হেফাজত হয়েছে। কাজাখস্তান ও আমেরিকায় ব্যবহৃত নম্বরের কোড হোয়াটসঅ্যাপে ব্যবহার করে কথাবার্তা বলত ধৃত। একইভাবে তার সহযোগীরাও বেলজিয়াম, নেদারল্যান্ডসের মতো বিভিন্ন দেশের নম্বর ব্যবহার করে এই অপরাধ সংগঠিত করায় সম্পূর্ণভাবে এই ঘটনার কিনারা করতে সময় লেগে যায় পুলিশের।
পুরুলিয়া জেলা পুলিশের দাবি, এই বেয়ুর জেল দেশজুড়ে বড়সড় সোনার দোকানের ডাকাতির কার্যত আঁতুড়ঘর। পরিকল্পনা থেকে অপারেশনের নির্দেশ এই জেল থেকেই যেত। ধৃত গ্রেপ্তার হওয়ায় বিভিন্ন সোনার দোকানের ডাকাতির নানা তথ্য মিলবে বলে রাজ্য পুলিশের আশা। এই গ্যাং লুটের জিনিসপত্র অন্য দেশের মার্কেটে বিক্রি করত। গত ২৯ আগস্ট শহর পুরুলিয়ার নামোপাড়ায় ওই সোনার দোকানের ডাকাতির ঘটনায় এই মাস্টারমাইন্ড সমেত মোট ৬ জনকে গ্রেপ্তার করে। ওই দিনই পুরুলিয়ার ঘটনার পরেই রানাঘাটেও স্বর্ণ বিপনিতে ডাকাতি হয়। যার গ্যাং ছিল বিহারের বৈশালির। পুরুলিয়ার পুলিশ সুপার অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “বিহার পুলিশ, সেখানকার আদালত সকলের সঙ্গে কথা বলে গয়নার দোকানে লুটের মাস্টারমাইন্ডকে গ্রেপ্তার করে আমরা নিজেদের হেফাজতে নিতে পেরেছি। ধৃত মাস্টারমাইন্ড জেলে বসেই এই অপরাধ সংগঠিত করে। এই কাজ করার জন্য কাজাখস্তান ও আমেরিকার দুটি নম্বরের সাহায্যে তার হোয়াটসঅ্যাপ সক্রিয় করে। যা ধৃতের কাছ থেকে পাওয়া গিয়েছে।”
[আরও পড়ুন: ‘১০০ দিনের কাজের টাকা ফেরান’, রাজ্যপালের দেওয়া দুর্গারত্ন ফেরাল কল্যাণীর লুমিনাস ক্লাব]
ধৃতের বাড়ি বিহারের আলমগঞ্জে। ৩৮ বছর বয়সি দুষ্কৃতি ২০০২ সাল থেকে ওই জেলেই রয়েছে। মাঝে মধ্যে ছাড়া পেলেও ওই জেলই তার ‘দ্বিতীয় ঘর’ হয়ে গিয়েছে। ধৃতের সঙ্গে আরও কয়েকজন সহযোগী রয়েছে। তাদের খোঁজে এখনও বিহার ও ঝাড়খণ্ডে টিম রয়েছে পুরুলিয়া জেলা পুলিশের। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, এই ধৃতের অধীনে প্রায় ৭০০ জন দুষ্কৃতী কাজ করে। একেবারে কর্পোরেট কোম্পানির ধাঁচে জেলে বসেই এই কারবার চালাত ধৃত রবি। কোন অপারেশনে কাকে পাঠানো হবে, কোন অপরাধের জন্য কে লিড করবে তা সবকিছু জেলে বসেই ঠিক করে দিত। এক একটি অপরাধ সংগঠিত করার জন্য কোথা থেকে বাইক যাবে, আশ্রয়স্থল কোথায় হবে, কোন আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হবে, কোথা থেকে কার হাতে কোন অস্ত্র যাবে, এই কাজের জন্য টাকাপয়সা কীভাবে দেওয়া হবে তার নকশা জেলে বসেই সাজিয়ে আসছিল রবি।
যারা অপারেশন করবে তাদের মোবাইলে লোকেশনের লিঙ্ক পর্যন্ত দিয়ে দিত। ধৃতের অধীনে যে ছেলেরা কাজ করত তারা কোনও কারণে ধরা পড়ে গেলে তাদের জামিন-সহ আদালতের সমস্ত খরচ বহন করত রবির ‘কর্পোরেট গ্যাং’। এই ধরনের অপারেশন চালাতে গিয়ে কোন কারণে কারও মৃত্যু হয়ে গেলে তার পরিবারকে ১৫ লক্ষ টাকা পর্যন্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয়ে থাকে বলে ধৃতকে জেরা করে জানা গিয়েছে। যাতে অপরাধের বিষয়ে কোনভাবেই কেউ মুখ না খোলে। ধৃতের অধীনে প্রায় ৭০০-র মতো দুষ্কৃতী কাজ করলেও তারা একে অপরকে সেভাবে চেনে না। এতটাই গোপনীয়ভাবে কাজ হয়, যাতে কেউ গ্রেপ্তার হলেও অপরাধের লম্বা শৃঙ্খল কোনভাবেই পুলিশের সামনে না আসে। কিন্তু বিখ্যাত গয়নার দোকানে লুটের ঘটনা এই ‘কর্পোরেট গ্যাং’য়ের কার্যকলাপ অনেকাংশেই সামনে এনে দিল।