বোরিয়া মজুমদার: ‘ভাল লাগছে না রে তোপসে’– ‘সোনার কেল্লা’য় যোধপুরের সার্কিট হাউসে ফেলুদার সেই অমর উক্তি কে ভুলতে পারে? আর এক সপ্তাহের মধ্যেই ফেলুদার সৃষ্টিকর্তার শততম জন্মদিন আমরা উদ্যাপন করতে চলেছি। এই সময় প্রতি মুহূর্তে, আমাদের প্রত্যেকের আশপাশে ফেলুদার বলা এই কথাগুলো যেন সত্য হয়ে অনুরণিত হচ্ছে। কোনও আত্মীয় বা বন্ধুর নম্বর মোবাইলে ভেসে উঠলেই আজকাল মনে আতঙ্ক দানা বাঁধে। কারও হয়তো হাসপাতালের বেড, কোনও নির্দিষ্ট ইঞ্জেকশন বা অক্সিজেনের প্রয়োজন। আপনি যখন অনুভব করবেন, বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তাদের সাহায্য করতে আপনি অক্ষম–বিষাদ আর হতাশার মোড়কে অসহায়ত্বের এক অদ্ভুত অনুভূতি আপনাকে কামড়ে ধরবে। শীর্ষস্থানীয় ডাক্তারদের সঙ্গে কথা বললে অসহায়ত্ব যেন আরও বেড়ে যাচ্ছে। তাঁরা দিনে ২০ ঘণ্টা অক্লান্ত পরিশ্রম করার পরেও, প্রতি মুহূর্তে, মৃত্যুর মিছিল চলছে তো চলছেই। সমাজের অংশ হিসাবে আমরা ব্যর্থ, আমরা ব্যর্থ জনসমষ্টি হিসাবে। আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের এবং নির্বাচন কমিশনের (Election commissioner) প্রশাসনিক সংস্থাগুলিকে এই সর্বনাশের দায় বিবেকে বহন করতে হবে চিরকাল।
গত সপ্তাহে আমার সঙ্গে উডল্যান্ডস হাসপাতালের সিইও রূপালী বসুর দেখা হয়েছিল। তিনি একজন দুর্দান্ত প্রশাসক। বর্তমানে যা পরিকাঠামো রয়েছে, তা আরও উন্নত করার জন্য যা যা করার তিনি করে চলেছেন। তাঁর মতো দক্ষ প্রশাসকও এই ভয়ংকর চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড়িয়ে রীতিমতো হতাশ। তিনি বলছেন, ‘এমন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়তো আমরা হইনি কোনও দিন!’
এই বিপর্যয় মানুষের সৃষ্টি করা। একটা বছর আমরা সময় পেয়েছিলাম প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ কীভাবে আছড়ে পড়ল, তা আমরা দেখলাম, আমরা জানতাম, ভারতে সেকেন্ড ওয়েভ আসা শুধু সময়ের অপেক্ষা। তবুও আমরা নির্বাচনী প্রচার চালিয়ে গিয়েছি মহানন্দে, স্লোগান-গান বেঁধেছি, একে অপরকে অশ্রাব্য গালিগালাজ করেছি এবং সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের সলতেয় আগুন ধরিয়েছি। আমরা প্রত্যেকে খরগোশের মতো আচরণ করলাম। চোখ বন্ধ করে ভেবে নিলাম, আমাদের আশপাশের পৃথিবী কোভিড-মুক্ত। এখন যখন মারণ ভাইরাস দ্বিতীয়বার আছড়ে পড়েছে, তখন আমাদের সেই চোখ দিয়েই অনর্গল নামছে অশ্রুধারা। চারপাশের সারি সারি মৃত্যুর সাক্ষী হচ্ছি আমরা।
[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: অভিষেকের শাপে বর]
