সোমনাথ রায়, নয়াদিল্লি: পথের চারদিকে ব্যারিকেড। কোথাও বা ঘেরা দড়ি দিয়ে। তারই মাঝে এদিক-ওদিক থেকে দেখা যাচ্ছে ভেঙে পড়া দোকান। কোনওটির টিনের চাল পড়ে আছে মাটিতে, কোনওটির আবার ভেঙে ফেলা হয়েছে পিলার। যেন ইমারত নয়, কোনওমতে ধুঁকতে ধুঁকতে দাঁড়িয়ে আছে তাদের কঙ্কাল। ঠিক বছর দু’য়েক আগে উত্তর-পূর্ব দিল্লির বিস্তীর্ণ এলাকায় যে ছবি দেখা গিয়েছিল, তারই মিনি সংস্করণ দেখা যাচ্ছে জাহাঙ্গিরপুরীতেও।
বুধবার সকালে উত্তর দিল্লি পুরনিগমের বুলডোজার দানবের ইস্পাতের নখ-দাঁতের আঘাতে বিপর্যস্ত গোটা এলাকা। সেই ক্ষত কি শুধুই ইট-কাঠ, চুন-সুড়কির ইমারতগুলিতে? না, গভীর ক্ষত তৈরি হয়ে গিয়েছে স্থানীয়দের মনেও। সুপ্রিম কোর্টের (Supreme Court) নিষেধাজ্ঞাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে বিজেপি শাসিত বোর্ডের বুলডোজার আস্ফালনের পর ক্যালেন্ডারের পাতা পালটেছে মাত্র দু’বার। তবে এর মধ্যেই যেন কেমন পালটে গিয়েছে জাহাঙ্গিরপুরী।
[আরও পড়ুন: ‘আর ১০ হাজার দিন, দেশের কেউ খালি পেটে ঘুমাবে না’, বড় স্বপ্নের হদিশ আদানির]
এই তো সেদিনের কথা। মাত্র কয়েকঘণ্টা আগে এনডিএমসির আনা বুলডোজার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল প্রায় গোটা পঞ্চাশেক দোকানপাট। শাসকের কোপে পেটে আঘাত লাগলেও মন তখনও সজীব ছিল জাহাঙ্গিরপুরীর (Jahangirpuri)। গুপ্তা জুস নামক হিন্দুর ভেঙে পড়া দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে মুসলমান যুবক মহম্মদ ইমতিয়াজ আক্ষেপ করে বলছিলেন, কীভাবে একসঙ্গে এতদিন বড় হয়েছেন, রাস্তায় ক্রিকেট খেলেছেন তাঁরা। সেই ঐক্য, সংহতি, সম্প্রীতির ছবি যে এখন আর নেই, তা বলা অন্যায়। তবে কোথায় যেন একটু একটু করে দেখা দিতে শুরু করেছে অবিশ্বাসের ফাটল। বছর ষাটেকের মুদি দোকানি অর্জুন লাল যখন বলছিলেন, “১৯৮১ থেকে এই দোকান চালাচ্ছি। যাবতীয় কাগজপত্র আছে। জন্ম থেকে এই এলাকায়। কখনও এই দৃশ্য দেখিনি। এখানে বরাবর একসঙ্গে সবাই সব উৎসব পালন করে এসেছি।”
একই ধরনের কথা বলছিলেন ঠিক পাশেই লেদ কারখানার মালিক নিতেশ পাণ্ডে ও তাঁর কর্মচারী প্রদীপ। তবে কথার ফাঁকেই নীতেশ একবার বলে বসলেন, “সেদিন থেকে তো এখানে যেন রাজনৈতিক নেতাদের মেলা বসে গিয়েছে। সবাই এসে শুধু ওদের সঙ্গে দেখা করে যাচ্ছে, আমাদের কথা কেউ বলছে? সবার ধান্দা শুধু ভোটব্যাংক।” একটু থেমেই অবশ্য জুড়লেন, “এরা সব হিন্দু-মুসলমান সুড়সুড়ি দিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে চলে যাবে। আমাদের কথা কেউ ভাবে না। নাহলে আমাদের এখানে এই জিনিস কেউ কখনও স্বপ্নেও ভাবতে পারে না।”
[আরও পড়ুন: পাকিস্তান ছেড়ে পালাতে পারবেন না ইমরান খানের মন্ত্রীরা, মন্ত্রিসভার প্রথম বৈঠকেই বড় সিদ্ধান্ত শরিফের]
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে প্রায় একই ধরনের কথা শোনা গেল জাহাঙ্গিরপুরীর আনাচে-কানাচে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এলাকার সংস্কৃতি মেনে সম্প্রীতির কথা শোনা গেলেও মাঝেমধ্যে অনেকের মুখ ফসকে আবার বেরিয়ে এল সাম্প্রদায়িক কয়েকফোঁটা বিষও। তাহলে কি সম্প্রদায়কে হাতিয়ার করে যাঁরা রাজনীতির রুটি সেঁকছেন, তাঁরা ধীরে হলেও সাফল্য পাচ্ছেন? যদি সত্যিই তা হয়, সেক্ষেত্রে বিবিধের মধ্যে ঐক্যের মেয়াদ আর কতদিন, তা নিয়েও উঠতে পারে প্রশ্ন।