shono
Advertisement

উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের ‘শেষ পারানির কড়ি’প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, ভোটবাক্সে কি মিলবে ফল?

সর্বভারতীয় রাজনীতির চৌষট্টি খোপে হতমান কংগ্রেস।
Posted: 02:41 PM Oct 28, 2021Updated: 02:41 PM Oct 28, 2021

বিহারে নীতীশ কুমার জিতেছেন মহিলা সমর্থনে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির রথের চাকা আটকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাসি চওড়া করেছে মহিলা মহল। মোদির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উত্তরপ্রদেশে প্রায় অস্তিত্বহীন কংগ্রেস তাই প্রিয়াঙ্কা গান্ধীকে সামনে রেখে তুরুপের শেষ তাসটা খেলেছে। ঠাকুমা ইন্দিরার ‘আদর্শ ভারতীয় নারীত্ব’তে ভর দিয়ে প্রিয়াঙ্কা সচেতনভাবে কাছে টানতে চাইছেন নারীসমাজকে। তাই ৪০ শতাংশ মনোনয়ন নারীদের দেওয়ার ঘোষণা, পরে যা ‘আরও বাড়ানো হবে’ জানিয়েছেন। লিখছেন সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়

Advertisement

নিছক ভাগ্য, না কি ভাগ্যের সহায়তায় কর্মদ্যোগ, কীভাবে এই পরিস্থিতিকে বিচার করা যায়, তা যে যার নিজের মতো করে বিবেচনা করুন। আমি শুধু এটুকু বলতে পারি, কাঁচা ঘুঁটি পাকিয়ে ঘরে তোলাই শুধু নয়, প্রতিপক্ষের প্রায় পাকা ঘুঁটি খেয়ে ফেলার প্রবল এক দক্ষতা নরেন্দ্র মোদির (Narendra Modi)  বিজেপি অর্জন করেছে। নইলে এতদিন ধরে কোভিড-জর্জরিত প্রধানমন্ত্রী টিকাকরণ কর্মসূচিকে হাতিয়ার করে নিজেকে এভাবে কোভিড-জয়ের মহানায়ক করে তুলতে পারতেন না। এটাই তাঁর পাগড়ির সর্বশেষ ঝলমলে পালক। বিজ্ঞাপন বিপণনের ভাষায় যা ‘ইউএসপি’, ফিলহাল তিনিই সম্ভবত তার শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক নিদর্শন।

[আরও পড়ুন: বাংলাদশে হিন্দু নির্যাতন নিয়ে তাস খেলার আগে সতর্ক থাকা উচিত বিজেপির]

এই মুহূর্তে দেশের আনাচকানাচে বড় বড় হোর্ডিং দৃশ্যমান। তাতে লেখা, ‘সবাইকে টিকা, বিনামূল্যে টিকা, ভারতের অসাধ্য সাধন, ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী’। একশো কোটি টিকাকরণ নিয়ে বিরোধী মনে যে-প্রশ্নই উঠুক, যত সমালোচনাই থাকুক, সরকারি প্রচারে সব ধামাচাপা! জলে, স্থলে ও অন্তরিক্ষে নিরবচ্ছিন্নভাবে চলছে প্রধানমন্ত্রীর ‘অসাধ্য সাধন’-এর প্রচার। সরকারি অফিসের অলিন্দে বাজছে কোভিড-জয়ের দাবি। ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর স্বার্থে মহল্লায় মহল্লায় ময়লা তোলার গাড়ির লাউডস্পিকারে দিবারাত্র টিকা-সাফল্যের সাতকাহন। রেডিও-টিভির বিজ্ঞাপন তো আছেই, ট্রেন-বাস-এরোপ্লেনের গায়েও আঁকা হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর মুখ-সর্বস্ব এই সাফল্যের প্রচার। মানুষের স্মৃতি সতত দুর্বল। নতুন ঘটনা পুরনোগুলো চাপা দেয়।

সবার উপরে প্রচারের গুণ ভুলিয়ে দিচ্ছে কয়েক মাস আগেও কোভিডের কারণে কী হাহাকার উঠেছিল। সেই সময় কোভিড অস্ত্র ছিল মোদি-বধের প্রধান বিরোধী হাতিয়ার! প্রচার প্রাবল্যে আজ তা কর্পূরের মতো উবে গিয়েছে! মানুষকে নতুন করে বোঝানো হচ্ছে সেই পুরনো কথা, ‘মোদি হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।’

