মণিশংকর চৌধুরী: কোক বিজ্ঞাপন বিতর্ক থেকে সিঙ্গুরে ‘ন্যানো অধ্যায়’। বামেদের ‘ইজম’ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে বহুবার। ‘শ্রেণিশত্রুর সংজ্ঞা পালটে ফেলেছেন কমরেডরা’ বলেও কটাক্ষ করেছেন অনেকে। এনিয়ে খোদ সিপিএম দলের অন্দরেও টানাপোড়েন কম কিছু নয়। এহেন পরিস্থিতিতে সিপিএম-এর মুখপত্র ‘গণশক্তি’তে ভারতীয় রেলের একটি বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে দানা বেঁধেছে বিতর্ক। অনেকের মতে, বিজ্ঞাপনের অছিলায় টাকার বিনিময়ে বাম কর্মীদের মধ্যে নিজেদের ভাবধারা প্রচার করছে গেরুয়া শিবির। আর সব জেনেও মৌন আলিমুদ্দিন স্ট্রিট।
আজ সোমবার ‘গণশক্তি’তে ভারতীয় রেলের একটি বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে রানাঘাট-বনগাঁ নতুন ইএমএউ ট্রেনের যাত্রার সূচনার কথা প্রচার করা হয়েছে। ওই বিজ্ঞাপনে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ছবির সঙ্গে রয়েছে তাঁর বার্তা। বার্তাটি হচ্ছে, ‘ভারত কীভাবে বদলে যাচ্ছে, কীভাবে সফল হচ্ছে স্বপ্ন, তারই এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত ভারতীয় রেল’। শুধু তাই নয়, বিজ্ঞাপনে নাম রয়েছে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারীর। নাম রয়েছে রানাঘাটের বিজেপি সাংসদ জগন্নাথ সরকার এবং রানাঘাট উত্তর-পশ্চিমের বিধায়ক পার্থ সারথী চট্টোপাধ্যায়ের। ফলে, রেলের বিজ্ঞাপনে রাজনীতির রং দেখছেন অনেকে। বিশ্লেষকদের একাংশ আবার মনে করছেন, বিজ্ঞাপনের অছিলায় টাকার বিনিময়ে বাম কর্মীদের মধ্যে নিজেদের ভাবধারা প্রচার করছে গেরুয়া শিবির। আর সব জেনেও চুপ আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। প্রশ্ন উঠছে, বিজ্ঞাপন বা রেভিনিউ জেনারেট করার নামে কি তাহলে দক্ষিণপন্থার সঙ্গে আপোসের সংকেত দিচ্ছে সিপিএম। শুধুমাত্র টাকার জন্যই কি গণশক্তির পাঠকদের কাছে বিজেপির বার্তা পৌঁছে যাচ্ছে জেনেও নিশ্চুপ আলিমুদ্দিন?
[আরও পড়ুন: বিষ্ণুপুরে ভয়াবহ দুর্ঘটনা, বাইকে বেসরকারি বাসের ধাক্কায় মৃত পুলিশ কর্মী]
সিপিএম সূত্রে বলা হয়েছে, কাগজ চালাতে গেলে টাকা লাগে। আর পাঁচটা সংবাদমাধ্যমের মতোই এক্ষেত্রে বিজ্ঞাপনটি গ্রহণ করা হয়েছে। কেন্দ্রের বিজ্ঞাপন নেওয়া হবে না, এমন কোনও নীতি কোনওকালেই দলের ছিল না। তাই গণশক্তিতে ভারতীয় রেলের উক্ত বিজ্ঞাপনে রাজনীতির রং খোঁজার কোনও কারণ নেই। এটা সংবাদপত্র পরিচালনার অংশ মাত্র।
এই প্রসঙ্গে সিপিএম নেতা সুজন চক্রবর্তীর বক্তব্য, “এটা রেলের বিজ্ঞাপন, এখানে রাজনৈতিক রং খোঁজার কোনও কারণ নেই। এমনিতেও রাজ্য বা কেন্দ্র সরকার আমাদের বিজ্ঞাপন দিতে চায় না। মাঝেমধ্যে এমন দু-একটা বিজ্ঞাপন আসে। এখানে যেমন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মুখ ছাড়া বিজ্ঞাপন হয় না। ওদেরও (বিজেপি) মোদির মুখ ছাড়া হয় না। সিপিএমতো কখনও বলেনি যে আমরা রাজ্য বা কেন্দ্র সরকারের বিজ্ঞাপন ছাপব না।”
পালটা, সিপিএমকে একহাত নিয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র কুণাল ঘোষ বলেছেন, “গণশক্তি একটি দলের কাগজ। এটা আর পাঁচটা সংবাদপত্রের মতো নয়। সেখানে নরেন্দ্র মোদির ছবি দেওয়া হচ্ছে। বিজেপির নেতারা উদ্বোধন করবেন বলে একটা কর্মসূচীর বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়, তাহলে তো এটাই প্রমাণিত হল যে, টাকার জন্য আমি আমার কমরেডদের কাছে বিজেপিকে প্রোমোট করছি। এটাই কি বিজেপির বিরুদ্ধে সিপিএমের নীতিগত লড়াই!”
উল্লেখ্য, তৃণমূল কংগ্রেসের মুখপাত্র ‘জাগো বাংলা’ কিন্তু রাজ্য বা কেন্দ্রীয় সরকার কারওরই বিজ্ঞপন গ্রহণ করে না। তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে, রবিবার ‘বাম বন্দনা’ করতে গিয়ে বামেদের সঙ্গে আঁতাঁতের কথা কার্যত স্বীকার করে নেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। মেনে নেন, বামপন্থীরা ভোট না দিলে নন্দীগ্রামে তিনি জিততে পারতেন না। পালটা তৃণমূল তোপ দাগে, বিরোধী দলনেতার কথাতেই প্রমাণিত নন্দীগ্রামে মুখ্যমন্ত্রীকে হারাতে অশুভ আঁতাঁত তৈরি হয়েছিল।
প্রসঙ্গত, কয়েক দশক আগে ঠান্ডা পানীয় কোকের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছিল গণশক্তিতে। সেটিকে কেন্দ্র করে দেখা দেয় বিতর্ক। পুঁজিবাদী মার্কিন সংস্থার বিজ্ঞাপনকে কেন্দ্র করে সিপিএমের অন্দরেই দেখা দেয় বিরোধ। সে সময় গণশক্তির অ্যাডভার্টাইজমেন্ট ম্যানেজর পঙ্কজ ঘোষ বলেছিলেন, “আমরা কোক বা পেপসিকে বয়কট করিনি। বরং তারাই আমাদের এড়িয়ে চলত।” ইরাক যুদ্ধের সময় কোক বয়কটের ডাক দিয়েছিল রাজ্যের তৎকালীন শাসকদলের একাংশ। তবে বিনিয়োগকারীদের টানতে সেইসময় বয়কটের দাবি থামিয়ে দিয়েছিলেন বামেদের ‘চাণক্য’ অনিল বিশ্বাস। সারদা কেলেঙ্কারির আগে পর্যন্ত চিট ফান্ডের বহু বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়েছে গণশক্তিতে। সবমিলিয়ে, বিজ্ঞাপন বিতর্কে বামেদের ‘ইজম’ নিয়ে আবারও প্রশ্ন উঠছে।একই ভাবে রাজকোষের টাকায় দলীয় মতবাদ প্রচারে অভিযুক্ত হয়েছে বিজেপিও।