নির্মল ধর: ভারতীয় সিনেমার বয়স ১০০ ছাড়িয়েছে বছর দশ আগেই। জনক ও পথিকৃৎ হিসেবে হীরালাল সেন, নাকি দাদাসাহেব ফালকে- তা নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বিমত থাকলেও, ভারতীয় সিনেমার যথার্থ মুখ ও পরিচয় যে সত্যজিৎ রায় নামের মানুষটি, সে সম্পর্কে কোনও দ্বিমত নেই। নেই কারণ একমাত্র তাঁর সিনেমাই প্রায় তিরিশ বছর আন্তর্জাতিক আঙিনায় ভারতের প্রতিনিধিনত্ব করেছে।
শুধু তাই নয়, পৃথিবীর প্রায় সব আন্তর্জাতিক ফিল্মৎসব থেকে পুরস্কার এনেছে সত্যজিতের ছবিই। ভারতীয় আর কোনও পরিচালকের মুকুটে সেই রঙিন পালক নেই। তার চেয়েও বড় কথা, সত্যজিতের ছবিই প্রথম ভারতীয় জীবনের রূঢ় বাস্তব তুলে ধরে। হ্যাঁ, নিমাই ঘোষের “ছিন্নমূল” ছবিটিকে স্মরণে রেখেই এই মন্তব্য করছি। তাঁর ‘অপু চিত্রত্রয়ী’ গ্রাম ও শহুরে বাস্তবের যে ছবি দেখিয়েছিল, অন্য কারও ছবিতে ওই ভাবে এমন বাস্তব কখনও উঠে আসেনি। এক বিদেশি সমালোচক মিসেস পেনিলোপ হিউস্টন সঠিকভাবেই বলেছিলেন “…satyajit’s cinemas are cinemas of India….” তাঁর সেই ধারাবাহিকতা জীবনের শেষ পর্যায়ের কয়েকটি ছবিতে কিঞ্চিৎ ভ্রষ্ট হলেও, সত্যজিতের অবদানকে এতটুকু খাটো করা যায় না। তিনিই ভারতীয় নব্য বাস্তব সিনেমার ভগীরথ। আজ ২ মে, তাঁর জন্ম ১০০ বছরে পা রাখল।
[ আরও পড়ুন: শতবর্ষের আলোকে সত্যজিৎ, প্রচুর পরিকল্পনা থাকলেও করোনার জন্য স্থগিত উদযাপন ]
তাঁর সৃজনশীল কর্মকাণ্ড ঘিরে সারা বছরব্যপী নানা অনুষ্ঠান ও উৎসব চলবে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে তো বটেই, সরকারি উদ্যোগেও ঘাটতি থাকবে না। এমনকী আন্তর্জাতিক উৎসব জগতেও তাঁর ছবি ঘিরে চলবে নানা প্রদর্শনী। সুতরাং এমন একটি মুহূর্তে সত্যজিতের শিল্পকাজের ওপর কিঞ্চিৎ আলো ফেলা অকারণ হবে না। তাঁর তৈরি ২৮টি সিনেমার অধিকাংশই একেকটি হীরক খণ্ড যেন। বিষয় বৈচিত্র্য থেকে সিনেমার প্রয়োগশৈলীর ব্যবহারে তিনি দিশারির ভূমিকা পালন করেছেন। ‘পথের পাঁচালী’ যদি হয় গ্রামীণ বাংলার রূঢ় বাস্তব ছবি, তাহলে ‘মহানগর’, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’, ‘জনঅরণ্য’ও ‘সীমাবদ্ধ’ তৎকালীন নাগরিক জীবনের দলিল- এটা মানতেই হবে। এমনকী এখনও ওই ছবিগুলো রীতিমতো প্রাসঙ্গিক। পাশেই রাখা যায় তাঁর শেষ পর্বের তিনটি ছবি- ‘গণশত্রু’, ‘শাখা প্রশাখা’ এবং ‘আগন্তুক’কে। বিষয় শহরকেন্দ্রিক হলেও, এই ছবিগুলোই তিনি গভীর জীবন দর্শনের কথাও শুনিয়েছেন, স্পষ্ট ভাষায়। সিনেমার প্রায়োগশৈলীতে হয়তো তেমন জোর ছিল না, কিন্তু বক্তব্যের আন্তর্জাতিকতায় ও জীবন দর্শনের বীক্ষণে ছবিগুলো একেকটি অধ্যায়ের মতো। আবার তিনি যখন ছোটোদের জন্য ছবি বানিয়েছেন (গুগাবাবা, হীরক রাজার দেশে, সোনার কেল্লা), সেখানেও ছোটোদের মন জয় করার উপকরণের পাশাপাশি বড়দের চিন্তার খোরাক ও রেখে দিচ্ছেন গল্পের নিচের স্তরে। সেটা উপলব্ধি করতে পারলে দর্শকের বাড়তি পাওনা। যে কারণে ‘গুগবাবা’ ও ‘হীরক রাজার দেশে’ ছবি দু’টোর আবেদন এখনও সমকালীন।
[ আরও পড়ুন: মেয়ের পর করোনা যুদ্ধে শামিল মা, ঝাড়খণ্ডের প্রত্যন্ত গ্রামে অভুক্তদের সাহায্য মধু চোপড়ার ]
