অভিরূপ দাস: একদিনে আয় সতেরো হাজার টাকা। দশ দিনের হিসাব ধরলে তা দু’লক্ষ ছুঁই ছুঁই। কোনও বহুজাতিক সংস্থার হিসাবখাতা নয়। এই অঙ্ক সরস মেলায় শুধু একটা স্টলের বিক্রিবাটার। স্রেফ দার্জিলিংয়ের সেলরুটি আর মোমো বেচে জিটিএ স্টলে ক্যাশবাক্সে লক্ষ্মী উপচানো দশা। নিউটাউনে মেলাপ্রাঙ্গণে ২২ ডিসেম্বর থেকে বসেছে সরস মেলা। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পঞ্চায়েত এবং গ্রামোন্নয়ন দপ্তরের উদ্যোগে স্বনির্ভর গোষ্ঠীর এই মেলার এক একটা স্টলের রোজগার লজ্জায় ফেলে দেবে গালভরা পদের মোটা মাইনের চাকরিকে।
প্রতিটি স্টলের বাইরে লম্বা লাইন। বহুজাতিক কর্পোরেট সংস্থা দু’হাত ভরে কিনে নিচ্ছে বাংলার মেয়েদের তৈরি ঝিনুকের দুর্গা, পাটের ময়ূর, খড়ের পেন্টিং। এই সেতুবন্ধনের কাজটাই করেছে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন। নভেম্বরে বাণিজ্য সম্মেলনের শেষ দিনে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছিলেন, “গ্রামই এখন গ্রোথ সেন্টার। বড় শিল্প তত কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারছে না, যা করে দেখাচ্ছে ক্ষুদ্র-মাঝারি শিল্প!”
মুখ্যমন্ত্রীর সেই দাবির হাতেগরম প্রমাণ দিচ্ছে সরস মেলার বাংলার মেয়েদের পসরা। গাইঘাটার ঝিনুকের শো পিস, মালদহের লিচুর মধু, বালুরঘাটের চিনি আতপ, রায়গঞ্জের তুলাইপাঞ্জি, মুর্শিদাবাদের শাড়ি, কিংবা হাওড়া শ্যামপুরের জৈব ফুলকপি টেবিলে সাজাতে না সাজাতেই ক্রেতার ব্যাগে।
[আরও পড়ুন: বছরের প্রথম দিনেই ৭.৫ রিখটার স্কেলে ভূমিকম্প জাপানে, শুরু সুনামিও]
মেলা শেষ হবে ২ জানুয়ারি। তার আগেই অধিকাংশ স্টলে আশি শতাংশ জিনিস বিক্রি হয়ে গিয়েছে। কেউ চাহিদা দেখে ফের নতুন করে আনিয়েছেন। ক্রেতার আকুতি দেখে কোনও বিক্রেতার অনুরোধ, ‘‘ঠিকানা দিয়ে যান। মেলা শেষে ডেলিভারি পেয়ে যাবেন।’’ মোট কথা, স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলাদের রোজগার রীতিমতো ঈর্ষাযোগ্য। বিকিকিনি এতই, একাধিক স্টলে মেলা শেষের আগেই পসরা শেষ। গাইঘাটা ঠাকুরনগর থেকে সরস মেলায় স্টল দিয়েছেন নমিতা বিশ্বাস রায়।
তাঁর তৈরি করা ঝিনুকের দুর্গার সামনে সেলফি তুলতে হুড়োহুড়ি। দাম পনেরো হাজার টাকা! ইতিমধ্যেই দু’দুটো সেরা পুরস্কার বাগিয়েছে ওই হাতের কাজ। জেলাস্তরে সৃজনশীল হাতের কাজের প্রতিযোগিতায় প্রথম পুরস্কার, রাজ্যস্তরে সেরা হাতের কাজের নিরিখে দ্বিতীয় পুরস্কার। এহেন নমিতার ঝিনুকের হাতি, বক, শ্যামা মায়ের মূর্তি কেনার জন্য হুড়োহুড়ি ভিড়। মেলার প্রথম ন’দিনে তাঁর ৫ লক্ষ টাকার ঝিনুকের হাতের কাজ বিক্রি হয়ে গিয়েছে।
আন্দামান এবং কেরলের রামেশ্বরম থেকে ঝিনুক এনে শো পিস তৈরি করেন নমিতা। ২৩৬০ কিলোমিটার উজিয়ে ঝিনুক নিয়ে আসা। তারপর তা প্রক্রিয়াকরণ করে রঙ চাপানো। সহজ নয়। ব্যবসার প্রসার এতটাই উত্তরাখণ্ডে ঝিনুকের শো পিসের বাজারেও তিনি একচ্ছত্র। উত্তর দিনাজপুর থেকে পাটের ময়ূর, জিরাফ নিয়ে এসেছেন সুমিতা দাশগুপ্ত। সুমিতার কথায়, আগে এমনটা ছিল না। এখন বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলনে আমাদের হাতের কাজের নমুনা দেখতে পান দেশ-বিদেশের তাবড় তাবড় শিল্পপতিরা।
গাইঘাটার কাজ তাই শোভা পায় গুজরাটের বসার ঘরে। হুগলির ধনেখালি থেকে মাছের আঁশের শো পিস এনেছেন রিনা দাস। মহাত্মা গান্ধী থেকে সরস্বতী ঠাকুর, মাছের আঁশ দিয়ে কী না বানিয়েছেন রিনা! বিক্রিও হচ্ছে দেদার। একাধিক বহুজাতিক সংস্থার কর্তারা অফিসের অন্দরসজ্জার জন্য কিনছেন। বড় আবাসন সংস্থাও সামগ্রী কিনে বসাচ্ছে বহুতলের ইন্টেরিয়র-এ। দেশের মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্বনির্ভর গোষ্ঠী রয়েছে বাংলায়। সংখ্যার হিসাবে তা ১০ লক্ষ ৬০ হাজার।
রাজ্যের পঞ্চায়েত মন্ত্রী প্রদীপ মজুমদার জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আনন্দধারা প্রকল্পের আওতায় বাংলার মা-বোনেদের স্বনির্ভর করার লক্ষ্যেই এই সরস মেলা। কলকাতার পর ৫ জানুয়ারি শিলিগুড়িতে শুরু হবে সরস মেলা। এছাড়াও সৃষ্টিশ্রী নাম নিয়ে পশ্চিম মেদিনীপুর, মালদহ এবং দুর্গাপুরেও হবে মেলা। মন্ত্রী জানিয়েছেন, এঁদের তৈরি করা জিনিস অনলাইন প্ল্যাটফর্মে বিক্রির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। গত বছর সরস মেলায় ১২ দিনে ১২ কোটি টাকার ব্যবসা হয়েছিল। এবছর সেটাও পিছনে পড়বে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রী।