প্রচারের তীব্রতায় দু’টি ধারণা দৃঢ় করে তোলা হচ্ছে। এক, সবাইকে টিকা। দুই, বিনামূল্যে টিকা। বোঝানো হচ্ছে, দেশের ধনী-দরিদ্র সবাই টিকা পাচ্ছেন এবং তা বিনামূল্যে। যদি ধরে নেওয়াও যায়, প্রথম দাবিটি অসত্য নয়, অর্থাৎ, সরকার দেশের ১৩০ কোটি মানুষের সবার জন্যই টিকার বন্দোবস্ত রেখেছে, দ্বিতীয় দাবিটি কিন্তু নির্ভেজাল সত্য নয়। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের মন বুঝতে পেরে প্রধানমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ১৭-৪৪ বয়সিদের টিকা দেওয়ার দায়িত্ব সরকার নেবে। তবে ৭৫ শতাংশের জন্য। উৎপাদিত ২৫ শতাংশ টিকা বেসরকারি ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হতে পারবে। সে জন্য নাগরিককে মূল্য দিতে হবে। সরকার বিভিন্ন টিকার দামও ধার্য করে দেয়। যে-টিকার দাম শুরুতে ছিল ২৫০ টাকা, পরে তা বেড়ে হয় ৮৫০। কোনও টিকার দাম দেড় হাজার টাকা! প্রশ্ন তাই, সবার জন্য টিকাকরণ অভিযান ‘বিনামূল্যে’ কি? সরকার সেই দাবি করতে পারে কি?

বোঝাই যাচ্ছে, বিরোধীদের প্রধান অস্ত্র ভোঁতা করে মোদির বিজেপি আসন্ন বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রতিপক্ষকে কোণঠাসা করতে কোমর কষে নেমেছে। যদিও প্রকৃত অর্থে ‘প্রতিপক্ষ’ বলে আদৌ কিছু আছে কি না সেই প্রশ্ন তর্কাতীত নয়।

বিজেপি মনে করে, সর্বভারতীয় রাজনীতিতে কংগ্রেসই তাদের মূল প্রতিপক্ষ। কেননা, দেশের কম-বেশি ২০০ লোকসভা কেন্দ্রে এখনও তাদের মূল লড়াই কংগ্রেসের সঙ্গেই। উত্তরাখণ্ড, হিমাচল প্রদেশ, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, রাজস্থান, গুজরাট, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়ে কংগ্রেস এখনও বেগ দিচ্ছে। কর্ণাটক, গোয়া, মহারাষ্ট্র, কেরল, পুদুচেরি, ত্রিপুরা, অসম ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে কংগ্রেসের শক্তি কমলেও উপেক্ষণীয় নয়। এই কারণে বিজেপির মননে সর্বভারতীয় স্তরে কংগ্রেসকে নিয়ে নিরন্তর ভাবনাচিন্তা চলে। অন্যত্র চলে শক্তিশালী আঞ্চলিক দল নিয়ে। যেমন, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল কংগ্রেস, ওড়িশায় বিজু জনতা দল, অন্ধ্রপ্রদেশে টিডিপি, তেলেঙ্গানায় টিআরএস, দিল্লিতে আম আদমি পার্টি, মহারাষ্ট্রে শিবসেনা-এনসিপি-কংগ্রেস জোট। তামিলনাড়ুতে বিজেপি ও কংগ্রেস দুই শক্তিই নিমিত্ত মাত্র। পরজীবী।

বিজেপির জাতীয় লক্ষ্য তাই দ্বিমুখী। যেখানে কংগ্রেস মূল বিরোধী শক্তি ও কঠিন প্রতিপক্ষ, সেখানে দল ভাঙিয়ে তাদের দুর্বল করা ও বিরোধীদের জোটবদ্ধ হতে বাধা দেওয়া। এই নতুন ‘প্যান ইন্ডিয়ান’ পার্টির সাম্প্রতিক আচরণ রাজনীতির আতশকাচের নিচে রাখলে কৌশল স্পষ্ট ধরা পড়ে। অসমের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা এমনি এমনি বলেননি যে, তৃণমূল কংগ্রেস ডানা ঝাপটাতে চাইলে তাঁর রাজ্যে তিনি লাল কার্পেট বিছিয়ে দেবেন! পশ্চিমবঙ্গের শাসকদল বিজেপি-বিরোধিতার প্রধান অনুঘটক হওয়ার বাসনায় যত বেশি ত্রিপুরা, মণিপুর, অসম ও গোয়া অভিযান করবে, বিজেপি তত উৎফুল্ল হবে।

সর্বভারতীয় রাজনীতির চৌষট্টি খোপে হতমান কংগ্রেস শেষ পর্যন্ত এমন একটা চাল দিয়েছে যা ‘মিনি ইন্ডিয়া’ উত্তরপ্রদেশ-সহ দেশের রাজনীতিতে আগামী দিনে কিছুটা ঢেউ তুললেও তুলতে পারে। হলেও তা হতে পারে ভবিষ্যৎ রাজনীতির নতুন ‘নির্বাচনী ন্যারেটিভ’। সেই লক্ষ্যপূরণে কংগ্রেস সামনে রেখেছে প্রিয়াঙ্কাকে।

