shono
Advertisement

হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্ট আর খুঁজে পাওয়া পতাকা

উদ্বাস্তু তাঁরা, শরণার্থী কোনও না কোনও দেশের৷ কারণ গৌণ, শরণ মুখ্য৷ শরমে মরে-মরে বেঁচে থাকতে হবে তাই৷  The post হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্ট আর খুঁজে পাওয়া পতাকা appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 06:54 PM Aug 12, 2016Updated: 01:24 PM Aug 12, 2016

কাশীনাথ ভট্টাচার্য: যাঁদের স্থায়ী ঠিকানা নেই, ভিটেমাটিছাড়া, যাঁদের গায়ে অভিধান লেবেল সেঁটেছিল শরণার্থী বলে, তাঁদের এখন দেশ আছে, সব দেশে৷ তাঁরা ওলিম্পিক রাষ্ট্রের নাগরিক৷ পঞ্চবলয়ের পতাকাই তাঁদের পরিচয়৷ ‘টিম অফ রিফিউজি ওলিম্পিক অ্যাথলিটস’-এ গোটা বিশ্বের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন ওঁরা৷  

Advertisement

শব্দের গায়েই কি লেগে থাকে তাচ্ছিল্য, কুণ্ঠা?

কিছু কিছু শব্দ থাকে এমন৷ যেমন ‘রিফিউজি’৷ যাদের কোনও বাসস্থান নেই, ভিটেমাটিছাড়া৷ যে আশ্রিত৷ আশ্রয় দিতে হয়েছে, মানে, তার আশ্রয় ছিল না৷ সুতরাং, তাচ্ছিল্যের পাত্র৷ যে আশ্রয় দিয়েছে, তুলনায় বড়৷ যে পেয়েছে, ছোট৷ তাকে থাকতে হবে কুঁকড়ে৷ দাতা আর গ্রহীতা৷ দ্বিতীয়জন সর্বদা যেন মনে রাখে উপকারীর উপকার৷ কোন পরিস্থিতিতে, কীভাবে তাকে ছেড়ে আসতে হয়েছে ঘর-পরিজন, উপন্যাস হতে পারে৷ তা পড়ে কারও কারও চোখে জলের ধারা৷ কিন্তু রিফিউজির চোখের জল মোছে না৷ অপাংক্তেয় সে৷ তাকে আদর করে ডেকে নেয়নি কেউ৷ শব্দটাই মনে করিয়ে দেয় সব৷ বড় কুণ্ঠা জড়ানো এ-শব্দের সর্বাঙ্গে৷

মানুষ ব্যস্ত যু‌দ্ধে৷ জীবনযাপনের যু‌দ্ধে নয়৷ এ-যুদ্ধ অহমিকার৷ আমার দেশ, আমার ধর্ম, আমার মতবাদ৷ আমার, তাই শ্রেষ্ঠ৷ অন্যের হলে কিছুতেই নয়৷ সেই যুরে আগুনে পুড়ে যায় সব৷ ঘর, আত্মীয়স্বজন, দেশ৷ পড়ে থাকে ছাই৷ আর ছাইমাখা কিছু মানুষ৷ কোনওরকমে বেঁচে গিয়েছে যাঁরা৷ বেঁচে আসলে গিয়েছে মরে!

এই মুহূর্তে বিশ্বে এমন মানুষের সংখ্যা সাড়ে ছ’কোটি, সরকারি খাতায়৷ বেসরকারি হিসাব রাখবে কে? তা-ও আবার অদরকারিদের! উদ্বাস্তু তাঁরা, শরণার্থী কোনও না কোনও দেশের৷ কারণ গৌণ, শরণ মুখ্য৷ শরমে মরে-মরে বেঁচে থাকতে হবে তাই৷

