অর্ণব আইচ: ঈশ্বরকে নিবেদন করা টাকা ফিরে গেল ‘ঈশ্বরের’ কাছেই। বিলীন হয়ে গেল প্রকৃতির পঞ্চভূতে।
জৈন মন্দিরের প্রণামীর নষ্ট হয়ে যাওয়া কয়েক হাজার টাকার নোট বস্তাবন্দি করে রিজার্ভ ব্যাংকে জমা দেওয়ার জন্য রাখা হয়েছিল। ভুল করে ফুলের সঙ্গে সেই নষ্ট হয়ে যাওয়া টাকার বস্তাও মন্দিরের এক কর্মী তুলে দেন বাঁধাধরা রিকশাচালকের হাতে। রাজেন্দ্র সাউ নামে ওই বিশ্বস্ত রিকশাচালক আদিগঙ্গার ঘাটে ফুলের সঙ্গে হেলায় বিসর্জন দেন সেই খাজানা। এবং খরখরে শুকনো নোটে কেউ জ্বলন্ত ধূপ অথবা সিগারেট ফেলতেই আগুন। বেশিরভাগ নোট আধপোড়া হয়ে যায়।
রবিবার বিকেলে কালীঘাটের মুখার্জী ঘাটে পোড়া নোটের (Currency) রহস্যের অবশেষে যবনিকাপতন। ১০, ২০, ৫০, ১০০, এমনকী ৫০০ টাকার গুচ্ছের আধপোড়া নোট থেকে অক্ষত নোট খোঁজার জন্য মানুষের ঢল নেমেছিল। হুড়োহুড়ি শুরু হয়। ঘটনাস্থলে কালীঘাট থানার পুলিশ গিয়ে নোটগুলি উদ্ধার করে। রহস্য উন্মোচন হয় পুলিশ রিকশাচালকের সন্ধান পাওয়ার পর। মুখার্জি ঘাটের গায়েই রাধাকৃষ্ণের মন্দির। সেখানকার পূজারি গোপাল মিশ্র জানান, ভবানীপুরের হেশ্যাম রোডের একটি জৈন মন্দিরের রিকশাচালক গত ২০ বছর ধরেই দিনে দু’বার করে এই ঘাটে এসে বাসি ফুল ও জল গঙ্গায় বিসর্জন দেন। সূত্রের খবর, সিসিটিভির ফুটেজে ওই রিকশা চালককে দেখে তাঁর সন্ধান পায় পুলিশ। রবিবার রাতে তাঁকে নিয়ে পুলিশ মুখার্জি ঘাটে যায়। তিনি পুলিশ আধিকারিকদের দেখান, কীভাবে ঈশ্বরকে নিবেদন করা ফুল ও টাকা তিনি গঙ্গার ঘাটে ফেলেছেন।
রবিবার বিকেলে হেশ্যাম রোডের ‘শ্রী ভবানীপুর মূর্তিপূজক জৈন শ্বেতাম্বর সংঘ’র অফিসের আধিকারিক পঙ্কজ দোশির কাছে কালীঘাট (Kalighat) থানা থেকে ফোন আসে। তাঁর কাছ থেকে টাকা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। সোমবার পঙ্কজবাবু জানান, এই জৈন মন্দিরে পার্শ্বনাথ ও অন্য তীর্থঙ্করদের মূর্তি প্রচুর ফুল দিয়ে পুজো করা হয়। পুজোর সময় মূর্তি স্নান করানো হয়। স্নানের জল ও পুজোর ফুল ফেলা হয় আদিগঙ্গায়। মন্দিরের একতলা ও দোতলায় রয়েছে আলাদা প্রণামীর বাক্স। ভক্তরা এসে টাকা ফেলেন প্রণামীর বাক্সে। দু’টি বাক্সেই জমছিল টাকা।
[আরও পড়ুন: স্বচ্ছ ভারতের দফারফা, হাওড়া স্টেশনে ট্রেনের গায়ে প্রস্রাব খোদ গার্ডের]
করোনা আবহে লকডাউনে গত মার্চ মাস থেকে বন্ধ হয়ে যায় মন্দির। ওই সময় মাত্র তিনজন কর্মী ছিলেন মন্দিরে। গত মে মাসে আসে আমফান। প্রচণ্ড ঝড় ও জলের ঝাপটায় নাস্তানাবুদ হয়ে পড়েন সবাই। প্রণামীর বাক্সর দিকে নজর ছিল না কারও। তার মধ্যেই রাস্তার জমা জল ঢুকতে শুরু করে মন্দিরের ভিতরে। ভিজে চুপচুপে প্রণামীর বাক্স। ক্রমে তা শুকিয়েও যায়। আরও টাকা জমতে শুরু করে বাক্স দু’টিতে। কিছুদিন আগে ট্রাস্টির সদস্যরা বাক্স দু’টি খোলার পরই তাঁদের চক্ষু চড়কগাছে। বাক্সগুলির উপরের দিকের টাকাগুলি ভাল অবস্থায় থাকলেও নষ্ট হয়ে গিয়েছে নিচের দিকে রাখা প্রণামীর টাকা। বাছাই করে ‘নষ্ট’ হয়ে যাওয়া নোটগুলি আলাদা করে ফেলে একটি বস্তায় রাখা হয়। সেগুলি রিজার্ভ ব্যাংকে নিয়ে গিয়ে পালটানোর পরিকল্পনা ছিল ট্রাস্টিদের। কিন্তু সময় পাচ্ছিলেন না। তাই বস্তাটি একটি জায়গায় রেখে দেওয়া হয়েছিল।
রবিবার দুপুরে দ্বিতীয় পর্যায়ে পুজোর বাসি ফুল প্যাকেট বোঝাই করে রেখে দেন এক কর্মী। সেই প্যাকেটের পাশেই ছিল ‘নষ্ট’ হওয়া টাকার বস্তা। প্রৌঢ় রিকশাচালক রাজেন্দ্র ফুল মনে করে টাকার বস্তাটিও রিকশায় রাখেন। তার সঙ্গে স্নানের জল। হেশ্যাম রোড থেকে মুখার্জি ঘাটে গিয়ে বস্তা থেকে ফুল ও টাকা বের করে ফেলে দেন। পুলিশের ধারণা, আশপাশের বাড়ি থেকে ওই টাকায় কেউ জ্বলন্ত ধূপ অথবা সিগারেট ফেলেছিলেন। তা থেকেই ধরে যায় আগুন। পুড়ে যায় কয়েক হাজার টাকার নোট। এত কাণ্ডের পর রাজেন্দ্র অবশ্য নির্বিকার। সোমবার সকালেও যথারীতি ঘাটে এসে ফুল-মালা ফেলে গিয়েছেন। তবে বিকেলে একটু সতর্ক হয়ে পুরসভার ডাস্টবিনেই ফেলেন।