ত্রাসের রাজনীতির সঙ্গে আশার রাজনীতির বিবাদ, উন্নয়নের শহর-গ্রাম বিভাজিকা, নেতা ও নাগরিকের দূরত্ব বা মহিলা-যুবদের নিয়ন্তা হয়ে ওঠা– দেশজুড়ে নির্বাচনী সফর সেরে এমন দশটি বিষয় চোখে পড়ল, যা হয়ে উঠতে পারে নিয়ন্ত্রক। লিখছেন রাজদীপ সরদেশাই।
তামাম দেশে নির্বাচনের আগের আট সপ্তাহ ধরে চক্কর কাটার পর দশটি বিষয় চোখে পড়ল, যা ভারতীয় সংসদীয় গণতন্ত্রের ক্ষমতা ও দুর্বলতা– দুয়েরই ইঙ্গিত দেয়।
১) যদি কোনও একটি প্রবণতা এই নির্বাচনকে কেরল থেকে কাশ্মীর পর্যন্ত এক সুতোয় বেঁধে রাখে, তাহলে তা নিশ্চিতভাবেই, ‘মোদি ফ্যাক্টর’। একই সঙ্গে স্থিতাবস্থা বজায় রাখা ও মেরুকরণ– দুই ক্ষেত্রেই প্রধানমন্ত্রীর ছায়া দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। বিজেপি-র ‘মোদি কি গ্যারান্টি’ স্লোগান এই নির্বাচনকে প্রায় একমাত্রিক করে তুলেছে, যেখানে এনডিএ-র বাকি ৫৪২ জন প্রার্থী এই একজন ব্যক্তির মহামানবিক অস্তিত্বের সামনে নেহাতই অকিঞ্চিৎকর হয়ে উঠছেন। পথে-ঘাটে প্রতিটি রাজনৈতিক কথোপকথন শেষ পর্যন্ত যে-বিন্দুতে পর্যবসিত হচ্ছে, তা হল এই ১০ বছরে প্রধানমন্ত্রী কি এমন কিছু করতে পারলেন, যা তঁাকে আরও পঁাচ বছরের মেয়াদ কাটানোর যোগ্য করে তুলেছে? ২০১৪ সালের গণ-রায় যদি কোনও পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা দ্বারা চালিত হয়ে থাকে, তবে ২০১৯ সালে জনমতের চালিকাশক্তি হয়ে দঁাড়িয়েছিল এক সর্বাত্মক উগ্র জাতীয়তাবাদের বোধ। এবারের নির্বাচনের ভিত যেন এক ব্যক্তিত্বের ‘কাল্ট’ বা অনিবার্য উপস্থিতি। আপনি হয় তঁাকে সমীহ করবেন, নয়তো অস্বীকার করবেন; কিন্তু ঔদাসীন্যর পরিসর প্রায় নেই বললেই চলে।
২) বিজেপি যদি এই নির্বাচনকে ‘এক নেতা, এক জাতি’-র আখ্যানের আধারে দেখাতে চেয়ে থাকে, বিরোধীরা সেখানে যত দূর সম্ভব স্থানীকরণ ঘটাতে চেয়েছে এই নির্বাচনের। তারা কিছুটা সফলও বটে। উত্তরপ্রদেশে প্রশ্নপত্র ফঁাস নিয়ে ছাত্রদের ক্ষোভ হোক, বা নাসিকে রফতানি নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে পেঁয়াজ-চাষিদের ক্ষোভ, অথবা কোয়েম্বাটোরে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জিএসটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার তীব্রতা বাড়ানো– এবারের নির্বাচন যেন এই বৈচিত্রের দেশে ঐকে্যর অন্বেষণের এক নতুন মাত্রা যোগ করছে। নির্বাচনের রায় হয়তো এত
