রবীন্দ্রনাথের ‘বিসর্জন’-এর নাট্য রূপান্তর করছেন অঞ্জন দত্ত। তাঁর সিনেমায় ‘শ্রীকান্ত’-র পর এই নাটকে ‘জয়সিংহ’ হচ্ছেন সুপ্রভাত। কোন ভাবনা এই নাটকের নেপথ্যে ? লিখছেন অঞ্জন দত্ত স্বয়ং।
‘সালেস্মনের সংসার’ কিছু মানুষের ভাল লাগার পর মনে হয়েছিল আলবার্ট কামুর নাটক করব। ক্রস পারপাস। ১৯৭৮ সালে আমি সার্ত্রের নাটক দিয়ে বাংলায় আমার নাট্যজীবন শুরু করি। পরপর দুটো সার্ত্রে। তারপর জিন জেনেট। অস্তিত্ববাদ দর্শন হিসেবে আমাকে টানে। মার্কসবাদ নিয়ে যথেষ্ট পড়াশোনা করার পরেও আমার মনে হয়েছে ব্যক্তিস্বাধীনতার জায়গা থেকে অস্তিত্ববাদ আমার কাছে বড়। কোথাও গিয়ে আমি নিজেও সামাজিকভাবে একজন আউটসাইডার। তাই আলবার্ট কামু। নাটকটা অনুবাদ করা শুরু করে দিয়েছিলাম। তারপর দেশে নির্বাচনের ফলাফল বেরল। আমরা সবাই একটা ভয়ংকর সময়ে এসে দাঁড়ালাম। চারিদিকে ধর্মের রাজনীতি এবং হিংসা। ভারত সত্যি-সত্যি একটা খুবই একটা বড় ধরনের বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে। অসহিষ্ণুতা, ধর্মের নামে খুন। হিন্দু ধর্মের বিশালতাকে নষ্ট করে একেবারে একটা নিম্ন মানের গুন্ডামিতে নামিয়ে আনা হচ্ছে। এই ৬৫ বছর বয়সে এসে আমার প্রথম সত্যি-সত্যি ভয় করছে। আমি তিনটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা দেখেছি। কিন্তু এইরকম প্রবলভাবে গোটা দেশকে, আমার নিজের দেশকে এত ভয় পাইনি। তাই মনে হয়েছে চারপাশের, এই ভয়ংকর সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থাটাকে যদি কোনওভাবে আমার নিজের কাজের মধ্যে সরাসরি নিয়ে আসা যায়।
[আরও পড়ুন: ‘আত্মানং সততং রক্ষে’… ]
আমি কোনওদিন মূল বাংলা নাটকের রূপান্তর করিনি। চিরকালই বিদেশি ক্লাসিক করেছি। আজ আমার ভীষণভাবে নিজের দেশের লেখা নাটক করতে ইচ্ছে করছে। তাই রবীন্দ্রনাথে ফিরে গেলাম। ওঁর ‘বিসর্জন’ নাটকটা আবার বেশ কয়েকবার মন দিয়ে পড়লাম। আমার মনে হয়েছে এই বহু চর্চিত, যুগ-যুগ ধরে বহুবার করা নাটকটাকে যদি আবার সম্পূর্ণভাবে ভেঙে, বদলে অর্থাৎ ডিকন্সট্রাক্ট করে আঙ্গিক-এর জায়গা থেকে এডিট করে, নতুনভাবে মঞ্চস্থ করা যায়। ‘ছাগল বলি’কে ‘নরবলি’ কিংবা সরাসরি বিজাতীয়দের ‘বলি’ করা যায়। রঘুপতি আর রাজা গোবিন্দমাণিক্যর লড়াইটা যদি হিন্দু ধর্ম বনাম রাজনীতির লড়াই হয়। অর্থাৎ রঘুপতির কাছে যদি ছাগল, গরু, মুসলমান, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ- সবাই মন্দিরের দেবতার কাছে ‘বলি’ দেওয়ার যোগ্য হয়। যদি অপর্ণা মুসলমান হয়। যদি জয়সিংহ তার প্রেমে পড়ে, তার এতদিনকার শিখে আসা প্রথাকে প্রশ্ন করতে শুরু করে। যদি সংঘাতটা সরাসরি আজকের পরিপ্রেক্ষিতে হয়। গোটা নাটকটা যদি চলিত ভাষায় হয়। অনেক কিছু বাদ দিয়ে যদি রঘুপতি আর জয়সিংহ-র কনফ্লিক্টটা বড় করে দেখা যায়।অনেক প্রবলভাবে প্রাসঙ্গিক রবীন্দ্রসংগীত বা বাউল বা অন্যান্য গান নতুনভাবে অ্যারেঞ্জ করে ব্যবহার করা হয়। আমি ‘বিসর্জন’ নামটা উল্লেখ না-করে যদি নাটকের নাম রাখি ‘রঘুপতি’। কীরকম হয়?
আপাতত ঠিক করেছি ‘রঘুপতি’র পার্টটা আমি নিজে করব। সুপ্রভাত ‘জয়সিংহ’ করবে। বাকি চরিত্রগুলো কারা করবে এখনও ঠিক করে উঠিনি। তবে সংগীত পরিচালনা করবে নীল দত্ত। গোটা মঞ্চ এবং পোশাকের ডিজাইন করব আমি আর ছন্দা (দত্ত) দু’জনে মিলে।
[আরও পড়ুন: ‘ভাটপাড়া ইস্যুতে আশ্বস্ত করেছেন মুখ্যমন্ত্রী’, নবান্ন থেকে বেরিয়ে বললেন কৌশিক সেন]
ডিসেম্বরে মঞ্চস্থ করার কথা ভাবছি। মাত্র পাঁচটা চরিত্র থাকবে। অনেক এডিট করব। মূল নাটকের কাঠামো বা সংলাপ থেকে সরে না গিয়েও, স্রেফ কয়েকটা দৃশ্য বেছে নিয়ে এই কাজটা করা সম্ভব। এই জন্যই তো থিয়েটার। একমাত্র থিয়েটারেই এই ধরনের কাজ করা যায়। আজ আমার কাছে রবীন্দ্রনাথ বড়ই প্রাসঙ্গিক। সিনেমাতে যদি শরৎচন্দ্রে ফিরে যেতে পারি তাহলে নাটকে রবীন্দ্রনাথ নয় কেন? আজ এই বয়সে এসে আমার নিজের দেশের ক্লাসিক আমার কাছে ক্রমশ বড় হয়ে উঠছে।
অনেকে মনে করেন আমি যেহেতু দার্জিলিংয়ে বড় হয়েছি, একটু অ্যাংলিসাইজ জীবন যাপন করি, প্রবলভাবে শহুরে গান বা সিনেমা বানাই, আমি হয়তো আমার দেশের মূল শিকড় থেকে দূরে। আমি থিয়েটারকে আন্তর্জাতিক জায়গা থেকে দেখি। আমি বিশ্বাস করি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো আন্তর্জাতিক মানুষ পৃথিবীতে কম ছিল এবং আছে।
The post ভারত সত্যিই খুব বড় ধরনের একটা বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে: অঞ্জন দত্ত appeared first on Sangbad Pratidin.