সব্যসাচী বাগচী: টিভি-মোবাইলে ম্যাচ জেতানো ব্যাটিং কিংবা বোলিং দেখা চোখের শান্তি। সোশাল মিডিয়ার যুগে সেই মুহূর্তগুলো ভাইরাল যায় মুহূর্তের মধ্যেই। তবে সেই আগুনে পারফরম্যান্সের নেপথ্যে থাকে অনেক লড়াই। কঠোর পরিশ্রম,দায়বদ্ধতা ও আত্মত্যাগ। সেগুলো একসঙ্গে মিশিয়েই চলতি বিশ্বকাপে (Cricket World Cup 2023) রাজার মতো কামব্যাক করলেন মহম্মদ শামি (Mohammed Shami)। নিউজিল্যান্ডের (New Zealand) বিরুদ্ধে নিয়েছিলেন ৫৪ রানে ৫ উইকেট। তবে কঠিন পরিশ্রমগুলোর তো লাইভ টেলিকাস্ট করা যায় না। সেটাই সংবাদ প্রতিদিন.ইন-কে জানালেন তাঁর ছোটবেলার কোচ বদরুদ্দিন সিদ্দিকি (Badruddin Siddiqui)।
গত কয়েক ম্যাচে জশপ্রীত বুমরাহের (Jasprit Bumrah) সঙ্গে নতুন বলে ইনিংস শুরু করছেন মহম্মদ সিরাজ (Mohammed Siraj)। সঙ্গে তৃতীয় পেস বোলার হিসাবে খেলছিলেন হার্দিক পাণ্ডিয়া (Hardik Pandya)। আর বাড়তি অলরাউন্ডার শার্দূল ঠাকুর (Shardul Thakur)। ফলে এশিয়া কাপে (Asia Cup 2023) সব ম্যাচ খেলার সুযোগ পাননি। তবুও সামান্য সুযোগেই মেলে ধরেছিলেন নিজেকে। নেপালের বিরুদ্ধে ২৯ রানে ১ উইকেট নেওয়ার পর, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নিয়েছিলেন ৩২ রানে ২ উইকেট। এখানেই আগুনে বোলিংয়ের পালা শেষ হয়ে যায়নি। কাপ যুদ্ধে নামার আগে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে মোহালিতে ৫১ রানে ৫ উইকেট নিয়েছিলেন ‘সহেসপুর এক্সপ্রেস’। মোরাদাবাদের জমিদার পরিবারের ছেলে সাদা বল হাতে নিয়েই তাঁর ঠাটবাঁট বুঝিয়ে দিচ্ছেন। কিন্তু কীভাবে শামি ফিরে আসার জন্য এককভাবে লড়াই করেছিলেন? সেটাই জানালেন তাঁর ‘মেন্টর’।
হাতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা। ইংল্যান্ডের (England) বিরুদ্ধে লখনউয়ের একানা স্টেডিয়ামে ষষ্ঠ জয়ের খোঁজে নামবে টিম ইন্ডিয়া (Team India)। এর আগে অন্তর্মুখী শামির নিবিড় অনুশীলন নিয়ে বদরুদ্দিন বলছিলেন, “ভারতীয় দলের জার্সি গায়ে নিজেকে নিংড়ে দেওয়ার জন্য শামি নিজের আলি নগরের ফার্ম হাউসে বেশ কয়েকটা পিচ তৈরি করেছে। সেখানে হার্ড লেন্থে বোলিং করার জন্য একেবারে পাটা পিচ তৈরি করা হয়েছে। ঘাসের পিচে শামি কেমন বোলিং করে সেটা গোটা দুনিয়া জানে। ওর সিম মুভমেন্ট একেবারে সোজা থাকে। সেটা আরও ক্ষুরধার করতে একটা পিচে প্রচুর ঘাস রেখেছে। আর একটা পিচ একটু স্লো ধরনের। থমকে আসা পিচে কীভাবে বোলিং করতে হয় সেটা ঝালাই করে নেয় শামি।” কেন সবার আড়ালে শামি নিজেকে নিয়ে ঘষামাজা করেন? বদরুদ্দিন যোগ করলেন, “শুধু সংসার চালানোর জন্য অর্থ রোজগার করে লাভ নেই। উপার্জন করা অর্থ নিজের উন্নতির জন্যও খরচা করতে হয়। শামি ব্যাপারটা খুব ভালোভাবে জানে। গ্রামের বাড়িতে থাকলে ও সকাল-বিকেল অনুশীলন করবেই। আমি, ওর ভাই মহম্মদ কাইফ এবং উঠতি ছেলেদের সঙ্গে একনাগাড়ে বোলিং করে যায় শামি। বছরের পর বছর এই রুটিন মেনে যাচ্ছে। এরমধ্যে বছর খানেক আগে নিজের ফার্ম হাউসের মধ্যেই একটা জিম বানিয়েছে। এভাবেই ও নিজেকে ফিট রাখে।”
[আরও পড়ুন: বিশ্বকাপে রিজওয়ানের ‘গান্ধীগিরি’, জ্যানসেনের কটূক্তির জবাবে কী করলেন পাক তারকা?]
