গত নবমীর রাত। একসঙ্গে ৮৭টি স্লিপিং পিল! তিনি মীর আফসার আলি নিজেকেই মুছে দিতে চেয়েছিলেন দুনিয়া থেকে! শুধু একবার নয়। এর আগেও তিনবার আত্মহত্যার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। অকল্পনীয় এবং অবিশ্বাস্য স্বীকারোক্তি করলেন ইন্দ্রনীল রায়-এর কাছে।
“আয়নাটা এখানে কাচের নয়, আয়নাটা এখানে রক্তমাংসের। এবং সেই আয়নার সামনে ‘সকালম্যান’ মীর দাঁড়াতে ভয় পায় না। এটা বলতে আমার কোনও কুণ্ঠা নেই, কোনও লজ্জা নেই যে বিটুইন দ্য টোয়েন্টি-ফিফথ অফ ফেব্রুয়ারি ২০১৭ অ্যান্ড দ্য টেন্থ অফ সেপ্টেম্বর ২০১৯, আই, মীর আফসার আলি হ্যাভ অ্যাটেম্পটেড সুইসাইড ফোর টাইমস। আমি এই কথাগুলো শেয়ার করছি আপনার সঙ্গে বিকজ ইউ বিলং টু মাই এক্সটেন্ডেড ফ্যামিলি। এবং আমার এই আশ্বাসটা রয়েছে, এই বিশ্বাসটা রয়েছে দ্যাট ইউ উইল নট জাজ মি। ইউ উইল নট আস্ক মি কোয়েশ্চেন্স যে কেন ‘সকালম্যান’, তোমার লাইফে তো সব কিছু রয়েছে, ইউ আর ব্লেস্ড উইথ এভরিথিং, তাহলে কেন? আই উইল স্পেয়ার ইউ দ্য ডিটেলস। অত গভীরে ঢুকতে চাই না। তাহলে ক্ষতগুলো আরও তাজা হয়ে যাবে। হ্যাঁ সব কিছু রয়েছে আমার। আল্লা তালা সব কিছু দিয়েছেন। আমি যা যা কিছু স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি সে সব কিছু আমার দখলে রয়েছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও কিছু একটার পেছনে ছুটতে থাকা, কিছু একটা তাগিদ, কোনও একটা জেদের বশে, করেছি এই কাজ। একবার নয়, দু’বার নয়, চার-চারবার।”
রেডিও মির্চি, ১০ সেপ্টেম্বর, সকাল ৮.৪৫।
গোটা কলকাতা শহর, তাঁর লক্ষ-লক্ষ গুণমুগ্ধ শ্রোতা, সবাইকে চমকে দিয়ে গত মঙ্গলবার, ওয়ার্ল্ড সুইসাইড প্রিভেনশন ডে’র সকালে রেডিওতে এই কথাগুলো যিনি বলেছেন তাঁর নাম মীর আফসার আলি। যা অবিশ্বাস্য ও অভূতপূর্ব। জনপ্রিয়তম রেডিও জকি, হাজার শো-এর ভরসাযোগ্য এমসি, ‘মীরাক্কেল’-এ মানুষকে বলে বলে হাসাতে পারদর্শী, সেই মানুষটি স্বীকারোক্তিটি করেছেন। শুক্রবার সকালে শো-এর মাঝখানে আরও বেশ কিছু চমকে দেওয়া কথা বললেন তিনি…
[আরও পড়ুন: ৯/১১-র মৃত্যু উপত্যকায় রুদ্রনীল, গ্রাউন্ড জিরো ঘুরে স্মৃতিরোমন্থন অভিনেতার]
অসম্ভব অবাক হয়েছিলাম মীর সেদিন রেডিওতে হঠাৎ উপরের কথাগুলো যখন আপনি বললেন।
(গম্ভীর হয়ে) হ্যাঁ। আমি নিজের মধ্যে আর রাখতে পারিনি কথাগুলো। সেদিন ওয়ার্ল্ড সুইসাইড প্রিভেনশন ডে ছিল। তার তিন-চার দিন আগে থেকেই ভাবছিলাম ওই দিনটা কী বলা যায় অন-এয়ার। আমরা মিডিয়ায় কাজ করা মানুষেরা যেমন দিনক্ষণ নিয়ে ভেবে থাকি সেরকম আর কী। তারপর… (অনেকক্ষণ চুপ)
তারপর?
