‘নাগরিকত্ব’ চলে যাবে মানে তারা গৃহহীন, দেশহীন, ভূমিহীন আকাশহীন মানুষ হয়ে যাবে। রেশন, আধার, প্যান, স্বাস্থ্যসাথী, এটিএম, পেট্রল পাম্প, ক্রেডিট, ডেবিট এসব কোনও কার্ড থাকবে না, সমস্তরকম ‘শ্রী’ থেকে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের উৎখাত করবে। সে এক কীরকম ভয়ানক নিরস্তিত্ব তা কল্পনাতেও আসে না আমার। লিখছেন পবিত্র সরকার।
দোহাই প্রিয় পাঠক, শিরোনামে একটা ইংরেজি শব্দ ব্যবহার করছি বিদ্যে দেখানোর জন্যে নয়, একটু নির্দোষ অনুপ্রাস লাগাতে এ-শব্দটাই বেশ লাগসই মনে হল। এর মানে কর্কশ চেঁচামেচি, ‘রবীন্দ্রনাথ’ নামক অভিধান থেকে চুরি করে আর-একটা শব্দ বলতে পারি– ‘কাংস্যক্রেংকার’। আমার লেখাটার চরিত্র বোঝানোর জন্য।
‘সিটিজেনশিপ অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট’ বা ‘ক্যা’ (CAA) নিয়ে দেশে প্রচুর হইহট্টগোল হচ্ছে। হওয়ারই কথা, কারণ অনেক মানুষ (যেমন, মতুয়া-বন্ধুদের কেউ কেউ, বা ক্ষণিক পথের সাথী এক মুসলমান ট্যাক্সিচালক– যার বাড়ি মুর্শিদাবাদে) এই ভয় পাচ্ছে যে, ওই আইন হলে তাদের নাগরিকত্ব চলে যাবে। আর ‘নাগরিকত্ব’ চলে যাবে মানেই তারা গৃহহীন, দেশহীন, ভূমিহীন আকাশহীন মানুষ হয়ে যাবে।
না, তারা ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’-এর সেই জাদুকরের মতো আকাশে ফট্ করে ফেটে বা বিকেলের রোদের মতো ফিকে হতে হতে মিলিয়ে যাবে না। তারা রক্তমাংসের শরীর নিয়ে বেঁচে থাকবে, তাদের এবং তাদের আত্মজনদের ক্ষুধা-তৃষ্ণা-প্রেম-ঘৃণা সবই থাকবে, কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত খাতা থেকে তাদের নাম কাটা যাবে– রেশন, আধার, প্যান, স্বাস্থ্যসাথী, এটিএম, পেট্রল পাম্প, ক্রেডিট, ডেবিট এসব কোনও কার্ড থাকবে না, সমস্তরকম ‘শ্রী’ থেকে কেন্দ্রীয় সরকার তাদের উৎখাত করবে। সে এক কীরকম ভয়ানক নিরস্তিত্ব তা কল্পনাতেও আসে না আমার। এমনকী, আমি যে আমি, যে উদ্বাস্তু হয়ে এ-দেশে এসেছিল (উদ্বাস্তু রেজিস্ট্রেশন নম্বরের কাগজ কোথাও আছে, খুঁজে দেখতে হবে), আমার বুক-ও দুরদুর করছে।
সত্যিই তো, এমন যদি হয়, কে নেবে আমাদের? কোন ভূমি, কোন সমাজ? কিনে নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না, ক্ষমাঘেন্না করে জায়গা দেবে, দু’-মুঠো খাদ্যসংস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা, আইনি সুরক্ষার সুযোগ দেবে কে? পৃথিবীতে কোথায় আছে সে-দেশ? আর সব দেশ চাইলেও কি আমরা যেতে পারব? চিন যদি বলে, এসো, আমাদের তিব্বতে প্রচুর জায়গা খালি আছে, চলে এসো বাছারা, বা রাশিয়ার সাইবেরিয়া যদি ডাকে, ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধে গিয়ে মরার শর্তে– আমরা কি লাফিয়ে উঠে বলব, ‘চল্ মুসাফির, বান্ধো গাঠোরি’? শুনেছি পরম সদাশয় ভারত সরকার নাকি ডিটেনশন ক্যাম্প আশ্রয়শিবিরে রাখার ব্যবস্থা করবে এসব মানুষকে। কিন্তু যাদের রিফিউজি ক্যাম্পে থাকার অভিজ্ঞতা আছে তারা জানে সে কী ভয়াবহ জায়গা। তা থেকে হিটলারের ক্যাম্পের ইহুদিনিধন শিবিরগুলির দূরত্ব তো দু’-পা মাত্র।
