একের রক এক হিট ছবি পকেটে রয়েছে যাঁর লোকে তো তাঁকে মানবেই৷ আর তাই ইন্ডাস্ট্রির গডফাদার হওয়া আটকায় কার সাধ্যি? পাক শিল্পীদের দেশে কাজ করার পক্ষে সওয়াল করে মোক্ষম চাল দিলেন ভাইজান৷ কিন্তু দেশ-কাল-পাত্রটা বিবেচনা করলে হত না? লিখেছেন শুভময় মণ্ডল
হাল্লা চলেছে শুন্ডির সঙ্গে যুদ্ধ করতে৷ সেই যুদ্ধ ঠেকাবে কে? সে দায়িত্ব নিজেদের কাঁধে তুলে নিল গুপি-বাঘা৷ গানে-সুরে হাল্লার বিশাল সেনাকে হাঁড়ি হাঁড়ি মণ্ডা-মিঠাই খাইয়ে যুদ্ধ থামিয়েও দিলেন তাঁরা৷ পরে দুই রাজার রাজকন্যাও মিলে গেল৷ ব্যস! সব ভাল যার শেষ ভালর মতো গল্পও ফুরলো, নটে গাছও মুড়োল৷
এখন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধং দেহি পরিবেশ৷ এ বলে, তোকে মারব তো ও বলে, আমিও কি ছেড়ে দেব! সেই যুদ্ধের আঁচ লেগেছে দুই দেশের শিল্পীমহলেও৷ ভারতে করে কম্মে খায় পাকিস্তানি শিল্পীরা৷ অভিনেতা, গায়ক, কৌতুকাভিনেতা আরও কত পাকিস্তানের মানুষ এদেশে রুজি-রুটির আশায় পড়ে রয়েছেন৷ সে নয় ভাল৷ কিন্তু বাদ সাধল দুই দেশের কূটনৈতিক বিরোধ৷ উরি হামলার পর থেকে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কড়া পদক্ষেপ না নিলে দেশের আমজনতা, সংবাদমাধ্যম, রাজনৈতিক দলগুলি তাঁর মুণ্ডপাত করে দেওয়ার জন্য তৈরি হয়েছিল৷ কিন্তু সে গুড়ে বালি দিয়ে নিয়ন্ত্রণরেখা পেরিয়ে কৌশলী হামলা চালিয়ে বেশ কিছু জঙ্গিঘাঁটি গুঁড়িয়ে দিয়ে পাকিস্তানকে যোগ্য জবাব দিয়েছে ভারত৷ সেও না হয় ভাল৷ কিন্তু পাক শিল্পীরা কী দোষ করলেন? তাঁদের দোষ, এতকিছু হয়ে যাওয়ার পরও তাঁদের মুখ দিয়ে টুঁ শব্দটি বেরোয়নি৷ বেরোবেই বা কেন, মাতৃভূমি নিয়ে কিছু বললে পাকিস্তানে ফেরার গঙ্গাপ্রাপ্তি হবে আর উরি হামলার সমালোচনা না করলে ভারতীয় জনতা বাপ বাপান্তর করবে৷ সেটা তাঁরা বিচক্ষণ জানেন৷ তাই স্পিকটি নট৷ তাঁদের নীরবতাকে বিঁধে মাঠে হইহই করে নেমে পড়লেন মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনার সুপ্রিমো রাজ ঠাকরে৷ একেবারে ডেডলাইন দিয়ে পাক শিল্পীদের দেশ ছাড়ার নির্দেশ দিলেন তিনি৷ ঝামেলা এড়াতে ফওয়াদ খান দেশও ছাড়লেন৷ এতকিছু মোটামুটি ঠিকই ছিল৷ কিন্তু ভারত এবং পাক শিল্পীদের ঠান্ডা লড়াইয়ের মাঝে গুপি-বাঘার মতো শান্তির বার্তা নিয়ে পদার্পণ সলমন খানের৷ তিনি পাক শিল্পীদের পক্ষেই দাঁড়ালেন এবং তাঁদের এদেশে কাজ করতে দেওয়ার পক্ষে কথা বলে ঝামেলায় ঘৃতাহুতি করলেন৷
