বোরিয়া মজুমদার: মিলখা সিংকে (Milkha Singh) নিয়ে ইতিমধ্যে অনেক লেখালিখি হয়ে গিয়েছে। বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন ভেসে আসছে। কেনই বা আসবে না? তিনি যে ভারতের অন্যতম সেরা একজন ভূমিপুত্র। এই ‘ফ্লাইং শিখ’ যে চিরকাল ভারতের মনের মণিকোঠায় জীবিত থেকে যাবেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু এসব পেরিয়ে, আজ যে-কথা জানতে পেরে অবাক হবেন, তা হল-১৯৬০ সালের রোম অলিম্পিক (Rome Olympic 1960), মিলখা সিংয়ের একইসঙ্গে সবচেয়ে ভাল ও সবচেয়ে খারাপ সময়!
রোম অলিম্পিক শুরু হওয়ার একহপ্তা আগেও মিলখা সিং ছিলেন চর্চার শীর্ষে। ৪০০ মিটার দৌড়ের আলোচনায় তাঁরই নাম। সবাই মনে করছে, তিনিই স্বর্ণপদকের দাবিদার। সে সময় ভারতীয় দৌড় টিমের সহকারী কোচ ভিন্স রিল তো রীতিমতো আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে মিলখা সোনা না হলেও একটা না একটা পদক জিতছেনই। এমন ধারণা তৈরি হওয়ার কারণ ছিল বইকি। কারণটা এই মিলখা তখন তাঁর শারীরিক অবস্থার টপ ফর্মে। সে সময় তাঁর ট্রেনিংয়ের পদ্ধতি বেশ কিছু সংবাদপত্রে সবিস্তার প্রকাশিত হয়েছিল– “India’s great hope has been devoting between an hour and an hour and a half to training every day since his arrival in Rome. He is cutting the distances to sprints of about 150 yards with the object of speeding up.” ভাবা যায়! রোমে আসার পর থেকেই, প্রথমে একঘণ্টা একঘণ্টা করে বিরতি, এরপর আধঘণ্টা বিরতিতে চলছে টানা ট্রেনিং। আর, স্প্রিন্ট টানার বিষয়ে প্রতিবার দেড়শো গজ কমিয়ে আনছেন– যাতে দৌড়ের শুরু থেকেই গতিবেগের সূচক থাকে তুলনায় উপরে। এমনটা করার কারণ হিসাবে ভিন্স রিল আরও বলেছিলেন– এভাবেই মিলখার স্ট্যামিনা বাড়বে। আর এখন যদি স্ট্যামিনা না বাড়ে, তাহলে আর কখনওই বাড়বে না!
[আরও পড়ুন: কিংবদন্তি মিলখা সিংকে বিশেষ সম্মান পাঞ্জাব প্রশাসনের, আবেগঘন পোস্ট করলেন ছেলে]
এর সঙ্গে রোম অলিম্পিকের যে বিষয়টি মিলখাকে আনুকূল্য দেবে বলে মনে করা হয়েছিল, তা হল: রোমে তখন তপ্ত গ্রীষ্মকাল। মিলখা এমনকী, নিজেও ভেবেছিলেন, এই রোদ আর গরম বাকিদের বিড়ম্বনার কারণ হয়ে দাঁড়াবে ভালই। সেবার মেলবোর্ন গেমসে স্টিপলচেস বিজেতা ক্রিস্টোফার ব্রেশারও মিলখা সিংকে নিয়ে উচ্চাশী ছিলেন। তাঁর মতামত ছিল: মিলখার জয়লাভের সমূহ সুযোগ এবার দু’টি কারণে। মিলখার ফর্ম এবং সবচেয়ে বড় বিষয়, খেলার সময়সূচি। এর আগে অবধি অলিম্পিকে দৌড় প্রতিযোগিতায় সেমিফাইনাল ও ফাইনাল ম্যাচ হত একই দিনে। কিন্তু রোম অলিম্পিকে নিয়ম হল, সেমিফাইনালের পরের দিন হবে ফাইনাল ম্যাচ। বিশ্রাম নেওয়ার, মনোনিবেশ করার জন্য প্রায় চব্বিশটা ঘণ্টা সময় হাতে, ফাইনালের রেসে নামার আগে। এবং এই সময়টা মিলখাকে অন্যান্য অ্যাথলিটের তুলনায় অনেক বেশি সুবিধা করে দেবে বলে মনে করা হয়েছিল।
সমস্ত আশা ও আন্দাজের মুখরক্ষা করে মিলখা তাঁর অলিম্পিকের রেকর্ড ভাঙেন। ৪৫.৬ সেকেন্ডে রেস শেষ করলেন। কিন্তু হলেন চতুর্থ। কী করে? পৃথিবীর অন্যতম সেরা দৌড় হিসাবে ধরা হয় এই ইভেন্টকে। এই রেসের প্রতিটি মুহূর্ত লিখে রাখা হয়েছিল নিপুণভাবে, যা আবার আজ উল্লেখ করার দাবি রাখে। সেবারে পুরুষদের ৪০০ মিটার রেস ছিল এ যাবৎ রেসের ইতিহাসে দেখার মতো একটা ঘটনা। আমেরিকার ২৮ বছর বয়সি ওটিস ডেভিস ০.৩৩ সেকেন্ডের জন্য বিশ্বরেকর্ড ভাঙলেন এবং প্রথম স্থান ছিনিয়ে নিলেন জার্মানির কার্ল কফমানের থেকে কয়েক সিকি দূরত্বের ব্যবধানে। দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যালকম স্পেন্স তৃতীয় হলেন ৪৫.৫ সেকেন্ডে, আর ভারতের মিলখা সিং চতুর্থ স্থানাধিকারী হলেন ৪৫.৬ সেকেন্ডে।
[আরও পড়ুন: পশ্চিমবঙ্গে কি ৩৫৬ ধারা প্রয়োগ করবে কেন্দ্রীয় সরকার?]
