প্রিয়ক মিত্র: বাদল সরকারের (Badal Sarkar) ‘বাকি ইতিহাস’ যেমন ধারণ করেছিল ঐতিহাসিকতার রক্তলেখা ও যুদ্ধ-দাঙ্গার দগ্ধ ইতিহাস, তেমনই ব্যক্তির ভিতর থেকে তা ছেঁচে আনতে চেয়েছিল না চিনতে চাওয়া হননেচ্ছা, না চিনতে চাওয়া অর্থহীনতা। বাপ্পার পরিচালনায় ‘শহরের উপকথা’ (Sohorer Upokotha) বাদল সরকারের এই কালজয়ী নাটকের চিত্ররূপ।
সময়ের প্রেক্ষাপট ও চরিত্রদের নাম পালটে গেলেও এই নাটকের কাহিনিসার এই ছবিতে একই রয়ে গিয়েছে। কিন্তু ‘বাকি ইতিহাস’ কোনওদিনই কেবলমাত্র কাহিনি-নির্ভর নাটক নয়। আশরাফ শিশিরের চিত্রনাট্য নাটকের অন্তর্দর্শনকে ধরতে পারেনি। বাদল সরকারকে কাল্পনিক চরিত্র হিসাবে আনা হয়েছে এই সময়ের এক সংশয়াকুল কিন্তু স্বপ্ন দেখা তরুণ পরিচালক অনিন্দ্যর মুখোমুখি। সে ‘বাকি ইতিহাস’ নিয়ে ছবি করতে চায়। অন্যদিকে, সমান্তরালেই শুরু হয় ‘বাকি ইতিহাস’-এর চরিত্রদের গল্প।
শরদিন্দু-বাসন্তী ছবিতে হয়ে উঠেছে মৃগাঙ্ক-মৌমিতা, সীতানাথ-কণা হয়েছে ঋত্বিক-তনিমা। ১৯৬৫ সালে নাইজেরিয়ায় বসে লেখা এ নাটকে বাদল সরকার সীতানাথের সংলাপে তুলে এনেছিলেন মহাভারতের নিষাদ হত্যা থেকে হিটলারের কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্প বা হিরোশিমার কথা, ‘শহরের উপকথা’-র ঋত্বিকের সংলাপে তার সঙ্গে যুক্ত হয় আসিফা, লকডাউনে পরিযায়ী শ্রমিকের মৃত্যু, সিরিয়ায় শিশুমৃত্যুর ঘটনা।
[আরও পড়ুন: Baazi Movie Trailer: বক্স অফিসের ‘বাজি’ জিততে মরিয়া জিৎ, সঙ্গী মিমি]
কিন্তু এতকিছুর পরেও এই নাটকের দার্শনিকতার নেহাত উপরিতলটুকু ছোঁয় চিত্রনাট্য। প্রথম দৃশ্যেই ‘বিপ্লব’ নামের বইয়ের দোকানির আরোপিত সংলাপ, শেষে মুক্ত বাজার অর্থনীতির সামনে শিল্পের অসহায়তার কথা– এ সবই যেন বাদল সরকারের চিন্তার থেকে দূরগামী। বাদল সরকারকে কেবলই ‘থার্ড থিয়েটার’ দিয়ে চেনা যায় না – একথাও বোঝা প্রয়োজন। ঋত্বিক-মৃগাঙ্কর সংলাপে দুম করে সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিবাদ ও মোমবাতি মিছিলের সমালোচনা কেন আসে, তার কোনও যৌক্তিকতা থাকে না।
অভিনয় এই ছবির আসল সম্পদ। অনিন্দ্যর চরিত্রে রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিচু তারের অভিনয় চরিত্রের মেজাজ ধরে রাখে। শুভাশিস মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়ে বাদল সরকার অসম্ভব জীবন্ত। মৃগাঙ্কর চরিত্রে অনিন্দ্যপুলক বন্দ্যোপাধ্যায় নিখুঁত, সাবলীল এবং উজ্জ্বল লাগে মৌমিতার চরিত্রে বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায়কে। তনিমার চরিত্রে বিদীপ্তা চক্রবর্তীর অভিনয় অনুভূতির স্বরলিপি ধরে রাখে। ঋত্বিকের চরিত্রে জয় সেনগুপ্ত কিছু কিছু জায়গায় উচ্চকিত হলেও তাঁর উপস্থিতি এই ছবির অনেকাংশকে বেঁধে রাখে। ছোট পরিসরে ভাল লাগে প্রদীপ ভট্টাচার্য, লামা, দেবরঞ্জন নাগ এবং রজত গঙ্গোপাধ্যায়কে। অনির্বাণ মাইতির সম্পাদনা এই ছবির বুননকে জমাট করেছে। সৌম্য ঋত-এর সংগীত ছবির সঙ্গে সংশ্লেষে যেতে পারে না যেন।
ছবির নাম – শহরের উপকথা
অভিনয়ে – শুভাশিস মুখোপাধ্যায়, রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়, বাসবদত্তা চট্টোপাধ্যায়, বিদীপ্তা চক্রবর্তী, জয় সেনগুপ্ত, অনিন্দ্যপুলক বন্দ্যোপাধ্যায়
পরিচালনা – বাপ্পা