খণ্ডীকৃত হবে না, কিন্তু রাস্তাঘাটের কথাবার্তায় অন্তত একরকমের স্বাস্থ্যকর বহুমতের আদানপ্রদান চলছে।
৩) ‘ত্রাস’-এর রাজনীতি এবার প্রতিস্থাপন করেছে ‘আশা’-র রাজনীতিকে, বেশ জোরালোভাবেই। প্রধানমন্ত্রী প্রাথমিকভাবে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন রাজনীতির খেলাটা শুরু করেছিলেন, কংগ্রেসের ইস্তাহার ও মুসলিম লিগের ইস্তাহারকে ‘এক’ করে দেখতে চেয়ে। তারপর থেকে, ‘মঙ্গলসূত্র’ বা ‘মুজরা’– এই ধরনের ভাষা বা শব্দবন্ধর ব্যবহার চলতেই থেকেছে। এসব আপত্তিকর লব্জ-র ব্যবহার আদতে সংখ্যাগুরুর মধে্য মুসলিমদের বিরুদ্ধে আবেগ উসকে দেওয়ার হাতিয়ার।
যে-দলের উদ্দেশ্যই উসকানিমূলক মুসলিম-বিদ্বেষ ছড়ানো, তাদের কাছে এটাই চেনা নীল নকশা। সংবিধান বিপন্ন বলে কংগ্রেসের যে চেতাবনি, বা বিজেপি সংরক্ষণ তুলে দেবে, এই আশঙ্কা, এসবই ত্রাসের রাজনীতির অংশ। এই বর্ণবিদ্বেষ ও ধর্মীয় বিভাজনের সমীকরণ আখেরে ভোটবাক্সে কী প্রভাব ফেলবে, বলা কঠিন, কিন্তু আশ্বাস এটুকুই, এই রাজনীতির অভিঘাত টিভি স্টুডিওতেই বেশি, বাস্তবের মাটিতে কম।
৪) এই যে কথায়-কথায় ‘গ্যারান্টি’-র রাজনীতির লড়াই ক্রমেই বেড়ে চলছে, এতে নির্বাচনী রাজনীতির লেনদেনের ছবিটাই সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। অর্থনীতিবিদরা ভরতুকির রাজনীতি নিয়ে যতই সতর্কবার্তা দিন, ভারতীয় জনগণের এক বিপুল প্রান্তিক অংশের কাছে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে মোটে ৫০০টি টাকা বা বাসে বিনামূলে্যর পরিষেবা পাওয়াও সততই লাভ বলে গ্রাহ্য হয়। এবং সেজন্যই, রাহুল গান্ধীর ‘খটাখট’ প্রতিশ্রুতির বন্যা যখন তঁার ভালবাসার বেসাতি বা ‘মহব্বত কি দুকান’-এর সংলাপকে ছাপিয়ে যায় ও হাততালি কুড়োয়, তখন তাতে বিশেষ বিস্মিত হওয়ার উপকরণ থাকে না।
এই নির্বাচনে জনমোহিনী রাজনীতির এক অনিয়ন্ত্রিত প্রতিযোগিতা চলছে। এখনও পর্যন্ত, সবরকমের সুযোগসুবিধা দিতে পারে, এমন অভিভাবকসম কোনও সরকারকেই ত্রাতা বলে মনে করে ভারতীয়রা।