তখন ‘পরিণীতা’-র গানটা চলছে অন-এয়ার। আমার শো-এর প্রোডিউসার অমর্ত্য তখনও জানে না গান শেষ হওয়ার পর আমি কী বলব। কেউ কিচ্ছু জানত না। কিন্তু আমার মনের ভিতর একটা ঝড় চলছিল। খালি ভাবছিলাম থার্ড পার্টি রেফারেন্স হিসেবে বলতেই পারি, ‘জানেন তো অনেকেই আজকের পৃথিবীতে সুইসাইড অ্যাটেম্পট করে’ অথবা ‘জানেন তো আমার পাশের বাড়ির একজন গত মাসে সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছে’। সেটা বলাটা সহজ হত কিন্তু খালি মনে হচ্ছিল সেটা বোধহয় সুপারফিশিয়াল হবে। মেকি হবে। মনে হচ্ছিল আমি নিজের কাছে ছোট হয়ে যাব।
তারপর সেই কনফেশন?
হ্যাঁ তারপর সবার সামনে বলেই দিই, গত দু’বছরে আমি চারবার সুইসাইড অ্যাটেম্পট করেছি। চারবারের মধ্যে তিনবার আমাকে আনোয়ার শাহ রোডের হসপিটালে অ্যাডমিট করতে হয়েছিল। চারবারের মধ্যে একবার তো আমি নিজের বাড়িতে সুইসাইড অ্যাটেম্পট করতে গিয়েছিলাম।
[আরও পড়ুন: শরীরে শোভা পাচ্ছে দুর্গা-ট্যাটু, নতুন ফ্যাশনে মাতোয়ারা তিলোত্তমা]
বাকি সুইসাইড অ্যাটেম্পটগুলো কোথায় করেছিলেন মীর?
(ভেবে) বলেই দিচ্ছি তাহলে। এটা আমার ক্লোজ বন্ধুবান্ধব বা ফ্যামিলির লোকজন ছাড়া কেউ জানে না। একবার এক ডক্টর্স কনফারেন্সে আমাদের ব্যান্ড ‘ব্যান্ডেজ’-এর পারফরম্যান্স ছিল। আইটিসি সোনারে ছিল ইভেন্টটা। সেই কনফারেন্সে আমি দু’ঘণ্টা ধরে পারফর্ম করি, স্টেজে মানুষকে হাসাই। তারপর উপরের ঘরে গিয়ে হঠাৎ ভীষণ ডাউন অ্যান্ড ডিপ্রেস্ড লাগে। অ্যান্ড আই ওয়ান্টেড টু এন্ড মাই লাইফ।
ঠিক ওই মুহূর্তে ওরকম একটা ডিসিশন নেওয়ার সময় মনের অবস্থা কী থাকে? কেন মনে হয়, না আমি আর বাঁচতে চাই না?
(ধীরে ধীরে) সেই সময় নিজেকে অসহ্য লাগে জানেন। ইউ ফিল ওয়ার্থলেস। সঙ্গে কাজ করে একটা সাংঘাতিক প্রেশার। এই যে এত লোককে এন্টারটেন করার দায়িত্ব, এত দর্শককে খুশি করার প্রেশার, এত শ্রোতার সামনে নিজের বেস্টটা দেওয়া- এটা একজন পারফর্মারের কাছে সাংঘাতিক স্ট্রেসফুল। এটা জীবনের সব ক্ষেত্রে হতে পারে। কোনও গৃহবধূ বাড়ির কাজ করতে করতে এই প্রেশার ফিল করতে পারেন। কেউ কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডে এই প্রেশার ফিল করতে পারেন। নামী জার্নালিস্টরা তাঁদের বাইলাইনের মর্যাদা রাখতে এই প্রেশার ফিল করতে পারেন। সেই মুহূর্তে এই অসম্ভব প্রেশারের সঙ্গে যোগ হয় নার্ভাস ব্রেকডাউন। আমার এমনও দিন গেছে, আমি গ্রিনরুমে হাউ-হাউ করে কেঁদেছি। শুধু আমার মেকআপ আর্টিস্ট, যে ছেলেটা আমার সঙ্গে থাকে সে আর আমি ছাড়া…
একটু ইন্টারাপ্ট করছি মীর। পরিবারের কথা, মা-বাবার কথা মনে পড়ে না সেই মুহূর্তটায়?
ওই মুহূর্তটায় একটা অদ্ভুত ডিসকানেক্ট কাজ করে। তখন আর কারও কথা মনে হয় না। শুধু মনে হয় এই জীবনটা এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার আর কোনও মানে নেই। (গলা ধরে আসে) লাস্ট বার ওয়েন আই অ্যাটেম্পটেড সুইসাইড, আমি ৮৭টা স্লিপিং পিল খেয়ে ফেলেছিলাম। একটাও স্লিপিং পিল মুখে দেওয়ার সময় আমার কারও কথা মনে হয়নি। একবারও মনে হয়নি আমি কোনও ভুল কাজ করেছি।
[আরও পড়ুন: হিন্দি ছবিতে হাতেখড়ি অরিন্দম শীলের, থাকছেন দুই সুপারস্টার!]