এসব এলোমেলো ভাবনার মধ্যেই নিজেকে বললাম– ওরে মূর্খ, লোকের মুখের গুজব শুনলেই চলবে? কাকে কান (বড্ড ‘ক’ ধ্বনিটা এসে যাচ্ছে এ লেখায়) নিয়ে গেল বলে কাকের পিছনে দৌড়বি? কেন, একটু পড়াশোনা করে দেখতে কী ক্ষতি? হায়, পড়াশোনা কবে ছেড়ে দিয়েছি, আবার এই বুড়ো বয়সে সেই ভীতিকর কর্ম? তা, এখন পড়াশোনা করতে আর কোথায় যাব, গেলাম হাতের কাছে বিশ্বকোষ সেই উইকিপিডিয়ার কাছে। সেখানে ‘কা’ (CA) আর ‘ক্যা’ (CAA) বিষয়টা বুঝলাম একটু। দেখলাম, আমি যে ভয় করছিলাম সেটা খুব সম্ভবত ঠিক নয়। আমার নাগরিকত্ব না যাওয়ারই কথা।
কেন, সেটা পরে বলছি। ‘কা’ ছিল ‘নাগরিকত্ব আইন’ ১৯৫৫, ভারতীয় সংবিধানে বিধিবদ্ধ। তাতে জন্ম, বংশ, বিবাহ, স্বাভাবিকীকরণ (naturalization) ইত্যাদি কতভাবে ভারতের নাগরিক হওয়া যায়
তার বিধান ছিল। তাতেও সমস্যা কিছু ছিল পাকিস্তানের নাগরিকদের নিয়ে, কিন্তু তা খুব প্রাসঙ্গিক নয়।
এখন ‘ক্যা’ (CAA), ২০১৯ এসেছে ভারতে গত কয়েক বছরে ঢুকে-পড়া বিদেশিদের ‘ভার্তীয়করণ’-এর আপাত মহৎ উদ্দেশ্য নিয়ে। এর উদ্দেশ্য– আপাতভাবে, অন্তর্ভুক্তি, বহিষ্করণ নয়। অর্থাৎ, এর মধ্যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, মায়ানমার ইত্যাদি দেশ থেকে নানা অত্যাচার ও নিপীড়নের ফলে যেসব ‘সেখানকার’ সংখ্যালঘু দেশ ছেড়ে ‘অবৈধভাবে’ ভারতে এসে পৌঁছেছে, তাদের ভারতীয় নাগরিকত্ব দেওয়া। বলে দেওয়া যে তোমরা আমাদের দেশেরই লোক, এখানে এসে পড়েছ বেশ করেছ, এখন এই মহান দেশে সুখে শান্তিতে বাস করো। এখানে এই সেদিন ‘অমৃত মহোৎসব’ হয়ে গেল, দেখো সে অমৃতের ছিটেফোঁটা পড়ে আছে কি না কোথাও। চমৎকার প্রস্তাব!
২
এ-পর্যন্ত সবই ঠিক ছিল। ইংরেজিতে যেমন বলে ‘So far, so good.’ কিন্তু এর এক জায়গায় খটকা বেধেছে। তা হল, সেসব দেশের ‘সংখ্যালঘু’-দের মধ্যে হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পারসি, খ্রিস্টান– এই ছ’টি ধর্মের মানুষের কথা আছে, মুসলমানদের নাম নেই। তা, একদিক থেকে ঠিক, মায়ানমার ছাড়া আর কোনও দেশে তো মুসলমান সংখ্যালঘু নেই। অন্য সব দেশ থেকে সংখ্যাগুরু মুসলমানরাও যে কেউ কেউ নানা কারণে (মূলত পেটের দায়ে) ভারতে আসতে পারে, তা আমাদের শাসকেরা ভাবেনি, এটা খুব আশ্চর্যের।
কিন্তু এখানেই কেন্দ্রীয় সরকার একটা মুশকিলে পড়ল। মায়ানমারে সামরিক শাসকদের অত্যাচারের ফলে হাজার-হাজার আরাকানবাসী রোহিঙ্গা মুসলমানরা দেশছাড়া হয়ে বাংলাদেশে (কথিত, বাংলাদেশের সীমানা পার হয়ে ভারতেও নানা জায়গায়) ছড়িয়ে পড়ল। মনে হয়, এই সংকট কাটানোর জন্যই প্রধানত ওই আইনের সংশোধন তৈরি করা হয়েছিল, যার সোজা অর্থ হল, ভারতের মুসলমানের সংখ্যা আর বাড়তে দেওয়া যাবে না। এমনিতেই বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার ইসলাম সম্বন্ধে আতঙ্কে ভোগে, ইতিহাস থেকে মুসলমান শাসনের স্মৃতি মুছে দিতে চায়, কাজেই তার পক্ষে আমেরিকার ‘স্ট্যাচু অফ লিবার্টি’-র মতো বলা সম্ভব নয় যে, যারা আরও ভাল জীবন চাও তারা এসো আমার বুকে। বলা বাহুল্য, ওয়াল্ট হুইটম্যানের সুর ভারতের শাসনকর্তাদের বুকে বাজে না। তারা ভারতের একটি সীমাবদ্ধ চিত্রকল্প তৈরি করেছে যে, ভারত মূলত অ-মুসলমান দেশ।
