মহাকরণে এসে সিপিএমের এক রাজ্যনেতা একবার বলেছিলেন, শিল্প কি আমার টাকে হবে? তখন কিন্তু কারও মনে হয়নি ভুল রয়েছে আইনটিতেই৷ সূর্যবাবুরা এখনও সিঙ্গুর নিয়ে বলতে গিয়ে এই মৌলিক প্রশ্নটাই এড়িয়ে যাচ্ছেন, কেন শিল্পের জন্য উর্বর জমিটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল৷ সুতীর্থ চক্রবর্তী
‘জমি অধিগ্রহণ আইন’কে দোষ দিয়ে সিঙ্গুরের ভুলের সাফাই দেওয়ার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করছে সিপিএম৷ সিপিএমের তরফে বলার চেষ্টা হচ্ছে, ব্রিটিশ আমলের ‘জমি অধিগ্রহণ আইন’টির জন্যই সিঙ্গুরের যাবতীয় সমস্যা৷ ২০০৬ সালে যখন একরকম জেদ করেই বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যরা সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণ করলেন, তখন কিন্তু তাঁদের মনে হয়নি যে, আইনের জটেই পরবর্তীকালে সমস্যা তৈরি হবে৷ এমনকী, ২০১৯-এর লোকসভা ও ২০১১-র বিধানসভা ভোটে সিপিএম তাদের পর্যালোচনা রিপোর্টে সিঙ্গুরে প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ভুলের কথা স্বীকার করলেও এখন হঠাত্ ঝুলি থেকে ব্রিটিশ আইনটি বের করে তার সাফাই দেওয়ার চেষ্টা চালাচ্ছে৷
রাজনীতিতে একটা খুব সাধারণ কথা রয়েছে, তা হল–কখনও তড়বড় করতে নেই৷ সিঙ্গুরের ক্ষেত্রে সিপিএমের তথা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের প্রধানতম ভুলটিই ছিল এই তড়বড় করা৷ ‘টাটা’-রা নাকি দেরি হলে অন্যত্র চলে যাবে৷ এটাই সেইসময়ে বারবার রাজ্য সরকারের তরফে বোঝানোর চেষ্টা করা হয়৷ ১৮৯৪ সালে জমি অধিগ্রহণ আইনে এই তাড়াহুড়োর কোনও সুযোগ ছিল না৷ এখন সুপ্রিম কোর্ট বলছে, আইনের পদ্ধতিগুলি সেইসময়ে সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে মানা হয়নি৷ ব্রিটিশ আমলের জমি অধিগ্রহণ আইনটি এমনই যে, প্রতি স্তরে নানারকমের বিজ্ঞপ্তি দেওয়ার বিষয় থাকে, যেগুলি আবার খুব সময়সাপেক্ষ৷ যেমন, সিঙ্গুরের যে প্রায় হাজার একর জমি রাজ্য সরকার অধিগ্রহণ করেছিল তার মালিক-সংখ্যা নয় নয় করেও ১৪ হাজার৷ এই ১৪ হাজার লোকের বাড়ি বাড়ি জমি অধিগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি পাঠানো দরকার ছিল৷ কিন্তু, যেহেতু টাটা-দের তাড়া রয়েছে, তাই বুদ্ধবাবুরা সেটা জমি-মালিকদের পাঠানোর প্রয়োজন মনে করেননি৷ কয়েকটি খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েই কাজ সারা হয়েছিল৷ সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিরা মনে করছেন এই জায়গাটিতেই বেআইনি পদক্ষেপ হয়েছে৷
সেইসময়ে সিঙ্গুরের জমিটি দ্রূত অধিগ্রহণ করার জন্য বুদ্ধবাবুর নির্দেশে জমি অধিগ্রহণের বিধিতেও পরিবর্তন আনা হয়েছিল৷ সেইসব পরিবর্তন এনে তৎকালীন ভূমিসংস্কার সচিব একটি পুস্তিকাও প্রকাশ করেছিলেন৷ নিঃসন্দেহে এটা একটি নজিরবিহীন কাজ ছিল৷ একটি শিল্পসংস্থাকে তাদের কারখানা করার জন্য জমি পাইয়ে দেওয়ার বিষয়ে এইধরনের সরকারি তৎপরতা কার্যত দেখা যায় না৷ সেইসময়ে রাজ্যের ভূমি সংস্কার মন্ত্রী ছিলেন আবদুর রেজ্জাক মোল্লা৷ যিনি এখন তৃণমূলের মন্ত্রিসভায় রয়েছেন৷ টাটা-র জন্য এইভাবে আইনের পরোয়া না করে জমি অধিগ্রহণের বিষয়ে রেজ্জাক সাহেবের অনেক আপত্তি ছিল৷ যদিও সেইসময়ে দলে কোনও গুরুত্ব পাননি রেজ্জাক সাহেব৷ কিন্তু সেই সময়ে তাঁর করা একটি মন্তব্য সম্ভবত সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহণের ইতিহাসের সঙ্গে সবসময় জুড়ে থাকবে৷ বুদ্ধবাবুদের এই হুড়োহুড়িকে ইঙ্গিত করেই রেজ্জাক সাহেব বলেছিলেন, কিলিয়ে কাঁঠাল পাকানো যায় না৷ রেজ্জাক সাহেবের এই মন্তব্যে বেজায় চটেছিলেন বুদ্ধবাবু ও তৎকালীন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন৷ এই মন্তব্যের জন্য আলিমুদ্দিনে ডেকে রীতিমতো শাসানো হয়েছিল রেজ্জাক সাহেবকে৷ প্রশ্ন হচ্ছে, আজকে কেন সেই ইতিহাস সূর্যকান্ত মিশ্রর মতো সিপিএম নেতারা ভুলে যাচ্ছেন?