শামির বয়স যখন মাত্র আট বছর, তখন থেকে ওঁকে চেনেন বদরুদ্দিন। উত্তরপ্রদেশের মোরাদাবাদ জেলার সহেসপুর গ্রামেই থাকেন তিনি। ‘সহেসপুর এক্সপ্রেস’-এর প্রশংসা করে ভারতের টিম ম্যানেজমেন্টকে একহাত নিলেন। কাপ যুদ্ধে বুমরাহের সঙ্গে সিরাজকে সুযোগ দেওয়া নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই। তবে শার্দূল কেন সুযোগ পাচ্ছেন? সেটাই ভেবে পাচ্ছেন না তিনি। বদরুদ্দিন অকপটে জানালেন, “বুমরাহের সঙ্গে সিরাজকে রাহুল দ্রাবিড় (Rahul Dravid) ও রোহিত শর্মা (Rohit Sharma) সুযোগ দিচ্ছে। এটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু শার্দূল কীভাবে সুযোগ পাচ্ছে? একটা বাড়তি ব্যাটার খেলানোর জন্য শার্দূলকে সুযোগ দেওয়া আমার কাছে বাড়াবাড়ি। শামি মাঠে থাকলে বিপক্ষের ব্যাটাররা আরও চাপে থাকবে। সেটা কি টিম ম্যানেজমেন্ট বুঝতে পারছে না!”
অতীতে ডেথ ওভারে প্রভাব ফেলতে পারেননি। কিন্তু এবার কিউইদের বিরুদ্ধে কীভাবে নিজেকে বদলে ফেললেন শামি? বদরুদ্দিনের প্রতিক্রিয়া, ‘বুমরাহকে নিয়ে অনিশ্চয়তার সময়ই শামির কাছে টিম ম্যানেজমেন্ট বার্তা দিয়েছিল। সেভাবে ডেথ বোলিংয়ের উপর কাজ শুরু করে দিয়েছিল। পুরনো বল ভিজিয়ে শামি অনুশীলন করত। গ্রাম থেকে সুস্থ হয়ে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে গিয়েও শামি পুরনো বলকে ভিজিয়ে অনুশীলন করে যেত। যাতে শিশির ফ্যাক্টর হলেও সমস্যা না হয়। এছাড়া স্লো বাউন্সার, স্লো ইয়র্কার, নাকল ডেলিভারি তো আছেই। সঙ্গে যোগ হয়েছে অধ্যাবসায়। সেটা নিশ্চয়ই সবাই বুঝতে পারছে।”
আত্মবিশ্বাস বোঝাই করেই যে শামি গত ম্যাচে মাঠে নেমেছিলেন সেটা নিয়ে কারও সন্দেহ নেই। শামির দৌড় দেখেই বোঝা যাচ্ছিল। ‘সহেসপুর এক্সপ্রেস’-এর দৌড় দেখে অনেকেই বলতে শুরু করে দিয়েছেন, শামি নাকি মটন বিরিয়ানি খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন! যদিও এমন জল্পনাকে গল্প বলেই উড়িয়ে দিলেন তাঁর কোচ। শেষে বলে দিলেন, “শামি জমিদার বাড়ির ছেলে। টিম ইন্ডিয়ার তারকা হলেও ওর মধ্যে সেই জমিদারী ব্যাপার যায়নি। এখনও আগের মতোই মটন বিরিয়ানি খায়। সঙ্গে থাকে মশলাদার খাবার। আসলে ও প্রচন্ড ফিট। তাই বিরিয়ানি ছেড়ে দেওয়ার বান্দা ও নয়।”
শামির বিরিয়ানি প্রেম নিয়ে রবি শাস্ত্রীর একটা পুরনো টুইট মনে পড়ে যাচ্ছে। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্টে আগুনে বোলিং করার পর টিম ইন্ডিয়ার প্রাক্তন কোচ লিখেছিলেন, ‘আজ তোর জন্য ডাবল বিরিয়ানি লালা। যত পারিস খেয়ে নে!’ নিউজিল্যান্ডকে গুঁড়িয়ে দিয়ে তাঁকে ব্রাত্য করে রাখা ক্রিকেট বোদ্ধাদের মুখে সজোরে চড় মারলেন শামি! বুঝিয়ে দিলেন এই বিরিয়ানিই তাঁর সাফল্যের উৎস! এবার জস বাটলার-বেন স্টোকসদের উড়িয়ে দেওয়ার পালা। শামিকে আরও একবার সুযোগ দেবে টিম ম্যানেজমেন্ট?