৫) ‘বিকাশ’ বা উন্নয়ন বিষয়টাকে এখন শ্রেণি ও ভূ-মানচিত্রর প্রিজমের বর্ণচ্ছটাতেই দেখতে হবে। ঝকঝকে উজ্জ্বল হাইওয়ে হয়তো নাগরিক মধ্যবিত্ত চোখে চমৎকার ঠেকছে, কিন্তু গ্রামগঞ্জের বেশিরভাগ রাস্তা এখনও গাড়ি চলাচলের অযোগ্য। শহুরে বাস্তুতন্ত্রে এখন ‘স্টার্ট আপ’ বা নিজস্ব ব্যবসা শুরু করার ঝেঁাক বাড়ছে, গ্রামীণ ভারতে তা ততটা চোখে পড়ছে না। তুমুল উচ্চবিত্তরা হয়তো দুবাইয়ের গোল্ডেন ভিসা-কে পাখির চোখ করেছে, অন্যদিকে উত্তরপ্রদেশের পূর্বাঞ্চলের একজন চাষি কিন্তু ‘আওয়ারা পশু’ বা গবাদি পশু চারণ সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান চাইছে। বিত্তবানদের ঝলমলে যাপনচিত্র আর গরিবের রোজের বাঁচার সংকট– বৈষম্যমূলক সমাজের বৈপরীত্যর ছবি বোধহয় এর চেয়ে বেশি দগদগে হতে পারে না। এই বৈষম্য কেবল শহর-গ্রামের ভেদরেখায় আটকে নেই, দক্ষিণ ভারত বনাম উত্তর ভারত, পূর্ব ভারত বনাম উত্তর ভারত বিভাজিকাটিও দিনে-দিনে স্পষ্ট হচ্ছে। দক্ষিণ ভারতের কোনও একটি সাদামাটা স্কুল বা সাধারণ স্বাস্থ্যকেন্দ্রর পরিকাঠামোও হিন্দিবলয়ের চেয়ে বেশি উন্নত।
৬) নেতা ও নাগরিকদের মধে্য দূরত্ব বেড়েই চলেছে। ‘লালবাতি’ লাগানো অ্যাম্বাসাডরের জায়গা নিয়েছে ধোঁয়াছড়ানো এসইউভি। নেতারা ঘোরেন বিঘত বিঘত গাড়ির কনভয়কে লেজুড় করে, যেখানে তঁার অনুগামীরা ও রক্ষকরা ভিড় করে থাকে। একটু সৌজন্যমূলক হাত নাড়া, একটু ছবি তোলার পালা– এসবের মাধ্যমে নেতারা ক্রমে উদাসীন, নিস্পৃহ ভোটারদের কাছে হয়ে ওঠেন দূরের তারা। বেশিরভাগ কেন্দ্রেই ২০ লক্ষর বেশি ভোটার রয়েছে, সেখানে জনে জনে গিয়ে ক্ষোভবিক্ষোভ, অভাব-অভিযোগ শুনবেন নেতা, এমন দুরাশা না রাখাই ভাল! বহু ভোটভিক্ষুক নেতার সম্পত্তি প্রতি পঁাচ বছর অন্তর ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলে, সেখানে ভোটদাতাদের নুন আনতে পান্তা ফুরয়– এই তো নিয়তি!
৭) উজ্জ্বল ও কৃতীদের রাজনীতি আর একেবারেই আকর্ষণ করছে না। ভোটে জিতে বিধায়ক বা সাংসদ হওয়া মোটেই মুখের কথা নয়। অনেকটাই সময় দাবি করে এই কাজ। কিন্তু এই কাজে এই মুহূর্তে প্রতিভা বা দক্ষতার অভাবও চোখে পড়ার মতো। ‘নেতাগিরি’-র প্রতি যে বেড়ে চলা অশ্রদ্ধা ও নৈরাশ্য, তা বস্তুতপক্ষে আত্মপ্রচারের বাড়াবাড়ির জন্যই ঘটে চলেছে। খুব কম জননেতা-ই রাজনীতির ময়দানে কোনও তফাত আনতে পারছেন। ফলে স্বাভাবিকভাবেই স্থানীয় নেতারা এক্ষেত্রে বাজিমাত করে বেরিয়ে যাচ্ছেন। তঁাদের প্রত্যয় তো তঁাদের পরিচয়ের শিকড়েই নিহিত। রাজধানীতে যঁারা ‘তুই জানিস আমি কে’ বলে মন্ত্রিত্বের অহং দেখান ও কলার তোলেন, তঁাদের চেয়ে এঁরা মাটির অনেক কাছাকাছি।
