অমিতলাল সিং দেও, মানবাজার: ঝাড়খণ্ড সন্নিহিত পুরুলিয়ায় পথ ডাকাতি হলেই পুলিশের টার্গেট হত অকড়বাইদ! অপরাধে জড়িত থাকার সন্দেহে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হত শবর জনজাতির যুবক থেকে বৃদ্ধদের। কারণ ব্রিটিশ জনজাতি যে তাদেরকে ‘জন্ম অপরাধী’ আখ্যা দিয়েছিল।
ফলে পুলিশি আতঙ্কে সেই সময় পুরুষ শূন্য থাকত পুরুলিয়া শহর থেকে ২৫ কিমি দূরে তৎকালীন কেন্দা থানার অকড়বাইদ গ্রামের শবর পাড়ার বাসিন্দারা। বর্তমানে এই এলাকা টামনা থানার অন্তর্ভুক্ত। তবে রাজ্যে পালাবদলের পর আজ আর সেই আতঙ্ক নেই ওদের চোখে মুখে। কিন্তু বাম আমলের চুরি, ছিনতাই, ডাকাতির ঘটনায় ‘দাগি আসামির’ তকমা নিয়ে এখনও এই গ্রামের ৮ থেকে ৯ জন শবরকে নিয়ম মাফিক থানায় হাজিরা দিয়ে নিজেদের অবস্থানের কথা জানান দিতে হয়।
[আরও পড়ুন: নিরপেক্ষভাবে কাজ না করলে ব্যবস্থা নেবে BJP! পঞ্চায়েত নির্বাচনের আগে পুলিশকে হুমকি সুকান্তর]
মেঠো পথ দিয়ে অকরবাইদ গ্রামের এক প্রান্তে এই শবর পাড়া। ছোট, ছোট মাটির ঘরে বাস করেন প্রায় ১৬ থেকে ১৭ টি পরিবার। এরা মূলত দিনমজুরের পাশাপশি হস্তশিল্পের সঙ্গে যুক্ত। তাদের নিপুন হাতে বাঁশ, বাবুই ঘাস, কাসি ঘাস, খেজুর পাতা দিয়ে তৈরি হয় ঝাড়ু, চাটাই থেকে শুরু করে ঘর সাজানোর নানা সামগ্রী। একটা সময় দু’বেলা পেট ভরাতে সামান্য ভাতের ফেনার সঙ্গে জল মিশিয়ে দিন গুজরান করতে হত আদিম জনজাতির মানুষজনকে। রাজ্যে পালাবদলের পর অবশ্য তাদের দিন বদলেছে। বদলেছে সংসারের চিত্র। কেটেছে পুলিশি ভয়। তাই তো এখন হাতের তৈরি সামগ্রী নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন মেলায় অংগ্রহণ করেন মুক্তা শবর, অনিল শবররা।
সবুজ সাথীর সাইকেল নিয়ে রোজ স্কুলে যায় দেবী, জবা শবররা। এই শবর পাড়া থেকে ২০১১ সালে প্রথম মাধ্যমিক পাশ করেন গুরুপদ শবর। বর্তমানে পুরুলিয়ার একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে তিনি গ্রামের একটি স্কুলে শবর শিশুদের পাঠদান করেন। গুরুপদ জানান, “মাধ্যমিকের প্রস্তুতির সময় একদিন রাতে বাবার খোঁজে গ্রামে পুলিশ আসে। বাবাকে না পেয়ে আমাকে তুলে নিয়ে প্রচণ্ড মারধর করে।” গুরুপদর বাবা মঙ্গল শবরের কথায়,”সেই সময় আমাদের পাড়ায় এমন কোনও পুরুষ মানুষ ছিল না। যার বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেয়নি পুলিশ। আমাকেও একটি খুনের মিথ্যে মামলায় ফাঁসানো হয়েছিল। পরে আমি বেকসুর খালাস হই।” তিনি আরও বলেন, “সেই সময় আমাদের বাড়ির মহিলারা গ্রামের অদূরে ঝোপ ঝাড় ঘেরা এলাকায় দুপুরের খাবার পৌঁছে দিত। পুলিশের ভয়ে আমরা সেখানেই দিন কাটাতাম। তবে এখন বেশ ভাল আছি।”
[আরও পড়ুন: মিড ডে মিলে স্পেশ্যাল মাংস-ভাত খেয়ে অসুস্থ শতাধিক পড়ুয়া! স্কুল ঘেরাও করে বিক্ষোভ]
পুলিশের আতঙ্ক চরম আকার ধারণ করে ১৯৯৮ সালে। যখন গ্রামে খবর আসে বুধন শবরের মৃত্যুর ঘটনা। তবে রাজ্যে পালাবদলের পরে তাদের কাছে পুলিশ এখন বন্ধু। পরিবার পিছু পর্যাপ্ত রেশন সামগ্রী পাওয়ায় এখন তাদের দু’বেলা ভরপেট খাবারের জন্য ভাবতে হয় না। সঙ্গে রয়েছে লক্ষ্মীর ভাণ্ডারও।
উল্লেখ্য, ২৫ বছর ধরে আইন প্রক্রিয়া শেষে সুবিচার পেল পুরুলিয়ার (Purulia) শবর পরিবার। বিচারাধীন বন্দি হিসেবে জেল হেফাজতে অস্বাভাবিকভাবে আদিম জনজাতি শবর যুবকের মৃত্যুর ঘটনায় অবশেষে শাস্তি পেল পুলিশ। সোমবার পুরুলিয়া আদালতের বিচারক এই ঘটনায় প্রাক্তন ওসি অশোক রায়কে ৮ বছরের কারাদণ্ডের নির্দেশ দিলেন। আড়াই দশক পর সুবিচার পেয়ে বুকের পাষাণভার খানিকটা নামল মৃত যুবক বুধন শবরের স্ত্রী ও পরিবারের।