উর্মি খাসনবিশ: কেউ বলছেন বিক্রি হয়েছেন রাজনীতিবিদ। আর কেউ বলছেন মতি ফিরেছে। মতাদর্শ আর মতি কি এত সস্তা? যে নিমেষের মধ্যে পরিবর্তিত হয়ে যাবে? উত্তর খুঁজলেন উর্মি খাসনবিশ।
হারাধনের তিনটি ছেলে ধরতে গেল রুই,
একটি খেল বোয়াল মাছে রইল বাকি দুই।
কবিদের ভাবনা দেখে অবাক হয়ে যাই মাঝে মধ্যে। মনে হয় মনের সব কথা লিখে রেখে গিয়েছেন সিম্বলের আড়ালে। হারাধনের তিন ছেলে না কি রুই ধরতে গিয়েছিল। আর একজনকে না কি খেয়ে ফেলেছে বোয়াল মাছে। ভাবা যায়? মজার বিষয়! একজন জেলায় গড় তৈরি করতে মগ্ন অথচ অন্যজন তাঁকে কাঁচকলা দেখিয়ে আম, আঁটি সব নিয়ে ভ্যানিশ। প্রাথমিকভাবে ভেবেও খারাপ লাগে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে ভাবার প্রচেষ্টাটাও বাড়ে কি না! তাই নিজেকে অপরের জায়গায় বসিয়ে ভাবতে চেষ্টা করি, আসলে কার ভুল ছিল! কে ভুল করছেন! আর ভুলের ফল ঠিক কী হতে পারে? এসব ভেবে যখন মোটামুটি অস্থির, তখন প্রকাশ ঝা’র ‘রাজনীতি’ ছবিটির ডায়লগ মনে পড়ে! ‘রাজনীতি মে অন্দর কি জানওয়ার বাহার আ যাতি হ্যায়’! এবার রাজনীতিতে কার অন্তরের সযত্নে লালিত জন্তু কতটা তীব্র ভাবে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বাইরে বেরিয়ে আসে সে প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নেই।
আসলে রাজনীতি ব্যাপারটাই মনে হয় এরকম। রাজ্য রাজনীতির কথাই ভেবে দেখুন! আজ হয়তো হারাধনের ১০টি ছেলেই ভীষণভাবে রয়েছেন। কিন্তু কাল হয়তো থাকবেন না একজনও। এই দেখুন না, মে মাসেই তো হয়েছিল বিধানসভা নির্বাচন। হারাধনের যে অনেক ছেলেই তখন জীবিত ছিল সে তো জানেন আপনিও! নইলে প্রধান বিরোধী দলের শিরোপা পাওয়া চাট্টিখানি কথা! কিন্তু ওই যে, যাকে বলে ভাগ্যের ফের! এখন ক’টি ছেলে বাঁচে তা দেখার অপেক্ষাতেই যেন দিন গুনছে কংগ্রেস শিবির।
প্রশ্ন উঠতে পারে, ‘বাঁচে’ মানেটা কী? খবরে তো কোনও কংগ্রেস বিধায়কের মৃত্যুর খবর নেই। তাহলে বাঁচা আর মরার প্রশ্ন আসছে কোথা থেকে? উল্টে আপনার কাছেই প্রশ্ন রাখি, কেবল হৃদযন্ত্রের বন্ধ হয়ে যাওয়া কিংবা শ্বাস-প্রশ্বাস না নেওয়াকেই মৃত্যু বলে মানেন এখনও? শিরদাঁড়া ম্যাটার করে না?