হঠাৎ করে সলমনের শান্তির দূতের অবতার কেউ ভাল চোখে দেখছেন না৷ দেশবাসীরা তো নয়ই, বরং শিব সেনা-মহারাষ্ট্র নবনির্মাণ সেনাও সলমনকে পাকিস্তানে গিয়ে থাকার পরামর্শ দিয়ে দিয়েছে৷ করণ জোহরের ‘অ্যায় দিল হ্যায় মুশকিল’ এবং রাহুল ঢোলাকিয়ার ‘রইস’-এর শান্তিপূর্ণ মুক্তির জন্য আচমকা কেন আবেদন-নিবেদন করতে গেলেন সলমন, কেউই ঠাহর করতে পারছেন না৷ দু’টি ছবিতে তিনি কাজ করা তো দূরের কথা, কোনও ক্যামিও করেননি৷ পাক শিল্পীদের পক্ষে সওয়াল করে তাঁর আখেরে লাভ কোথায়? কই, আমির-শাহরুখরা কেউ কিছু বলছেন না তো৷ ‘রইস’ তো শাহরুখের নিজের ছবি আর ইন্ডাস্ট্রিতে করণ জোহরের সঙ্গে শাহরুখের সখ্যতা বহুদিনের৷ পাক শিল্পীরা দেশ ছাড়লে সলমনের কেন এত গায়ে জ্বালা বাপু, প্রশ্ন করছে আম আদমি৷ সলমনের অগুনতি ভক্তরাও ভাইজানের সঙ্গে একমত হতে পারছেন না, দেশ জুড়ে এই প্রবল জাতীয়বাদী আবহের মধ্যে৷
তবে সলমনের স্বার্থসিদ্ধি কোথায়?
তাহলে স্মৃতির সরণি বেয়ে আপনাদের একটু অতীতে নিয়ে যাই৷ গাড়ি চাপা দিয়ে হত্যা এবং কৃষ্ণসার হরিণ হত্যা মামলায় জর্জরিত সলমনের তখন শ্যাম রাখি না কূল রাখি অবস্থা৷ সাংবাদিক দেখলেই খেপে যাচ্ছেন, সহ-শিল্পীদের চড়-ঘুসি চালিয়ে দিচ্ছেন, মাথার ঠিক নেই৷ যাঁকে যা খুশি বলে দিচ্ছেন ভাইজান৷ ব্যাডবয় ইমেজ ছেড়ে বেরতেই পারছেন না সলমন৷ ঠিক তখনই পরপর বেশ কয়েকটি ছবি সুপারহিট, কোটি কোটি টাকার ব্যবসা দিয়ে প্রযোজকদের মুখে হাসি ফোটানোর পর মতি ফিরলো সলমনের৷ দান-ধ্যান, সমাজসেবা করে একটু পূণ্য অর্জন করে মূলস্রোতে ফেরার চেষ্টা শুরু করলেন তিনি৷ শাপে বরের মতো দুই দীর্ঘমেয়াদী হত্যা মামলা থেকে রেহাইও পেয়ে গেলেন তিনি৷ লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ হল আর তাঁর আইনজীবী তাঁকে আদালতে নির্দোষ প্রমাণ করে দিলেন৷ যদিও মহারাষ্ট্র পুলিশ বম্বে হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে গিয়ে সুপ্রিম কোর্টে মামলা করলেও তার শুনানির ভবিষ্যৎ অথৈ জলে কার্যত বলা যায়৷ তাই মুক্তির আস্বাদ পাওয়া সলমন এখন নয়া অবতারে আবির্ভূত৷ ত্রাতার অবতার৷ ইন্ডাস্ট্রিতে গডফাদার হওয়ার প্রবল ইচ্ছা তাঁর৷ সৃজিৎ মুখোপাধ্যায়ের অটোগ্রাফ ছবিতে যেমন বুম্বাদাকে বলতে শোনা গিয়েছিল, ‘আমি অরুণ চ্যাটার্জি, আমি ইন্ডাস্ট্রি’৷ ঠিক সেইরকম ভাবেই বলি ইন্ডাস্ট্রির বেতাজ বাদশাহ হতে চাইছেন সলমন৷ অনেকটা বাবা লোকনাথের মতো রণে-বনে-জলে-জঙ্গলে যখনই ইন্ডাস্ট্রির কেউ বিপদে পড়বেন, ত্রাতা হয়ে রক্ষা করবেন সলমন৷ এমনকী পাক শিল্পীদের ক্ষেত্রেও তিনি রক্ষাকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ৷ তাতে কে কী বলল তাঁর কিছু আসে যায় না৷ মোদ্দা কথা, শিল্পীদের আপদে-বিপদে পাশে দাঁড়িয়ে চন্ডাশোক থেকে ধর্মাশোক হতে চাইছেন সলমন৷ তাহলেই সবাই তাঁকে তোয়াজ করে চলবে৷ তাঁর সামনে মাথা নত করে থাকবে৷ মহানতা দেখিয়ে মহাত্মা হওয়ার খেলায় মেতেছেন৷ আমির-শাহরুখরা যেখানে অসহিষ্ণুতার জুজুতে মুখে রা কাড়ছেন না সেখানেই তো সলমনের সুযোগ৷ গডফাদারের মতো ইন্ডাস্ট্রির ব্যাটন ধরে নীতিনির্ধারণ করা৷ যাতে সমস্ত প্রযোজক-পরিচালক-অভিনেতারা তাঁর অলিখিত দাসত্ব করতে পারেন৷ তিনি ঠিক করে দেবেন ছবিতে কে গাইবে, কে চিত্রনাট্য লিখবে, কে অভিনয় করবে আর কে করবে না৷ সবই তাঁর অঙ্গুলিহেলনে ঠিক হবে৷
শাহরুখ-আমিররা হালে পানি পাবে না, এর থেকে আনন্দের বিষয় আর কি থাকতে পারে! তাই পাক শিল্পী ইস্যুটাকে হাতছাড়া করতে চাননি ভাইজান৷ লোহা গরম হ্যায়, মার দো হাতোড়া! বিতর্ককে আরও খুঁচিয়ে দিয়ে তিনি ফোনই করে বসলেন রাজ ঠাকরকে৷ আবদার, পাক শিল্পীদের ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতে দিতে হবে৷ ব্যস, তাতেই বেজায় চটলেন বালাসাহেবের ভাইপো৷ বাল ঠাকরের ছেলে উদ্ভবই বা বাদ যান কেন? নিজে না বলে দলের লোককে দিয়ে সলমনকে একহাত নিলেন৷ ভাইজান দমলেন কি না জানি না, কিন্তু কাগজের বড় বড় হেডলাইন হয়ে গেল৷ সে যাই হোক, গডফাদার হতেই হবে৷ তাই পাক শিল্পীদের জন্য সওয়ালের জিগির জারি রাখতে হবে৷ বাকি খানরা গোল্লায় যাক, সিংহাসনে আমাকেই বসতে হবে৷ তাই চালিয়ে যাও৷ এখানে একটা কথাই বলার, শিল্পীদের স্বাধীনতা, রাজনীতি থেকে তাঁদের দূরে রাখার বার্তা নিঃসন্দেহে মহান কাজ৷ কিন্তু এমন মহান হয়ে দেশবাসীর চক্ষশূল হওয়ার থেকে চুপ করে থাকাই ভাল নয় কি? দেশ-কালের থেকে উর্ধ্বে শিল্প-সংস্কৃতি, কিন্তু দেশের উপর আঘাত নেমে আসলে সবার প্রথম সোচ্চার হয় শিল্পীরাই৷ সলমনও হয়েছেন, কিন্তু আপন স্বার্থসিদ্ধির জন্য৷ তবে ভাইজান, চালে একটু ভুল হয়ে গেল মনে হচ্ছে৷ মানে, দেশ-কাল-পাত্রটা বিবেচনা করলে হত না?
The post কোন স্বার্থসিদ্ধির জন্য পাক শিল্পীদের পাশে দাঁড়ালেন সলমন? appeared first on Sangbad Pratidin.