রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: ফিনফিনে, শীর্ণকায়, স্বল্প শ্মশ্রু-গুম্ফের যে বছর একুশের যুবক শুক্রবারের ইডেন ক্লাবহাউসে দাঁড়িয়ে ছিলেন, আম বাঙালি ক্রিকেট-জনতার তাঁকে চেনার কথা নয়। নাম–দীপক প্যাটেল। নিবাস–নাগপুর। তা, নজরে পড়ার মতো চেহারাপত্তর না হলেও যুবকের পরিচয় বেশ বেড়ে, নজরকাড়া। শচীন তেণ্ডুলকরের যেমন সুধীর গৌতম। মহেন্দ্র সিং ধোনির যেমন রাম বাবু। রোহিত গুরুনাথ শর্মার (Rohit Sharma) তেমন ইনি। নাগপুরের দীপক প্যাটেল।
সুপার ফ্যান!
ক্লাবহাউসে শুক্র-সন্ধেয় দাঁড়িয়ে বলছিলেন, ভারত অধিনায়কের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করতে গিয়ে পরিবারের গঞ্জনা, নিরাপত্তারক্ষীর মার, কম কিছু সহ্য করতে হয়নি। সেই ২০১৭ থেকে রোহিত নিয়ে পাগলামি শুরু যুবকের। মুম্বইয়ের (Mumbai Indians) হয়ে খেললেও রোহিতের জন্ম নাগপুরে। নিজের জন্ম-রাজ্যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সঙ্গে টেস্ট খেলতে গিয়েছিলেন রোহিত, সেঞ্চুরি করেছিলেন, অজ্ঞাতপরিচয় দীপক সে খেলা দেখতে গিয়ে খোঁজ পেয়ে গিয়েছিলেন আরাধ্যের। ‘‘এখন ভাবলে গায়ে কাঁটা দেয়। এককালে রোহিত-ভাইয়ের কাছাকাছি পৌঁছতে গিয়ে প্রচুর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে আমাকে। সেই রোহিত ভাই এখন দেশে-বিদেশে আমার খেলা দেখতে যাওয়ার খরচ দেন,’’ ফুরফুরে হাসিতে ছেয়ে যায় দীপকের মুখ। শুনলাম, রোহিত নাকি ইতিমধ্যে দীপকের পাসপোর্ট চেয়ে নিয়েছেন। সামনেই টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ আসছে। আইপিএল (IPL 2024) সমাপ্ত হওয়া মাত্র যার ঢাকে কাঠি পড়ে যাবে। দীপক বলছিলেন, ভারত অধিনায়ক নাকি তাঁকে বলেছেন যে, মার্কিন যুক্তরাষ্টে নিয়ে যাওয়া যদি বা কঠিনও হয়, বিশ্বকাপের ক্যারিবিয়ান-পর্বে অবশ্যই নিয়ে যাবেন! বলতে-বলতে নিজের হাত, কব্জি, ঘাড় দেখান নাগপুর যুবক। সর্বত্র রোহিত, রাশি-রাশি রোহিত। কোথাও বাংলা-সহ ন’টা ভাষায় রোহিতের নাম। কোথাও তাঁর মুখ। কোথাও তাঁর সই।
[আরও পড়ুন: ‘হৃদমাঝারে রাখব, ছেড়ে দেব না’, গম্ভীরের জন্য হৃদয় উজাড় করা ভালোবাসা নাইট ভক্তদের]
আগ্রহী হয়ে জিজ্ঞাসা করি, রোহিতের মুম্বই ইন্ডিয়ান্স নেতৃত্ব চলে যাওয়ার দিন কতটা উথাল-পাথাল চলেছিল তাঁর ভেতরে, তাঁর মনে? শোনামাত্র কেমন যেন বিষন্ন হয়ে যান যুবক। বলে দেন, ‘‘খারাপ লেগেছিল। কিন্তু এটা তো দিন শেষে ফ্র্যাঞ্চাইজির সিদ্ধান্ত। তবে রোহিত ভাই যেখানে যাবে, আমিও সে দলের সমর্থক হয়ে যাব।’’ যদি রোহিত কেকেআরে আসেন? এবার চটজলদি উত্তর আসে, ‘‘তা হলে আমিও কেকেআর!’’
সময়! সময় বড়ই বেয়াদপ বস্তু। সময় সময় সে এতটাই বেয়াদপি করে যে, সমার্থক শব্দদেরও বিপথগামী লাগে! চেন্নাই সুপার কিংসের সমার্থক যেমন মহেন্দ্র সিং ধোনি, মুম্বই ইন্ডিয়ান্সেরও তো তাই ছিলেন রোহিত। সমার্থক শব্দ। অধিনায়কত্বের দশ বছরে ফ্র্যাঞ্চাইজিকে পাঁচ-পাঁচখানা আইপিএল ট্রফি দিয়েছেন যিনি। বছরখানেক আগে পর্যন্ত রোহিত ছাড়া মুম্বই ভাবা যেত না। আর আজ? হার্দিক পাণ্ডিয়াকে মুম্বই অধিনায়ক করে আনার পর কি না দেশজুড়ে জল্পনা চলছে, আগামী বছর রোহিত আদৌ আর মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে থাকবেন তো? অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজি চলে যাবেন না তো?