বিশ্বাস করুন, আমাদের রাগ হচ্ছে। সমবেতভাবে আমরা ক্ষুব্ধ। এই রেগে যাওয়া কিন্তু নাগরিক সমাজের বৃহত্তম শক্তি। এবার সময় এসেছে নিজেদের রাস্তা বেছে নেওয়ার। কিছু কিছু মানুষের থেকে জবাবদিহি চাওয়ার সময় এসে গিয়েছে, সময় এসেছে নিজেদের অধিকারের জন্য সোচ্চার হওয়ার।
এর পাশাপাশি একবার আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকে জিজ্ঞাসা করুন তো, আপনি কি নিজের ভূমিকা পালন করেছেন, ঠিক যেভাবে করা উচিত ছিল? উত্তর আসবে, না। আমি আমার প্রচুর বন্ধু এবং সহকর্মীকে দেখেছি বাইরে বেরনোর সময় অভিনব ডিজাইনার মাস্ক পরতে। পোশাকের রঙের সঙ্গে মিলিয়ে মাস্কও পরছেন অনেকে। সহজ বিজ্ঞান বলে, এই জাতীয় মাস্ক অকেজো। আমাদের বুঝতে হবে মাস্ক ব্যবহার করা হচ্ছে সুরক্ষার জন্য, এই অতিমারীর সময়ে এটা কোনও ‘স্টাইল স্টেটমেন্ট’ হতে পারে না। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা খরচ করে একটা সিগারেট খেতে আমাদের গায়ে লাগে না, অথচ কিছু টাকা খরচ করে এন৯৫ মাস্ক কিনতে আমাদের দ্বিধা হয়। আমরা ইন্টারনেটে সিনেমা দেখার জন্য কয়েকশো টাকা রিচার্জ করতে পারি, কিন্তু সমমূল্যের এন৯৫ মাস্ক, যা কিনা আমাদের মারণ ভাইরাসের হাত থেকে রক্ষা করবে– তা কিনতে আমরা নারাজ। অথচ আমরা জানি যে, তা আমাদের মাসের পর মাস সুরক্ষা জোগাবে। আমরা ভাইরাস প্রতিরোধ করার মতো শক্তিশালী নই– এই বাস্তববোধ যত তাড়াতাড়ি আমাদের হবে, আমাদের সমাজ তত তাড়াতাড়ি উপকৃত হবে।
চারদিকের এত অন্ধকারেও কোথাও কোথাও উঁকি দিচ্ছে আশার আলো। ইজরায়েলের দিকে তাকান। তাকান ইউনাইটেড কিংডমের দিকে। আমি মনোযোগ সহকারে ওদের কেস স্টাডি অনুসরণ করেছি, আমি আপনাদের যথেষ্ট দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারি, এই দেশগুলিতে মারণ ভাইরাসের আস্ফালনের দিন অতীত হতে চলেছে। সবচেয়ে ইতিবাচক খবর হল, ভ্যাকসিন কাজ করছে এবং তা সুরক্ষা জোগাতে সক্ষম, তা সে ভাইরাসের যে কোনও মিউট্যান্ট-ই হোক না কেন। ইজরায়েলিরা কীভাবে আনন্দে মেতে উঠেছে দেখুন! দেখুন, মাত্র কয়েক মাসের মধ্যে ইউকে-র হাসপাতালে কোভিড আক্রান্তের সংখ্যা কত কমে এসেছে।
কীভাবে হল এসব? উত্তর একটা, টিকাকরণ। আমরা যত দ্রুত টিকাকরণ করতে সক্ষম হব, তত দ্রুত আমরা কোভিডকে শক্ত হাতে মোকাবিলা করতে পারব। তবে ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সতর্ক থাকতে হবে, যথাযথ আচরণ করে যেতে হবে। আমাদের এন-৯৫ মাস্ক পরতে হবে, কারণ কোভিড মোকাবিলায় এটি কার্যকর, সঙ্গে প্রয়োজন শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখা এবং ঘন ঘন হাত সাবান দিয়ে ধোয়া। আমি অবাক হয়ে যাই, যখন দেখি মানুষ মোটা টাকা খরচ করে ইমিউনিটি বুস্টার কিনছে, কিন্তু এন৯৫ মাস্ক কিনতে তাদের অনীহা। ইমিউনিটি বুস্টার কি ভাইরাসের হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে পারবেই পারবে? মাস্ক কিন্তু পারে। তাই আমাদের প্রতে্যককে নিজেদের ভূমিকা পালন করতে হবে। কোভিড প্রোটোকল মেনে চলতে হবে, এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভ্যাকসিন নিতে হবে।