১৮৯৪-এর ‘জমি অধিগ্রহণ আইন’ নিয়ে বহু বিতর্ক হয়েছে৷ এই আইন বারেবারে সংশোধন করাও হয়েছে৷ কিন্তু সিঙ্গুরের আগেও বাম সরকারই হাজার হাজার বিঘে জমি ওই আইনেই অধিগ্রহণ করেছিল৷ তখন তো এই ধরনের সমস্যা হয়নি! সিঙ্গুরের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় যে প্রশ্নটি বরাবর রয়েছে তা হল, রাজ্যের অন্যতম উর্বর এলাকার জমি কেন বেসরকারি কারখানা তৈরির জন্য সরকার কৃষকদের থেকে কেড়ে নেবে? ওই পর্বে সিপিএমের তাবড় নেতারা শিল্পায়নের পক্ষে জোর সওয়াল করতেন৷ মহাকরণে এসে সিপিএমের এক রাজ্যনেতা একবার বলেছিলেন, শিল্প কি আমার টাকে হবে? তখন কিন্তু কারও মনে হয়নি ভুল রয়েছে আইনটিতেই৷ সূর্যবাবুরা এখনও সিঙ্গুর নিয়ে বলতে গিয়ে এই মৌলিক প্রশ্নটাই এড়িয়ে যাচেছন, কেন শিল্পের জন্য উর্বর জমিটিকেই বেছে নেওয়া হয়েছিল৷ এমনকী, বিতর্কিত ওই জমির নিকটবর্তী একটি জমিকে কারখানার জন্য চিহ্নিত করার কথা, আমলাদের একটি মহল থেকে প্রস্তাব হিসাবে দেওয়া হয়েছিল৷ তখন বলা হয়েছিল, ওই নিচু জমি ভরাট করতে অনেক সময় ও অর্থ ব্যয় হবে৷ যে দু’টি টাটা-রা করতে রাজি নয়৷ সেরকম হলে ওরা ‘ন্যানো’ প্রকল্প গুটিয়ে নিয়ে অন্যত্র চলে যাবে৷ সিঙ্গুর থেকে সামান্য কয়েক কিলোমিটার দূরে হিন্দমোটরের গাড়ি কারখানা ভগ্নস্তূপে পরিণত হচ্ছে৷ বিড়লা গোষ্ঠীকে কারখানার ওই জমি প্রোমোটারদের চড়া দামে বিক্রি করার অনুমতি কিন্তু বুদ্ধবাবুরাই সেইসময়ে দিয়েছিলেন৷ অথচ তাঁরা বারবার বলছিলেন, হাতে পায়ে ধরে কোনওক্রমে টাটা-দের দিয়ে সিঙ্গুরের গাড়ি কারখানাটি করাতে পারলেই নাকি রাজ্যে শিল্পায়নের জোয়ার আসবে৷ হায়, এমনই জোয়ার এল যে বুদ্ধবাবুরাই খড়কুটোর মতো ভেসে গেলেন!
শাক দিয়ে এখনও মাছ ঢাকার চেষ্টা করে কী লাভ হবে সূর্যকান্তবাবু? স্পষ্ট করেই স্বীকার করুন না যে সিঙ্গুরে টাটা-দের স্বার্থ দেখতে গিয়ে তড়বড় করেছিলেন এবং তার জেরেই এই পরিণতি৷
The post শাক দিয়ে কি মাছ ঢাকা যায় সূর্যবাবু? appeared first on Sangbad Pratidin.