বলা বাহুল্য, ভারতবাসীদের হারানোর কিছু ছিল না। আজও নেই। ঘটনাচক্রে মিলখা সিং এমন এক রেসে নেমে পড়েছিলেন, যেখানে আবার বাকিরাও সে সময় তাঁদের নিজেদের সেরাতম ফর্মে। এই দৌড় নাকি ছিল দেখার মতো। শুরু থেকেই, শেষ পর্যন্ত, ছ’জন দৌড়বিদই তড়িৎ বেগে শুরু করেছিলেন। এমনকী, মিলখা সিং নিজেও তাঁর সেরাতম দৌড়টা দিয়েছিলেন এই ইভেন্টে। এর আগের আন্তর্জাতিক রেসে, প্যারিসে, ফ্রান্সের আবদুল সেয়ে-কে তিনি হারিয়েছিলেন যখন, তখন তাঁর বেস্ট ফর্ম: ৪৫.৮ সেকেন্ড। এবারেও, অলিম্পিকে, তিনি তাঁর সেরা দৌড় সঁপে দিচ্ছিলেন ট্র্যাকে। সমস্ত মুহূর্ত ছিল তাঁরই জয়ের অনুসারী। শুরুর দিকে মিলখা এবং কিন্ডার প্রথম অবস্থানে ছিলেন। কিন্তু শেষের দিকে হঠাৎই ডেভিস সবাইকে টপকে গেলেন। এমনকী, টপকে গেলেন কফমানকেও, এক গোড়ালি দূরত্বে। মিলখা সে সময় স্পেন্সের পিছনে চতুর্থ অবস্থানে। তাঁদের মধ্যে দূরত্ব বড়জোর এক ফুটের, কিংবা তা-ও না। প্রথম থেকেই যদি মিলখা সমস্ত বেগ দিয়ে ছুটতে না শুরু করতেন, তাহলে হয়তো ব্রোঞ্জ মেডেলটা তাঁরই হত। এর ঠিক আড়াই দশক পর, পুনরায় ভারত স্বপ্ন দেখেছিল পি. টি. উষাকে নিয়ে। কিন্তু তা হয়নি। ফলে মিলখা সিংয়ের সেই হারের দুঃখই ভারতীয় ক্রীড়া ইতিহাসে আজও এক অবিকল্প দুঃখ হিসাবে রয়ে গিয়েছে। রয়ে গিয়েছে চিরকালীন না-পাওয়া হয়ে।
মিলখা নিজেই বলেছিলেন- সেই রেসের প্রতিটা সেকেন্ড তিনি নিখুঁতভাবে মনে রেখেছেন, যা তিনি তাঁর জীবনের সবচেয়ে ভাল ও একইসঙ্গে সবচেয়ে খারাপ মুহূর্তমালা বলে মনে করেন। বলেছিলেন, ফাইনাল ম্যাচের জন্য স্টেডিয়ামে আমি যখন যাচ্ছি, মনে আছে, আমি বেশ চিন্তামুক্ত ফুরফুরে মেজাজে ছিলাম। কিন্তু প্রতিদ্বন্দ্বীদের সামনাসামনি হওয়া মাত্র আমার ভিতর চাপ বাড়তে শুরু করে। প্রতি মিনিটে তা ক্রমাগত বেড়ে চলেছিল। দক্ষিণ আফ্রিকার দৌড়বিদ ম্যালকম স্পেন্সকে বাঁপাশে রেখে পাঁচ নম্বরে আমার লাইন বাছলাম। ডানদিকে জার্মানির মানফ্রেড কিন্ডার। রেস শেষ হল যখন, সে এক ফোটোফিনিশ মোমেন্ট। ঘোষণার অপেক্ষা। সাসপেন্স যেন বাঁধ ভাঙছে। আমি ততক্ষণে বুঝে গিয়েছি, একটা ভুল আমি করে ফেলেছি। তার কারণ, আমি অত্যন্তরকমের প্রস্তুত ভেবেছিলাম নিজেকে এবং ভেবেছিলাম কোনও না কোনও মেডেল আমি পাচ্ছিই। প্রথম ২৫০ মিটার দৌড়নোর পর কয়েক খুচরো সেকেন্ডের জন্য আমি আমার গতি খানিক কমিয়ে দিয়েছিলাম। আর সেটাই কাল হল! ওই মুহূর্তের মধ্যে আমাকে একের পর এক জন পেরিয়ে যেতে থাকল। ওই খোয়ানো মুহূর্ত আমি আর ফিরে পেলাম না কোনওভাবেই, কোনওভাবেই পুষিয়ে দিতে পারলাম না। ছোট্ট একটা সিদ্ধান্ত নেওয়ার গলতি, আমাকে রেস থেকে সরিয়ে দিল তো বটেই, একইসঙ্গে মেডেলও হারালাম। মা-বাবার মৃত্যুর পর, এই পরাজয় আমার ভয়ংকরতম স্মৃতি। এমনই ছিল ভারতের অন্যতম ক্রীড়াবিদের স্মৃতিচারণা। ‘এই রেসের পর কেমন অবস্থায় ছিলেন আপনি?’ জানতে চাওয়ায়, প্রায় ৬০ বছর পিছিয়ে গেলেন যেন তিনি। বললেন, ‘দিনের পর দিন আমি কেবল কেঁদে কাটিয়েছিলাম।’ একজন সত্যিকারের খেলোয়াড় হয়ে খেলা শেষে তিনি মেডেল প্রদান অনুষ্ঠানের অপেক্ষা করেছিলেন। ডেভিস, কফমান এবং স্পেন্সকে অভিবাদন দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছিলেন। ‘কিন্তু সত্যি বলছি, আমার তখন একটুও ইচ্ছা করছিল না ওদের অভিনন্দন জানানোর। যদি সত্যি পারতাম, তবে ওদের থেকে মেডেল ছিনিয়ে আমি দৌড় মারতাম।’ ভয়ংকর ভেঙে পড়েছিলেন মিলখা, মনস্থির করেছিলেন বিদায় নেবেন খেলা থেকে। কিন্তু অনেকরকম বলা-কওয়ার পর তিনি আবার খেলায় ফিরে আসেন।
[আরও পড়ুন: Euro Cup 2020: সূর্যাস্তের আগে নতুন সূর্যোদয়ের খোঁজে সিআর-সেভেন]
একজন প্রতাপশালী অ্যাথলিট হিসাবে মিলখা প্রথম তাঁর অবস্থান শক্তপোক্ত করেছিলেন ১৯৫৬-র ন্যাশনাল গেমসে, পাতিয়ালায়। দু’বছর পর ২০০ এবং ৪০০ মিটার রেসে কটকে আয়োজিত ন্যাশনাল গেমসে রেকর্ড ভাঙলেন। ১৯৫৮-য় টোকিও এশিয়াডে ফ্লাইং শিখ ২০০ এবং ৪০০ মিটার, দুটোতেই প্রথম স্থানাধিকারী হলেন। ১৯৫৮-য় কারডিফ কমনওয়েলথ গেমসে, দক্ষিণ আফ্রিকার ম্যালকম স্পেন্সকে হারালেন ৪০০ মিটার দৌড়ে, জিতলেন সোনার মেডেল। যদিও স্পেন্স তাঁর শেষ হাসিটা হাসলেন আর দু’বছর পর ’৬০-এর অলিম্পিকে, মিলখার থেকে এক ফুট দূরত্বে ব্রোঞ্জ মেডেল ছিনিয়ে। কোনও সন্দেহ নেই, মিলখা সিং ভারতের সেরার সেরা অ্যাথলিট। রক্তক্ষয়ী দেশভাগে, মা-বাবাকে হারিয়েছিলেন তিনি। বিভিন্ন বিপত্তি, বাধা পেরিয়ে হয়ে উঠেছিলেন ‘দ্য ফ্লাইং শিখ’। কোটি কোটি দর্শকের, মানুষের মন জয় করেছিলেন তিনি। ভারতীয় উপমহাদেশে অন্যতম একজন ব্যক্তিত্ব ছিলেন তিনি। মৃত্যুর পরও তিনি আমাদের মনে চিরকালীন থেকে যাবেন। এই মহাতারকা বিশ্বকে ভারতীয় অ্যাথলেটিক্সের সঙ্গে পরিচয় করিয়েছিলেন। সেদিক দিয়ে ভাবলে, তিনি আজ পোডিয়ামের সবচেয়ে উঁচু জায়গায় আসীন।