[আরও পড়ুন: সম্পাদকীয়: টিকাদান চালিয়ে যেতেই হবে]
ইতিহাস সাক্ষী, যে কোনও মহামারীর ‘দ্বিতীয় ঢেউ’ সবসময় প্রথমের চেয়ে বেশি নির্মম। এবারও তার ব্যতিক্রম নয়। আমাদের এই অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাদের প্রকৃতির যত্ন নিতে হবে। পাশাপাশি নিশ্চিত করতে হবে যাতে আমাদের অর্থনীতিতে স্বাস্থ্য অগ্রাধিকার পায়। আমি যেহেতু চিকিৎসক ও নার্সদের সঙ্গে কথা বলি, আমি কেবল এই ভেবেই শিউরে উঠি, চোখের সামনে অগণিত মানুষকে মারা যেতে দেখে তাঁদের কী অনুভূতি হয়!
অতীতের কথা এখন থাক। কোভিডকেও যে জয় করা যেতে পারে, তা সংযুক্ত আরব আমিরশাহী, ইজরায়েল এবং অন্যান্য দেশের দিকে তাকালেই স্পষ্ট বোঝা যায়। আমরাও যদি ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকি, তাহলে আগামী কয়েক মাসে ভারতেও সুদিন আসবে। যদি এরপরও আমাদের দেশের নেতারা একে-অপরকে দোষারোপ করা চালিয়ে যান, তবে আমরা সমাজ হিসাবে ব্যর্থ হব। অন্তত এবার রাজনীতি নয়, আসল অগ্রাধিকার পাক দেশের মানুষ।
আসুন, আমাদের মধ্যে যাদের সামর্থ্য রয়েছে, তারা প্রত্যেক অন্তত ২০ জনকে টিকা দেওয়ার ভার নিই। এটা কোনও বড় বিষয় নয়। এই কয়েক হাজার টাকা ব্যয় করার ক্ষমতা আমাদের মধে্য অনেকের রয়েছে। যদি প্রত্যেকে উঠে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিই, তবে কিছুদিনের মধ্যেই একটা জনগোষ্ঠী তৈরি হবে, এবং এর ফলে হাজার হাজার মানুষের টিকাকরণ সম্পূর্ণ হবে। কারণ ভ্যাকসিনই একমাত্র উত্তর এবং তা এখন প্রমাণিত। দু’বার টিকা নেওয়া কেউ অকালে কোভিড-আক্রান্ত হয়ে মারা যাবেন না – এটাই এক বছরে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় সাফল্য।
এই পরিস্থিতিতে আমাদের সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ধৈর্য। কোভিড (COVID-19) সংক্রমণের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলার জন্য আমাদের সবাইকে একজোট হয়ে আগামী কয়েক সপ্তাহের জন্য উপযুক্ত আচরণবিধি মেনে চলতে হবে। আমরা এখন শত্রুকে চিনি। আমরা জানি ভাইরাসের ক্ষমতা। আমাদের কাছে ওষুধ রয়েছে। রয়েছে প্রতিষেধক। আমরা কোভিডের সামনে দুর্বল নই। কেবল এই লড়াইয়ে আমাদের বিচক্ষণ হতে হবে। আমরা লাগাতার সমাবেশ, কুম্ভমেলা এবং আরও অন্যান্য উৎসবে মেতে ভাইরাসকে ক্রমাগত শক্তি জুগিয়েছি। আমরাই এই ধ্বংসের দায়ভাগে। সময় এসেছে দায়মোচনের, হাতে কিন্তু বেশি সময় নেই।
(মতামত নিজস্ব)