গত চার মাসে, অর্থাৎ বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক পর থেকেই একের পর এক বিধায়ক কংগ্রেস ছেড়ে যোগ দিচ্ছেন তৃণমূলে! তাও যদি ফুটেজ না পাওয়া নেতারা হতেন শুধু, মানতাম। আমার মতে, এমন রাজনৈতিক নেতারাও দলত্যাগ করেছেন, যাঁদের নতুন করে নিজেদের পরিচিতি তৈরি করার প্রয়োজন নেই। তাঁরাও নিমেষে ইডিওলজি জলাঞ্জলি দিয়ে দল ছাড়লেন।
এঁদের এই রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত দেখে নিজের ইউনিভার্সিটির দিনগুলি মনে পরে যায়। প্রথম প্রথম সেখানে যখন জুনিয়রদের সিটিং দেওয়ার জন্য সিনিয়ররা একদম মুখিয়ে থাকতেন, তখন এক সিনিয়র খুব হালকা চালে বলেছিলেন, “শোন বাচ্চা, যে ব্রেনকে ওয়াশ করা যায়, সেই ব্রেনওয়াশ আমি অন্তত করব না।” তখন কথার আগা-মাথা কিছু বুঝিনি! পরে অনুভব করেছিলাম! বুঝেছিলাম রাজনীতি করতে গেলে নিজস্ব মৌলিক একটা বিচার-বিবেচনাবোধ থাকা দরকার। তারপর আসে ইডিওলজি। বিচার-বিবেচনা না থাকলে ইডিওলজি বিকিয়ে যাবে নিমেষে।
বর্তমানে একাধিক কংগ্রেস এবং বামফ্রন্টের সদস্যরা সরকারে যোগ দিচ্ছেন। সরকারি দল বলছে, এই ব্যক্তিদের মতি ফিরে এসেছ, আর বিরোধীরা বলছে বিক্রি হয়েছে। ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, মতি এবং ইডিওলজি দুটোর একটাও অত সস্তা নয় যে মুহূর্তের মধ্যে আসবে এবং চলে যাবে। আর যদি এত সস্তাই হয়, তবে কতটা টেকসই হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে মতি ফেরা এবং বিক্রি হওয়ার যে তরজা চলছে সেই প্রসঙ্গে দুটি রেফারেন্স খুব স্ট্রংলি মনে পরে।
এক, ২০১১ সালের আগে অবধি রাজ্যের বেশিরভাগ মানুষ বামপন্থায় বিশ্বাসী বলেই মনে করা হত। মনে আছে, বাড়িতে কাজ করতে আসা মাসিও বলতেন, ‘ছিপিএময়ের মিছিলে হাঁটবো, ছিপিয়েমকে ভোট দেব’। মাসি মার্কসবাদ সম্পর্কে কতটা অবগত ছিলেন জানি না। তবে ২০১১ সালের পর থেকে তিনি তৃণমূলের মিছিলে যান। বলেন ‘তৃণমূলকে ভোট দেব’। কেন বলেন জানি না। মাসির কি নতুন ইডিওলজি তৈরি হয়েছে? তাও জানি না! মাসির মতি ফিরে এসেছে কিনাও সঠিক জানা নেই। তবে মানুষের কথা, মিছিলে হাঁটা, দলবদলের রাজনীতি বা পিঠ বাঁচানোর তীব্র চেষ্টা আর ব্যালটে বোতাম টিপে চুপচাপ বাড়ি চলে যাওয়া যে এক স্রোতে বয় না, তার জোড়ালো প্রমাণ ২০১১।
আর দুই, এই পরিস্থিতিতে প্রবীণ বামপন্থী নেতা সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। ভদ্রলোককে দল থেকে বহিস্কার করা হয়েছিল। কিন্তু আশ্চর্যভাবে এরপরেও তিনি নিজের ইডিওলজি ছেড়ে অন্য দলে যোগ দেননি। আর অন্যভাবে বলতে গেলে অপর কোনও রাজনৈতিক দল ওঁর মতি পর্যন্ত ফেরাতে পারেনি।
মোটের উপর রাজনীতিতে মতি ফেরা বা ইডিওলজি খোয়ানোর মতো ব্যাপার হরদম ঘটছে। এটা কতটা জন্তুসুলভ তা বিচার্য বিষয়। কিন্তু ছোটবেলা থেকে একটা জিনিস মা শেখাতেন। যা সত্য, ধ্রুব, তা সহজে মেলে না। আর কঠোর সাধনার পর যদি একবার তা পাওয়া যায়, তাকে বর্জন করা কঠিন। পলিটিকাল ইডিওলজি ও মানুষের মতিও খানিক সেরকম। স্থির করা কঠিন। আর বর্জন করা আরও কঠিন। তাই সহজে এই দুই বিষয়কে যেমন হ্যালাছেদ্দা করে একবার ধরা হচ্ছে আর একবার ছুঁড়ে ফেলা হচ্ছে, তখন দুঁদে রাজনীতিবিদদের এই দুই মহামূল্য বিষয়ের নৈতিক অবস্থান ঠিক কী তা নিয়ে মুখ খুলতেও অস্বস্তি হচ্ছে!
The post কংগ্রেসের এখন হারাধনের দশা! appeared first on Sangbad Pratidin.