উত্তরপ্রদেশে কংগ্রেসের ক্ষমতার শেষ আস্বাদন ১৯৮৯ সালে। ৩৩টা বছর ধরে এই রাজ্যে কংগ্রেস অতৃপ্ত আত্মার মতো ঘুরে চলেছে। কখনও একা, কখনও মায়াবতী, কখনও বা অখিলেশের হাত ধরেও তারা নিজেকে তরাতে পারেনি। কাশ্মীরিদের মর্যাদা হারানোর মতো একে একে হরণ হয়েছে শতবর্ষী এই দলের ভোট ব্যাংক। মুলায়ম টেনেছেন মুসলমানদের, মায়াবতী দলিতদের, বিজেপি বর্ণ হিন্দু। কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের হার ঠেকেছে তলানিতে। সমীক্ষা অনুযায়ী, আগামী বছর বিধানসভা নির্বাচনেও কংগ্রেস পেতে পারে কম-বেশি মাত্র ছ’শতাংশ ভোট! এই সত্যের উপর দাঁড়িয়ে অসাধ্য সাধনের চেষ্টায় প্রিয়াঙ্কার সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত সম্ভবত দলের ‘শেষ পারানির কড়ি’। ঠাকুমা ইন্দিরার ‘আদর্শ ভারতীয় নারীত্ব’তে ভর দিয়ে প্রিয়াঙ্কা সচেতনভাবে কাছে টানতে চাইছেন নারীসমাজকে। তাই ৪০ শতাংশ মনোনয়ন নারীদের দেওয়ার ঘোষণা, পরে যা ‘আরও বাড়ানো হবে’ জানিয়েছেন।

ক্ষমতায় এলে স্কুল-কলেজ পাস নারীদের স্মার্টফোন ও ইলেকট্রিক স্কুটি দেওয়ার প্রতিশ্রুতিও তিনি দিয়েছেন। একটা ছবি ভাইরাল হয়েছে। আগ্রায় তাঁকে যাঁরা বন্দি করেছিলেন, রাজ্যের সেই মহিলা পুলিশ কর্মীরা প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে হাসিমুখে ‘সেলফি’ তুলছেন! স্কুল-কলেজের ছাত্রীদের গলায় তাঁর শেখানো স্লোগান, ‘লড়কি হুঁ, লড় সকতি হুঁ’। এই ‘জেন্ডার ন্যারেটিভ’ কংগ্রেসের নাও তরতরিয়ে তীরে ভিড়াবে এমন আশা অন্যায়। কিন্তু আগামী দিনে তা যে রাজনীতির প্রবাহ বদলে দেবে না কে বলতে পারে? জাতপাতের রাজনীতিতে হীনবল দলটির ক্রমাবনতি ঠেকাতে এটাই শেষ টোটকা।

তৃণমূল স্তরে নারীর ক্ষমতায়নের কথা প্রথম ভেবেছিলেন প্রিয়াঙ্কার প্রয়াত পিতা রাজীব গান্ধী। সেই ভাবনা অনুযায়ী নরসিংহ রাওয়ের আমলে ৭৩তম সংবিধান সংশোধন। পঞ্চায়েতে ৩৩ শতাংশ মহিলা সংরক্ষণের সেই শুরু। প্রিয়াঙ্কার মা সোনিয়ার উদ্যোগে ২০১০ সালে রাজ্যসভায় মহিলা বিল পাসও হয়েছিল। সেই থেকে আজও তা লোকসভার অনুমোদন প্রত্যাশী। মোদি জমানার নিরঙ্কুশ প্রাধান্য সত্ত্বেও তা ‘মুমকিন’ হতে পারেনি।

বিহারে নীতীশ কুমার জিতেছেন মহিলা সমর্থনে। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির রথের চাকা আটকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাসি চওড়া করেছে মহিলামহল। নারীসমাজ দ্রুত হয়ে উঠছে নবতম ভোট ব্যাংক। গোটা দেশেই। মোদির মুখোমুখি দাঁড়িয়ে উত্তরপ্রদেশে প্রায় অস্তিত্বহীন কংগ্রেস প্রিয়াঙ্কাকে সামনে রেখে তুরুপের শেষ তাসটা খেলেছে। লাগলে তুক, না লাগলে তাক। প্রিয়াঙ্কাও বিলক্ষণ জানেন, তাঁদের হারানোর আর কিছু অবশিষ্ট নেই! জেতার জন্য রয়েছে অর্ধেক আকাশ।

[আরও পড়ুন: ভোট ও জোটের গ্র্যান্ড ন্যারেটিভে কোথায় দাঁড়িয়ে কংগ্রেস?]

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement