‘MARS’ অর্থাৎ ‘মিনিমাম অ্যাশিওর্ড রিটার্ন স্কিম’-এর আবির্ভাব হঠাৎ পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা নয়। অনেক কাল যাবৎ ‘নিউ পেনশন সিস্টেম’ নিয়ে তরজা চালু রয়েছে। এনপিএস সরিয়ে ‘ওপিএস’, অথবা ‘ওল্ড পেনশন সিস্টেম’, ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও জারি। এই পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে কি বোঝা সম্ভব মার্স ঠিক কোন চেহারায় আসবে? কলমে নীলাঞ্জন দে
অশনি এখনও নেই, তবে তার সংকেত শোনা গিয়েছে বেশ কিছুদিন আগেই। পেনশন প্রক্রিয়াকে বাজারের কাছাকাছি নিয়ে আসার যে-চেষ্টা চলছিল, তা আটকাতে উঠে-পড়ে লেগেছে দেশের একাংশ। এই নিয়ে তর্কাতর্কির মাঝে যে-ধারণা ঘিরে আলোচনা দানা বাঁধছে, তার সংক্ষিপ্ত নাম- ‘মার্স’। ইংরেজিতে গুছিয়ে বললে ‘MARS’ বা ‘মিনিমাম অ্যাশিওর্ড রিটার্ন স্কিম’। পেনশন-সংক্রান্ত লগ্নির ফল যেখানে অ্যাশিওর্ড, অর্থাৎ গ্যারান্টিড, সেখানে সুখ এবং সোয়াস্তি, দুই-ই খুঁজে পাচ্ছেন অনেকে।
আর তা হবে না-ই বা কেন? আপনি আজীবন খেটেখুটে টাকা-পয়সা জমিয়ে, ‘অবসরকালীন দিনগুলো যেন ভালভাবে কাটে’ গোছের চিন্তায় তাড়িত হয়ে, সম্পদ গঠন করেছেন। ভাল কথা, এইবার আপনি চাইবেন অল্পস্বল্প হলেও কিছু পেনশন নিয়মিতভাবে হাতে পেতে। পেনশন যদি প্রধানত বাজার-নির্ভর হয়ে যায়, তাহলে ন্যূনতম পরিমাণে টাকা না-ও পেতে পারেন। বাজার যদি ঠিকঠাক চলে, তাহলে আপনার কপাল ভাল; পরন্তু বাজার যদি পড়ে, এবং ক্রমাগত পড়তেই থাকে, তাহলে পরিস্থিতি বেশ জটিল হয়ে যেতে পারে। এরই প্রেক্ষিতে দরকার হচ্ছে ‘মিনিমাম গ্যারান্টি’ বা ন্যূনতম প্রতিশ্রুতি যুক্ত পেনশন, যা একশো ভাগ বাজার-ভিত্তিক পেনশনের বিকল্প হিসাবে পাওয়া যাবে।
‘MARS’-এর আবির্ভাব কোনও হঠাৎ পড়ে পাওয়া চোদ্দো আনা নয়। অনেক কাল যাবৎ ‘নিউ পেনশন সিস্টেম’ (‘এনপিএস’ বলে যা পরিচিত) নিয়ে তরজা চালু রয়েছে। এনপিএস সরিয়ে ‘ওপিএস’, অথবা ‘ওল্ড পেনশন সিস্টেম’, ফিরিয়ে আনার চেষ্টাও জারি। নিউ বনাম ওল্ডের নেপথ্যে যে সূক্ষ্ম রাজনীতি, যা পেনশন রিফর্মের ধারা অন্য খাতে বইয়ে দিচ্ছে এই মুহূর্তে, তার চোরাগলিতে আর ঢুকলাম না। তবে সংক্ষেপে বলে রাখি, একাধিক রাজ্য (উদাহরণ: পাঞ্জাব) ইতিমধ্যে ওপিএস ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট, এবং সেই মর্মে ঘোষণাও সেরে রেখেছে। ব্যস, আপাতত এইটুকুই থাক।
পেনশন তথা সামাজিক সুরক্ষা, যেভাবেই দেখেন না কেন বিষয়টা, ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশে যে খুব জরুরি, তা আর নতুন করে বলার দরকার নেই। বিশ্বের নানা কোণে পেনশন নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চলছে গত দু’-তিন দশক ধরে। আমরাও করেছি, তারই ফলস্বরূপ পেয়েছি আজকের এনপিএস। খেয়াল করুন, সরকারের ব্যয়ের এক বিরাট অংশ যায় পেনশন বিল মেটাতে। এর সঙ্গে আছে বিভিন্ন সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প। কোনও দিন যদি এসব প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়, তাহলে তা দেশ-জোড়া বিপর্যয়ের সমতুল্য হবে। এখনকার প্রশ্নটা প্রত্যাহার ঘিরে আদৌ নয়, সাধারণ মানুষের জিজ্ঞাসা রিফর্মের পরের ধাপ নিয়ে। কেমন হবে সেই পরের পদক্ষেপ, পরের মাইলফলক কবে পেরিয়ে যাব আমরা?
উত্তরের গোড়ায় আছে ন্যূনতম প্রতিশ্রুতি, যা মানুষের আর্থিক পরিকল্পনাকে ব্যাহত করবে না। মনে রাখতে হবে- মুদ্রাস্ফীতি ইতিমধ্যে আমাদের ‘রিটায়ারমেন্ট কর্পাস’ কমিয়ে আনছে। আপনার জমানো সম্পদের পরিমাণ হয়তো কোটি টাকা (উদাহরণ), কিন্তু তার নিট ক্রয়ক্ষমতা তো কমে আসছে দ্রব্যমূল্য বাড়ছে বলে। তাই সম্পদকে বিনিয়োগ করতে হবে সঠিকভাবে, যাতে ইনফ্লেশন এবং ইনকাম ট্যাক্স, এই দুই জাত-শত্রু প্রতিহত হয়। বিশেষজ্ঞরা এমনই বলে থাকেন।
[আরও পড়ুন: মানুষের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না মেকি বাস্তবতা, প্রয়োজন কীসের?]
এই পরিস্থিতির মধ্যে দাঁড়িয়ে কি আমরা বুঝতে পারছি মার্স ঠিক কোন চেহারায় আসবে? না, এখনও পুরোপুরি বলার সময় আসেনি, ইতিউতি খবরের ভিত্তিতে তার হালকা আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে মাত্র। যেমন ধরুন, গ্যারান্টি যুক্ত প্রকল্প হলেও রেট নাকি ‘ফিক্সড’ হবে না, হবে ‘ফ্লোটিং’। আর ফ্লোটিং রেট প্রতি বছর আলাদা করে বলে দেওয়া হবে। সংক্ষেপে, ‘রি-সেট’ (reset) করা হবে। এছাড়াও, এই নতুন পরিকল্পনায় যাঁরা যুক্ত হবেন, তাঁদের দশ বছরের লক-ইন শর্তে রাজি হতে হবে। আর গ্যারান্টি দেওয়া হবে টেন-ইয়ার গভর্নমেন্ট সিকিউরিটির রিটার্নের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে।
মনে করুন, ২০২৩-এর জন্য ৭ শতাংশ হারে গ্যারান্টি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সরকারি ঋণপত্রের রিটার্নের বিষয়টা মনে রেখে। পরের বছর, এই ঋণপত্রের বাজারি পারফরম্যান্স অন্যরকম হল, বেড়ে গিয়ে ৭.৫ শতাংশে গিয়ে দাঁড়াল। সেক্ষেত্রে ২০২৪-এর গ্যারান্টির জন্য নিয়মও বদলাবে, ‘আপওয়ার্ড রিভিশন’ যাকে বলা হয়। আসলে ৭-৭.৫ এখানে মূল বিষয় নয়। দীর্ঘমেয়াদের জন্য কি সাধারণ অবসর-প্রাপ্ত নাগরিক ন্যূনতম গ্যারান্টি পাবেন, এই প্রশ্নই মুখ্য। প্রসঙ্গটা ইদানীং বড় আকার নিয়েছে, কারণ, অবসরের ধ্যান-ধারণাই বদলে গিয়েছে। আগেকার সেই স্টিরিওটাইপ- অর্থাৎ ৬০ বছরে রিটায়ার করে পেনশনভোগী আর নেই। চারপাশে কত লোক, বেতনই পান বা ব্যবসায়ের প্রফিট, অপেক্ষাকৃত অল্প বয়সেই অবসর নিচ্ছেন। কড়া সত্য হল, অবসর নিতে তঁাদের একাংশ বাধ্য হচ্ছেন। হয় টেকনোলজি এসে তাঁদের কাউকে ব্রাত্য করে দিচ্ছে, নয় কর্পোরেট সংস্থা কৌশল পরিবর্তন করে পুনর্গঠিত হচ্ছে। মোদ্দা কথা, চাকরি-ব্যবসা-বেতন-উপার্জনের সংজ্ঞা আজকাল বেশ অন্যরকম। অবসরের নিয়মকানুনও এখন ভিন্ন।
এর ফল কী হতে পারে, তা সহজেই অনুমান করা যায়। আমাদের দেশে ‘ডিপেন্ডেন্সি রেশিও’ বেশ চড়া ধরনের, মানে জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে অনেকেই অন্যের উপর আর্থিকভাবে নির্ভর করি। জমানো টাকা ফুরিয়ে যাওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা, ‘আ ম্যাটার অফ টাইম’, তারপর আত্মীয়-পরিজনের উপর ভরসা রেখে দিন কাটাতে হবে। এমনভাবেই তো দীর্ঘদিন ধরে বেঁচে থাকেন মানুষ, মেডিক্যাল সায়েন্সের উন্নতি হওয়া তার অন্যতম কারণ।
৫০-৬০ বছরে অবসর নিয়ে ১৫-২০ বছর স্বচ্ছন্দে জীবিত থাকা সম্ভব, তখন অর্থকষ্টে ভুগলে, বা পেনশন থেমে গেলে, বিলক্ষণ অসুবিধা হবে, তা তো জানাই আছে। আর চিকিৎসা বিজ্ঞানে উন্নতিতেও স্বাস্থ্যখাতে খরচাপাতি কমানো খুব সহজ কাজ নয়। ডাক্তার-হাসপাতাল ঘাঁটতে হয় যে অবসরপ্রাপ্ত রোগীদের, তাঁদের জিজ্ঞাসা করলেই বাস্তবটা বোঝা যাবে।
এই লেখার অবয়ব একটু ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে দেখে নিই। এনপিএস ধীরে ধীরে কলেবরে বাড়ছে, তা সর্বশেষ পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট। গত আর্থিক বর্ষ যদি ধরেন, তাহলে নতুন পদ্ধতির মধ্যে গ্রাহকের (‘সাবস্ক্রাইবার’) সংখ্যা প্রায় ১.৩৬ কোটি। এর মধ্যে ‘এনপিএস প্রাইভেট সেক্টর’ নামক অংশে এনরোলমেন্টের সংখ্যা ১০ লক্ষ ছাড়িয়েছে। তর্ক উঠবে, প্রশ্নও শোনা যাবে, আমাদের এই ১৪০ কোটির দেশে এই সংখ্যা তো ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র। হ্যাঁ, ঠিকই, তবে শুরু হয়েছে যখন, বড়সড় ট্রেন্ড ঠিক তৈরি হয়ে উঠবে। বিনা পেনশনে রয়েছেন যাঁরা, তাঁদের সমর্থন নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে। পরিকল্পিত পেনশন প্রকল্প। সামাজিক সুরক্ষার দিক থেকে খুবই ইতিবাচক। পশ্চিমি দেশে, ডেভেলপ্ড ওয়ার্ল্ড যদি দেখেন, সেখানে সোশ্যাল সিকিউরিটি যথেষ্ট পরিকল্পিত। সমাজের নানা স্তরে তা পৌঁছে যায় সহজেই। এখানে ছবিটা অন্যরকম- জনসংখ্যার বড় এক অংশের কাছে সুরক্ষা আসে সরকারের বিভিন্ন প্রকল্পের হাত ধরে। নিজে থেকে পেনশনের সুষ্ঠ ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি, এমন মানুষের সংখ্যা কম নয়।
তার মানে, এই যে পেনশন-বিমা ইত্যাদির হর্তাকর্তারা মাঝে মাঝেই রিটায়ারমেন্ট প্ল্যান, পেনশন প্ল্যান, অ্যানুইটি সংক্রান্ত বক্তব্য রাখেন, তা মূলত একপেশে প্রমাণিত হয়ে যায়। একপেশেই বলব, কারণ প্রধানত মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্তের মধ্যে এই শ্রেণির প্রকল্প সীমিত অবস্থায় আছে। অ্যানুইটি নিয়ে আগ্রহী মানুষ আছেন বটে অনেক, তবে আম-আদমির হাতে আসতে তার এখনও দেরি। বিভিন্ন বিমা সংস্থা চেষ্টা করছে, নতুন প্রকল্পের অভাব নেই, তবুও বলি, সময় লাগবে। আজও বিমার আওতার বাইরে আছে অগণিত ভারতীয়। এ-দেশের নীতি নির্ধারক যাঁরা, তাঁরা যেন এই বিষয় নিয়ে গভীরভাবে চিন্তাভাবনা করেন।
শেষ করার আগে বলি যে, নিউ পেনশন সিস্টেমের পরিমার্জনা তথা পরিবর্তনের সময় বোধহয় জোর কদমে এগিয়ে আসছে। নতুন ধারণার সঙ্গে খাপ খাইয়ে তা করে ফেলতে হবে, আর তাতেই সংস্কারের ধারা অক্ষুণ্ণ থাকবে। স্বল্প মাত্রায় গ্যারান্টি চাওয়ার নেপথ্যে যে আশা-আকাঙ্ক্ষা কাজ করে, তাকে যথার্থ মান্যতা দিতে হবে। সেই সদিচ্ছাটুকু থাকা দরকার, তাহলে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাস্তবমুখী পলিসি গঠন করা যাবে। না হলে দেশের সাধারণ মানুষের এক বড় অংশ পেনশনের মূলস্রোত থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় থাকবে। তেমন অবস্থা যাতে না আসে, তা নিশ্চিত করা সরকারের দায়িত্ব। যে ইনক্লুসিভ গ্রোথ আমরা সবাই খুঁজি, যা নীতি রূপায়ণকারী নিয়ন্ত্রক ক্রমাগত খুঁজে চলেছে, তা অধরা থেকে যাওয়া কাম্য নয়। তাই ইতিবাচক শর্তগুলো বজায় রাখতে হবে– প্রাইভেট সেক্টরের পেনশন ফান্ড থেকে শুরু করে সরকারি স্তরের সুরক্ষা প্রকল্প, কিছুই যেন বাদ না পড়ে। হালে দেখা অশনিসংকেত থেকে অনেক কিছু শিক্ষা নেওয়া উচিত।