৮৭!
(গলা নামিয়ে) হ্যাঁ সাতাশিটা। এইট্টি সেভেন।
তারপর?
তারপর আমাকে হসপিটালে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তারদের আপ্রাণ চেষ্টায় মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসি। ইট ওয়াজ অলমোস্ট ফ্যাটাল। আই জাস্ট স্ন্যাপ্ড আউট। সেবার আমার মনে হয়েছিল আমি বোধহয় আর ফিরব না। তারপর কাউন্সেলিং হয়েছিল, ওষুধপত্র স্টার্ট হল। আমাকে বাড়ির লোক আমেরিকা পাঠিয়ে দিয়েছিল ছুটিতে।
মীর, একটা কথা জিজ্ঞেস করছি যা বোকা বোকা মনে হতে পারে। আপনার তো সব রয়েছে। টাকাপয়সা-যশ-প্রতিপত্তি। তাহলে কেন?
একদম বোকা বোকা নয়। খুব ন্যায্য প্রশ্ন ইন্দ্র। যিনি লোকাল ট্রেনে করে অফিস আসেন বা যিনি বড় অফিসে বছরে একবার ইনক্রিমেন্টের অপেক্ষায় পাগলের মতো খাটছেন, তিনি মনে করতেই পারেন আমি যা করেছি তা বড়লোকদের বিলাসিতা বা পাগলামি। কিন্তু বিশ্বাস করুন, একটা স্টেজে আমাদের সবার ইনসিকিউরিটি, ভয় কিন্তু এক। ইনসিকিউরিটি, ভয়, পারফরম্যান্সের প্রেশার- এগুলো কিন্তু টাকা বা প্রতিপত্তি দেখে না। ইট ক্যান অ্যাফেক্ট এনিবডি।
মীর, শুনলাম সেদিন আপনার প্রোগ্রামের পর নাকি মেসেজ এসেছিল একজন মেয়ের…
হ্যাঁ। সেই মেয়েটি মেসেজ করে বলে, আমি আর কিছুক্ষণের মধ্যে সুইসাইড করব ঠিক করেছিলাম। কিন্তু আপনার কথা শুনে আমি আজকে করলাম না। ভবিষ্যতে করতে পারি। কিন্তু আজকে একমাত্র আপনার জন্য আমি সুইসাইড করলাম না।
[আরও পড়ুন: ‘কেন শুধু শাড়ি পরব আর খোঁপা করব’, প্রথা ভাঙার গান ইমনের গলায়]
বুঝতে পারছি আপনার মনের অবস্থা। একটা লাস্ট প্রশ্ন করছি। সুইসাইড করার চিন্তা মাথায় এলে, আমাদের কী কী করা উচিত?
প্রথমেই বলি, এরকম সুইসাইডের চিন্তা সত্যি কখনও মাথায় আসে, তাহলে সঙ্গে সঙ্গে কাছের কোনও মানুষকে সেটা জানান। পাশে কেউ না থাকলে তাকে ফোন করে কথাটা বলুন। সেই মানুষটির সঙ্গেই কথা বলবেন যিনি আপনাকে জাজ করবেন না, যিনি আপনাকে রিবিউক বা অপমান করবেন না।
দ্বিতীয়ত, নিজের মনের ভিতর যদি ঝড় শুরু হয়, সেটাকে দয়া করে আটকাবেন না। ইংলিশে যাকে বলে, ডোন্ট বট্ল ইট আপ। আপনি যত ভেতরের ঝড় আটকে রাখবেন নিজের ভেতরে, মনে রাখবেন সেই ঝড় কিন্তু বিস্ফোরণের মতো ফাটবে একদিন। তাই কিছুতেই সেই স্টেজ অবধি নিজেকে নিয়ে যাবেন না।
আর ফাইনালি, যদি কোনও সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যান, প্রথম দিন থেকে তাঁকে সবটা বলুন। আমি প্রথম প্রথম অনেক কিছু বলতাম না। পরে বুঝেছি আমি কত বড় ভুল করেছি। তাই যাঁরা ডাক্তার বা মনোবিদের সাহায্য নিচ্ছেন, তাঁদের পায়ে পড়ে বলছি, কিছু লুকোবেন না ডাক্তারের কাছে।
আর?
(অনেকক্ষণ চুপ করে) দয়া করে এই কাজটা করবেন না। আমি লজ্জিত আমি এই কাজটা চার-চারবার করেছি। আই অ্যাম অ্যাশেমড।
থ্যাঙ্ক ইউ মীর। উই অল লাভ ইউ…
লাভ ইউ দোস্ত…লাভ সব্বাইকে।
The post ‘চারবার আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলাম’, বিস্ফোরক স্বীকারোক্তি মীরের appeared first on Sangbad Pratidin.