ভারতীয় ক্রিকেটের হাওয়া-বাতাসের খবর ধরলে, রোহিত গুরুনাথ শর্মার মুম্বই ইন্ডিয়ান্সে থেকে যাওয়ার সম্ভাবনা নাকি বেশ কম। কারও কারও মতে, আগামী ট্রেডিং উইন্ডোয় অন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিতে চলে যেতে পারেন রোহিত। কারণ, মুম্বই ইন্ডিয়ান্স আগামীর দিকে তাকাবে বলে হার্দিককে অধিনায়ক করে এনেছে গুজরাত টাইটান্স থেকে। একটা মরশুম খারাপ গিয়েছে বলে মুম্বই হার্দিককে নেতৃত্ব থেকে সরিয়ে দেবে, ভাবা ভুল। আর স্বয়ং ভারত অধিনায়ককে পেতে কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি চাইবে না? অধিনায়কত্ব সমস্যায় তো ভুগছে বেশ কয়েকটা টিম। পাঞ্জাব কিংস। লখনউ সুপার জায়ান্টস। দিল্লি ক্যাপিটালস শোনা যায়, গত ট্রেডিং উইন্ডোতেই রোহিতের জন্য ঝাঁপিয়েছিল। কেকেআর যতই ভালো খেলুক, শ্রেয়স আইয়ার এখনও পর্যন্ত অধিনায়কোচিত কিছু করতে পারেননি। উপরোক্ত যে ক’টা ফ্র্যাঞ্চাইজির কথা লিখলাম, কোনটায় বেমানন হবেন রোহিত? কোন ফ্র্যাঞ্চাইজি তাঁকে নিতে অনাগ্রহী হবে? তা ছাড়া গতকালই প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ্য হয়েছে যে, রোহিত-বুমরাহ-সূর্যকুমারের মতো তিন জন সিনিয়র ক্রিকেটার নাকি অধিনায়ক হার্দিক পাণ্ডিয়ার নামে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ম্যানেজমেন্টের কাছে অভিযোগনামা জমা করে দিয়েছেন। মুম্বইয়ের দক্ষিণ আফ্রিকা পেসার জেরাল্ড কোয়েৎজেকে ড্রেসিংরুম সম্পর্কিত ঝঞ্ঝা নিয়ে জিজ্ঞাসা করায় তিনি বললেন বটে যে, ‘‘আমাদের ড্রেসিংরুম একদম ঠিক আছে।’’ কিন্তু সে বক্তব্যকে মোটেও জোরালো শোনাল না। বরং মাঠের ছবি-কোলাজ তুলনায় অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য লাগল। রোহিত একদিকে দাঁড়িয়ে। হার্দিক আর এক দিকে। সব কেমন যেন এক-একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। রোহিত এ দিন ব্যাটিংও করলেন না। সচরাচর খেলার আগের দিন করেন না যেমন। নেটের পাশে দাঁড়িয়ে বাকি টিমের রগড়ানি দেখছিলেন নিরন্তর।
[আরও পড়ুন: ‘এটাই আমার শেষ বছর’, ভাইরাল রোহিত-অভিষেকের কথোপকথন, বাধ্য হয়ে ডিলিট করল কেকেআর]
অতঃপর?
অতঃপর, মুম্বইয়ের ঝলমলে নীল জার্সিতে শনিবারই হয়তো শেষ ইডেন-সফর রোহিতের। যদি না ঘটে উথাল-পাথাল, যদি না ঘটে মহানাটকীয় পট পরিবর্তন। রোসো, সময় আছে, দেখা যাক। আপাতত শহর একটা জিনিস চায়, সমগ্র দেশ একটা জিনিস চায়। চায়, অফ ফর্মের গ্রাসে ঢেকে থাকা রোহিত শর্মার ফর্মের নান্দীমুখ লিখে দিক ইডেন। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের আগে যা স্বস্তির ঝড়-জল দেবে দেশবাসীকে। ইডেনের সঙ্গে যে কম সুখস্মৃতি জড়িয়ে নেই ‘হিটম্যানের’। প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি, প্রথম রনজি সেঞ্চুরি, প্রথম আইপিএল সেঞ্চুরি, প্রথম আইপিএল জয়, শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ২৬৪ রানের বিশ্বরেকর্ড– রোহিতের সব ইডেনে। এবং ইডেনের সঙ্গে গ্রন্থির টান ‘শর্মাজি কা বেটা’-র এতটাই নিবিড় যে, তাঁর একটা স্বতন্ত্র নামও আছে। যে নাম মহম্মদ আজহারউদ্দিনের আছে। যে নাম ভিভিএস লক্ষ্মণের আছে।
ইডেন গার্ডেন্স কা বেটা!