সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: দীর্ঘ জীবনে রবীন্দ্রনাথ মৃতু্যশোক পেয়েও উত্তীর্ণ হয়েছেন নব-নব মৃতু্যচেতনার হিরণ্ময়তায়। শোকে তিনি দীর্ণ, বিহ্বল, দিশাহারা হয়েছেন– সত্য। কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য, জীবনের অনিবার্য অঙ্গরূপে মৃতু্যকে তিনি ক্রমশ মেনে নিয়েছেন, মৃতু্যর মধে্য আবিষ্কার করেছেন জীবনের পরিপূর্ণতা। মৃতু্যর রূপ তঁাকে এতটাই মুগ্ধও করেছে যে তিনি বলতে পেরেছেন, ‘তুঁহু মম মাধব, তুঁহু মম দোসর।’ বলেছেন, ‘মৃতু্য-অমৃত করে দান॥’
কী সেই দান? নতুন জীবনাভূতি। একটি গানে লিখলেন মৃত্যু সম্বন্ধে এই সাহসী কথা: ‘তোর প্রাণের রস তো শুকিয়ে গেল ওরে/ তবে মরণ রসে নে পেয়ালা ভরে॥’ তারপর? জীবনের কোন নতুন চৈতনে্য উত্তীর্ণ হলেন রবীন্দ্রনাথ মরণ রসে তঁার পেয়ালা ভরে নেওয়ার পর? এই সেই নবজীবনবোধ: ‘সে যে চিতার আগুন গালিয়ে ঢালা, সব জ্বলনের মেটায় জ্বালা–/ সব শূন্যকে সে অট্টহেসে দেয় যে রঙিন করে।’ বারবার মৃতু্যশোক পেয়ে তবেই তিনি শান্তায়িত হন জীবন ও মৃতু্যচেতনার হিরণ্ময়তায়। তঁার এই দার্শনিক উত্তরণের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি হয়ে ছিল উপনিষদ চর্চা এবং মৃতু্যদর্শনের ক্রমিক বিস্তৃতি ও গভীরতা।
[আরও পড়ুন: এবার আহমেদনগরের নামবদল! মোদিকে পাশে নিয়ে ভোটপ্রচারে ঘোষণা ফড়ণবিসের]
রবীন্দ্রজীবনের প্রথম মৃত্যুশোক এল তাঁর মায়ের মৃতু্যতে। তখন বালকমাত্র। ভোরবেলা ঘুম ভাঙতে জানলেন মা আর নেই। দেখলেন, মায়ের মৃতদেহ সুন্দরভাবে সাজানো। মনে হল, মৃতু্য কী সুন্দর! কিন্তু মা-কে হারানোর ব্যথা, তীব্র ঝড়ের মতো আঘাত করল, দহন করে ফেরার পরে। হঠাৎ বালক রবির মনে হল, মা তো আর কখনও তঁার এই সংসারটির মাঝখানে ফিরে আসবেন না! সেই হাহাকার রবি সামলে উঠলেন। এরপর এল আরও এক মহাশোক– কনিষ্ঠ পুত্র শমীকে হারানো। শেষকৃতে্যর পর ট্রেনে কলকাতায় ফিরতে-ফিরতে রবীন্দ্রনাথ দেখলেন, আকাশে উঠেছে পূর্ণ চন্দ্র, জে্যাৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে আকাশ, কোথাও শোকের, মৃতু্যর চিহ্নমাত্র নেই। শমীকে মুক্তি দিলেন মনে মনে সেই কসমিক মহানন্দর মৃতু্যহীন অনন্তে।
সন্তানশোকের আগে স্ত্রী মৃণালিনীর মৃত্যুশোকও পেয়েছেন। পেয়েছেন দুই কন্যা মাধুরীলতা এবং রেণুকার মৃতু্যশোক। তবে রবীন্দ্র-জীবনে সবথেকে কঠিন এবং সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত মৃতু্য-অাঘাত আসে নতুন বউঠাকরুণ কাদম্বরী দেবীর আত্মহত্যায়। কবি তখন তেইশ। কাদম্বরী পঁচিশ। তঁাদের মধে্য গড়ে ওঠে গভীর ভালবাসার বন্ধন ও বন্ধুত্বের আদান-প্রদান। সেই সময় হঠাৎ কাদম্বরীর আত্মহত্যায় রবীন্দ্রনাথ সাময়িক আত্মহারা হয়ে পড়েছিলেন। নিজেই জানান, মৃত বউঠানকে তিনি কীভাবে ছাদে রাতের অন্ধকারে দিশাহারাভাবে খুঁজতেন।
[আরও পড়ুন: ১৮ মাস পর ভারতে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ চিনের, দিল্লি দরবারে এবার জিনপিংয়ের ‘বিশ্বস্ত’ ফেইহং]
এই শোককেও তিনি দিতে পারলেন এই সতে্যর বার্তা, বিশ্বে কোনও কিছুই হারিয়ে যায় না। আমরা আমাদের সীমিত বীক্ষণ পেরতে পারি না। ভাবি, মৃতু্য বুঝি ঘটাল বিচ্ছেদ। কবি দিয়ে গিয়েছেন মৃতু্যকে জয় করার চিরায়ত মন্ত্র: ‘কোথাও দুঃখ, কোথাও মৃতু্য, কোথা বিচ্ছেদ নাই/ হে পূর্ণ, তব চরণের কাছে যা-কিছু সব আছে আছে আছে–’।