সত্যজিতের ছবিতে জোরালো বিদ্রোহ বা বিপ্লবের চিৎকার কোথাও নেই, অথচ রয়েছে প্রতিবাদের তীব্র চাবুকের শব্দ। একবার মনে করুন ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ ও ‘সীমাবদ্ধ’ ছবি দু’টোর অন্তিম পর্ব! প্রতিবাদের সঙ্গে কবিতা ও নান্দনিকতা কেমন মিলে যায়! যেমনটি আমরা দেখতে পেয়েছি লিন্ডসে আন্ডার্সনের ‘ইফ’ বা আন্তনিওনির ‘Blow-Up’ ছবিতে। রবীন্দ্রনাথের ‘নষ্টনীড়’ গল্পটিকে এক ক্লাসিক সিনেমাই রূপান্তর করানোর রূপকার তিনিই। সাহিত্যকে চলচ্চিত্র মাধ্যমে ট্রান্সক্রিয়েট করার সফলতম উদাহরণ এই ছবি। তা নিয়ে একসময় কাগুজে তর্কও কম হয়নি। কিন্তু শেষপর্যন্ত ‘চারুলতা’ সিনেমাকে ‘সিনেমা’ হিসেবেই স্বীকৃতি দিতে হয়েছে। এই ছবির জন্যই সত্যজিৎ রায় বার্লিন উৎসব থেকে সেরা পরিচালকের সম্মান জিতেছিলেন। এবং স্বয়ং সত্যজিৎ স্বীকার করেছেন ‘চারুলতা is my Best work with least mistake..’ আবার তিনি যখন ‘শতরঞ্জ কে খিলাড়ি’ করেছেন, তখনও তৎকালীন সমাজের সাধারণ মানুষের দিকেও ক্যামেরা ঘুরিয়েছেন, পাশাপাশি আযোধ্যার নবাব, বিদেশি শাসক ও মন্ত্রীদের জীবনযাত্রাকেও সমান ভাবেই ফোকাস করেছেন। এই মানুষটিই দুরদর্শনের জন্য ‘সদগতি’ বানালে, সেখানে দলিত নিম্নবর্গের একজন মানুষের নীরব প্রতিবাদকে উচ্চারণের সঙ্গে, উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণের পাপস্খলনের দিকটিকেও উল্লেখ করতে ভোলেননি। এখানেই তাঁর সমাজ ও সময় চেতনার পরিচয়! তিনি যখন মন্বন্তরের ওপর লেখা ‘অশনিসংকেত’ বানানো, সেখানে মানুষের তৈরি খাদ্যভাবের প্রতি ইঙ্গিত রেখেও প্রকৃতির আকৃপণ দানের দিকটিও দেখিয়েছেন। শুধু মন্বন্তরের দুর্মর ছবি নয়, তিনি উপস্থিত করেন প্রকৃতির উদার সৌন্দর্যও! এটা নিয়ে কিছু বিরূপ সমালোচনা হলেও, তিনি নিজে জানতেন “কী” করছেন! সমালোচনার জবাবও তিনি দেননি। মৃণাল সেন তাঁর ছবিকে একসময় রাজনীতির pamphlet করেছিলেন, সত্যজিৎ কখনোই তেমন করেননি। তিনি শিল্পের প্রতি বেশি দায়বদ্ধ ছিলেন, রাজনীতির চেয়ে। না, সেজন্য তাঁকে কখোনোই অরাজনৈতিক মনোভাবের শিল্পী বা মানুষ বলা যাবে না। তিনিই প্রমাণ করে গেছেন শিল্পসৃজন ও সমাজ সচেতনতা হাত ধরাধরি করে চলতেই পারে।
[ আরও পড়ুন: ‘কিছু গল্প না বলাই রয়ে গেল’, ঋষির সঙ্গে কাজ না করতে পারার আক্ষেপ শিবপ্রসাদের কণ্ঠে ]
এত গেল তাঁর সিনেমা নিয়ে সংক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন আলোচনা। তাঁর বিশাল সাহিত্যকর্ম, তাঁর ছবি আঁকা, illustration, প্রচ্ছদ আঁকা, caligraphy’র কাজ- কোনটা কোনটার কথা বলব! তাঁর সংগীত জ্ঞান, সংগীত রচনা, সিনেমার সুর প্রদান, বিদেশি সংগীতের ওপর দখলদারি, দেশি সংগীত নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কাজ (গুগাবাবা ও হীরক রাজার দেশে)! তাছাড়া সিনেমা তৈরির আগে থেকেই ক্যামেরার framing-কে চিত্রনাট্যের খাতার পাশে এঁকে রাখার কাজ সত্যজিতের আগে কেউ এমন নিখুঁত ভাবে করেছেন বলে জানি না।
সেই বিরল প্রতিভাধর মানুষটির জন্মশত বর্ষ শুরু আজই। অনেকেই বলে থাকেন রবীন্দ্রনাথের পর এমন বহুমুখী প্রতিভার আধিকারী সত্যজিৎ রায়। খুব অসত্য নয় কথাটি। সুতারং তাঁর জন্মশত বর্ষে বাঙালি হিসেবে গর্ব করতেই পারি আমরা। অস্বীকার তো করা যাবে না, এখনও সিনেমা জগতের ঢ্যাঙাতম মানুষটির শিল্পভাবনার উচ্চতা কেউ স্পর্শ করতে পারেননি। উচ্চ শিরে তিনিই দাঁড়িয়ে। জন্মশতর্ষে তাঁকে শতকোটি প্রণাম।
The post সত্যজিতের ছবিতে রয়েছে প্রতিবাদী চাবুকের তীব্র শব্দ, শতবর্ষের আলোকে মহারাজাকে ফিরে দেখা appeared first on Sangbad Pratidin.