৮) ভারতীয় রাজনীতিতে আগে ‘এমওয়াই’ বলতে মুসলিম-যাদব গণিতই বোঝাত, এখন বোঝায়, ‘মহিলা-যুবা’। ২০২৪-এর নির্বাচনী ফলাফলের চাবিকাঠি কিন্তু এই দু’টিই। হয়তো পৌরুষের চিলচিৎকারে মহিলাদের কথা শোনা যায় না সবসময়, কিন্তু মহিলা ভোটারদের কর্তৃত্ব এখন অনেকটাই বেশি। মহিলা ভোটাররাই এখন আসল ‘লাভার্তি’ বা উপভোক্তা, তারা অনেক বেশি সচেতন ভোটের উপযোগিতা বিষয়ে। তরুণ ভোটাররা দিগভ্রান্ত, শুধু কোনও তাবড় প্রার্থীর ‘কথার দাম’-এর অলীক ধারণায় প্রতিশ্রুতির বড়ি গিলতে তাদের অসুবিধা আছে। তারা বরং তাদের রাজনৈতিক পছন্দ নিয়ে নিরীক্ষায় রাজি। তাই বিস্ময় জাগে না, যখন দেখি রাস্তায় যাবতীয় দ্রোহের কণ্ঠস্বর তরুণদেরই মালিকানাধীন।
৯) এবারের রাজনৈতিক লড়াইয়ে সক্রিয়ভাবে অংশ নিচ্ছে সামাজিক মাধ্যম। ২০১৯ যদি ভারতের প্রথম ‘হোয়াটসঅ্যাপ নির্বাচন’ হয়ে থাকে, তাহলে ২০২৪-এর খেলোয়াড়: ইউটিউব ভিডিও, ইনস্টাগ্রাম রিল। প্রতিটি এলাকায় তরুণরা তাদের মোবাইলে উপুড় করে ঢেলে দেওয়া কনটেন্টে মজে আছে। তাদের মতামত নির্মাণ করছে ছোট ছোট ভাইরাল ভিডিও। ভুল তথ্যর বাজারে, দলীয় রাজনীতির কলকাকলিতে সোশ্যাল মিডিয়া এখন মোড় ঘুরিয়ে দেওয়া চরিত্র।
১০) সংসদীয় গণতন্ত্রের পায়ের তলার মাটি যতই নড়বড়ে হোক, নির্বাচনী গণতন্ত্রের মৃতু্য এখনও হয়নি। এই নির্বাচনে খেলা জমে উঠেছে, যা প্রত্যাশিত ছিল না। বিরোধীরা কেবল কণ্ঠস্বরই খুঁজে পায়নি, তঁাদের একটা আখ্যান তৈরি হয়েছে, দোর্দণ্ডপ্রতাপ সরকারকেও সেই আখ্যান নিয়ে মুখ খুলতে বাধ্য হতে হচ্ছে। প্রাতিষ্ঠানিক ক্ষমতা ও অর্থের জোরের নিরিখে হয়তো এই লড়াই অসম, কিন্তু ভোটারদের এখনও চমকে দেওয়ার ক্ষমতা যায়নি। যে ভোটদাতা যত নীরব, নির্বাচনী নিদানে শেষ হাসি হাসার সম্ভাবনাও তাঁরই তত বেশি।
পুনশ্চ: নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, তাই নিয়ে ভবিষ্যদ্বাণী করার দায়টা আমি একজিট পোলের কান্ডারিদের হাতেই ছেড়ে রাখলাম। কেবল ছোট্ট একটি সূত্র দিয়ে রাখি, রাজ্যে রাজ্যে যতই লড়াই জমজমাট হয়ে উঠুক, জাতীয় নির্বাচনী রায় হবে একমুখী, সুস্পষ্ট।