ওলিম্পিক মানে মিলনমেলা৷ খেলার বিশ্বে উজ্জ্বলতম আসর৷ সব দেশের সেরারা সুযোগ পান৷ তাঁরা বরেণ্য, স্মরণীয়৷ নিজেদের দক্ষতাকে আরও উঁচুতে তুলে ধরতে হাজির ওলিম্পিকে৷ যোগ্যতা অর্জন করতে হয়৷ চাইলেই টিকিট মেলে না৷ তবু থাকে রাজনীতি৷ যোগ্যকে যোগ্যতর হয়ে উঠতে অযাচিত সাহায্যের হাত বাড়ায় অনৈতিক বিজ্ঞান৷ দেশ-কাল-সমাজ, ভারী ভারী ব্যাপার৷ আনন্দের মিলনমেলার পরতে পরতে কত কিছু৷ ওলিম্পিক আদর্শ যা কোনও বর্ণ-জাতি-গোষ্ঠী মানে না, নুয়ে পড়ে সময়-সময়, রাজনৈতিক চাপে৷ তর্ক-বিতর্ক, আলোচনা-সমালোচনা৷ শেষে অবশ্যই উত্থান শুভশক্তির৷ পঞ্চবলয়ের পতাকাতলে ঝলমলে দক্ষতার জয়গান৷ সেই ওলিম্পিকই আবার দেখাল নতুন পথ৷ আন্তর্জাতিক খেলায় যা বেনজির৷ দেশে-দেশে ওই অপাংক্তেয় শরণার্থীদের তুলে আনল আলোয়৷ তাঁরা এখানে যাচিত৷ আদর করে ডেকে-আনা৷ পঞ্চবলয়ের পতাকা তাঁদের পরিচয়৷ তাঁদের এখন দেশ আছে, সব দেশে৷ তাঁদের এখন পরিচয় আছে, ওলিম্পিক রাষ্ট্রের নাগরিক৷ পাসপোর্টের রং দেখছেন না কেউ৷ কী পরিস্থিতি তাঁদের বাধ্য করেছিল ভিটেমাটি ছাড়তে, আদৌ গুরুত্বপূর্ণ নয়৷ অনন্যোপায় অতীত ভুলে শুধুই সামনে তাকানো৷ নিজেদের তুলে ধরা সেই আসরে যেখানে হাজির হতে হাপিত্যেশ বিশ্বের তাবড় তারকার৷ তাঁরা এখন বাসিন্দা ওলিম্পিক ভিলেজের৷ বিশ্বের সবচেয়ে গৌরবময় বাসস্থান বললেও অত্যুক্তি হয় না৷

বিশ্বব্যাপী নিদারুণ এই উদ্বাস্তু সমস্যা সম্পর্কে বিশ্বকে সচেতন করে দেওয়ার এই ওলিম্পিক-প্রচেষ্টা নিঃসন্দেহে প্রশংসাযোগ্য৷ ওলিম্পিক কমিটি ভেবেছিল, শুধুই আরও একটা ওলিম্পিক আয়োজনের দায়িত্ব পালন করলেই দায়িত্ব ফুরোয় না৷ যে-সংকট পৃথিবীকে ভাবাচ্ছে, খেলার আসর কেনই বা দূরে থাকবে তার থেকে? রাষ্ট্রপুঞ্জকে জানিয়েছিল সে-কথা৷ ইউনাইটেড নেশনস হাই কমিশনার ফর রিফিউজিস (ইউএনএইচসিআর) আগ্রহী হয়৷ খোঁজ শুরু হয় বিশ্বের বড়-বড় শরণার্থী শিবিরগুলোতে৷ জানাই ছিল, শরণার্থীদের ৫০ শতাংশেরই বয়স আঠারো বা তার আশপাশে৷ তাঁরা যে-দেশের, সেই দেশের ওলিম্পিকে যোগ্যতামান নিয়ে মাথা ঘামায়নি আন্তর্জাতিক ওলিম্পিক কমিটি৷ বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা শিবিরগুলিতে যাঁরা সেরা, তাঁদের বেছে নেওয়ার কথা ভাবে৷ প্রাথমিকভাবে তাতে নির্বাচিত হয়েছিলেন ৪৩ জন৷ পরে সেই ৪৩ থেকে চূড়ান্ত ১০ জন জায়গা পান ‘টিম অফ রিফিউজি ওলিম্পিক অ্যাথলিটস’-এ৷

সেই দশজনের মধ্যে পুরুষ ছ’জন, মহিলা চারজন৷ কেনিয়ার কাকুমা আর দাদাব-এ প্রায় পাঁচ লক্ষের বেশি উদ্বাস্তুর আশ্রয়৷ শুধু দাদাবেই সাড়ে তিন লক্ষের কাছাকাছি৷ কেনিয়া মানে ওলিম্পিকের আসরে লং ও মিডল-ডিসট্যান্স দৌড়৷ আর কেনিয়া থেকেই এই ওলিম্পিকে রিফিউজি দলের সদস্য পাঁচজন৷ দুই মেয়ে অ্যাঞ্জেলিনা লোহালিথ (দেশ দক্ষিণ সুদান, ১৫০০ মিটার) ও রোজ লোকোনইয়েন (দেশ দক্ষিণ সুদান, ৮০০ মিটার)৷ তিন পুরুষ প্রতিযোগীঃপাওলো লোকোরো (দেশ দক্ষিণ সুদান, ১৫০০ মিটার), জেমস চিয়েঙ্গজিয়েক (দেশ দক্ষিণ সুদান, ৪০০ মিটার), ইয়েচ বিয়েল (দেশ দক্ষিণ সুদান, ৮০০ মিটার)৷