এই উইকিপিডিয়াতেই আর-একটি মজার মামলার কথা পড়লাম। মহম্মদ কামার বলে একজন, তঁার ভারতেই জন্ম, সাত-আট বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে পাকিস্তানে চলে যান, পরিণত বয়সে ফিরে এসে ভারতে বিয়ে করে সংসার পাতেন, ছেলেপুলেও হয়। তারপর ভারতীয় পুলিশ তঁাকে ধরে, ‘অনুপ্রবেশকারী বিদেশি’ হওয়ার দায়ে। বিচারে সাত বছর জেল খাটেন। তঁার ছেলেমেয়েরা হেবিয়াস কর্পাস আবেদন করে। ততদিনে তঁার জেল খাটা হয়ে গিয়েছে। এই আবেদনে সাব্যস্ত হয় যে, তিনি, জন্মসূত্রে ভারতীয়, কাজেই তাকে অবৈধ ‘ঘুসবৈঠেঁ’ বিদেশি হিসাবে শাস্তি দেওয়া ঠিক হয়নি।
‘ক্যা’-র ওই বিধানে বহিরাগতদের বা ভারতে আশ্রয়প্রার্থীদের ধর্ম পরিচয়ের মধ্যে ইসলামের বহিষ্করণ নিয়ে এই প্রশ্নটি এখন অনেক ভারতীয়র মনকে তোলপাড় করছে। আমি জানি না, মতুয়ারা তাদের ধর্মকেও ওই সংস্করণে ‘বহিষ্কৃত’ দেখে উদ্বিগ্ন হচ্ছে কি না। কাকে কী প্রমাণ দেখাতে হবে, সে-ও এক জটিল প্রক্রিয়া। আমি হয়তো বহিষ্কৃত হব না, কারণ আমার পূর্বপুরুষেরা পূর্ববঙ্গে জন্মালেও তঁারা বুদ্ধি-বিবেচনা করে হিন্দুই থেকে গিয়েছিলেন, রাজার ধর্ম গ্রহণ করেননি। তঁাদের মুসলমান প্রতিবেশীরাও তঁাদের ধর্মনির্বাচনে বা রক্ষণে কোনও বাধা তৈরি করেননি। শুধু দেশভাগের ভ্রষ্ট রাজনীতি এসে তঁাদের দেশত্যাগে বাধ্য করে। তার জন্য নেতারা যত দায়ী, মানুষ ততখানি নয়।
যে-মানুষ এক মহাদেশে জন্মে সারা পৃথিবীতে অবাধে ছড়িয়ে গিয়েছে, (রাজনৈতিক-ভৌগোলিক জাতিসত্তা বা স্টেট তৈরি হওয়ার আগে মানুষের এই অবাধ যাতায়াতের কোনও বাধা ছিল না) তার জাতীয়তার সঙ্গে ধর্মের মিশ্রণ ঘটিয়ে আরও সমস্যা তৈরি হয়েছে, সীমানা শক্ত হয়েছে। জানি না, এখনই আমাদের ভারতের সেই ‘দাদুর দস্তানা’-র মতো অবস্থা হয়েছে কি না, যাতে আমরা যে কোনও ধর্মের বহিরাগতদের ডাকতে পারব না, শুধু নির্বাচিত ধর্মের মানুষদেরই ডাকতে পারব। বাকিদের, শত বিপন্ন হোক, চুলোয় যাওয়ার বরাত দেব, ‘and the Devil take the hindmost’ বলে !
৩
ভাষার লোক হিসাবে আমি ভাবছিলাম যে, ‘নাগরিকত্ব’ কথাটার মধ্যেও একটা বহিষ্করণ আছে। মূল ‘সিটিজেনশিপ’-এর অনুবাদ করে নিয়েছি এটা, কিন্তু বাংলা কথাটায় নগরের গন্ধ যেন একটু বেশি। গ্রামের লোকেরা কোন অর্থে ‘নাগরিক’, কোন অর্থে ‘নাগরিক’ নয়? তারা যে অনেক অধিকার থেকে বঞ্চিত থেকে যায়, কে না জানে? জানি, গ্রিক নগর-রাষ্ট্র থেকে এই ‘নাগরিকতা’ কথাটা এসেছে, কিন্তু নাগরিকতার চরিত্র নির্ণয় কি আইন দিয়ে করা যায়? পৃথিবীর কোনও দেশ আর-এখন এক ধর্মের নেই, এক ভাষার নেই, এক রঙের নেই। আমাদের নেতারা কথায়-কথায় ‘বসুধৈব কুটুম্বকম্’ বলে গাল ফুলিয়ে বক্তৃতা করেন, তঁাদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ, ‘ক্যা’-তেও এই নীতি কায়েম করুন।
(মতামত নিজস্ব)
লেখক রবীন্দ্রভারতীর প্রাক্তন উপাচার্য
pabitra37@gmail.com