বাকি পাঁচ সদস্যের মধ্যে জুডোকা দু’জনই কঙ্গোর, আশ্রয় পেয়েছেন ব্রাজিলে৷ পুরুষ পোপোল মিসেঙ্গা, মেয়ে বুকাসা মাবিকে৷ ম্যারাথনার ইয়োনাস কিন্ডের দেশ ছিল ইথিওপিয়া, এখন শরণার্থী লুক্সেমবুর্গে৷ আর দুই সাঁতারু৷ সিরিয়ার ছেলে ব়্যামি অ্যানিস ছিলেন সিরিয়ায়, এখন বেলজিয়ামে৷ ইউস্রা মার্দিনি সিরিয়া থেকেই আশ্রয় নিয়েছেন জার্মানিতে৷

প্রত্যেকের গল্প আলাদা, পরিণতি এক৷ মার্দিনি যেমন সিরিয়া থেকে লেবানন ও তুরস্কের ভিতর দিয়ে পৌঁছেছিলেন ইজিয়ন সাগরের ধারে৷ ওখান থেকে নিয়মিত নৌকো ছাড়ে বেআইনিভাবে, সাগরতীরের কোনও দেশের জন্য৷ মার্দিনির সঙ্গী ছিল বোন সারা৷ বাড়ির আর কেউ বেঁচে নেই৷ সর্বনাশা আগুনে সব ছারখার৷ যেখানে থাকতেন, সারাক্ষণ গুলি চলছে, উড়ে এসে পড়ছে বোমা৷ মানুষ পালিয়েছে যে যেদিকে পারে৷ বোনের হাত ধরে বেরিয়ে পড়েছিলেন মার্দিনি৷ সেই নৌকোয় সাগরপাড়ি শুরু, ইউরোপের যে কোনও ভূখণ্ডের উদ্দেশে৷ নৌকোয় ভিড় অন্তত ১৮টি দেশের একই সমস্যায় থাকা অনেকের৷

কিন্তু ‘অভাগা যে দিকে চায়, সাগর শুকায়ে যায়’৷ তীর দেখা যাচ্ছে দূরে, খারাপ হয়ে গেল নৌকোর মোটর৷ প্রাণভয়ে ঝাঁপ দিতে চেয়েছিলেন কেউ কেউ৷ মার্দিনি ও আর এক মহিলা ঝাঁপিয়ে পড়েন সাগরের জলে৷ সাঁতরে নৌকো টেনে নিয়ে যান তীরে৷ তিনঘণ্টার অমানুষিক পরিশ্রম৷ যেখানে পৌঁছন শেষপর্যন্ত, গ্রিসের লেসবস দ্বীপ৷ তারপর যে যার মতো ছড়িয়ে পড়েন ইউরোপের নানা দেশে৷ মার্দিনি চলে এসেছিলেন বার্লিনে৷ জার্মানিতে এসে মাথা গোঁজার ঠাঁই জোগাড় করে মন দিয়েছিলেন সাঁতারে৷ আর ওলিম্পিকের দলে জায়গা পেয়ে জানিয়েছিলেন, ‘একজন সাঁতারুর পক্ষে জলে ডুবে মরে যাওয়াটা লজ্জাজনক হত, তাই না!’

চেনেন না, জানেন না কাউকেই৷ আলাপ তো ওই নৌকোয় ওঠার সময়৷ কিন্তু নৌকো সাগর থেকে তীরে সাঁতরে-সাঁতরে টেনে নিয়ে যাওয়ার কাজটা করেছিলেন স্বেচছায়৷ জানতেন শুধু, সবাই এক সমস্যার নৌকোয় সওয়ার৷ জীবনের ঝুঁকি যাঁদের প্রতিপদে, এমন পরিস্থিতিতেও সহযাত্রীদের ভুলে নিজেদের প্রাণ বাঁচানোর কথা ভাবেন না৷

আপনার ২১ সোনার প্রতিটিই দামি, মাইকেল ফেল্পস৷ কিন্তু, মার্দিনির এমন প্রচেষ্টা অমূল্য৷ বোধহয় বেশি কাছাকাছি ওলিম্পিক-স্পিরিটের৷ মার্দিনি আদৌ পদক পেলেন কি না, কী আসে যায়!

The post হারিয়ে যাওয়া পাসপোর্ট আর খুঁজে পাওয়া পতাকা appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement