সব্যসাচী বাগচী: সাত বছর পর ঘরে ফিরেছিলেন। তবে এবারের ফেরা কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না। নিন্দুকদের কটাক্ষ ছিল ২০১৬ এবং ২০২৩ সালের হরমনজ্যোত সিং খাবরার (Harmanjot Singh Khabra) মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। চলতি ডুরান্ড কাপের (Durand Cup 2023) প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ আর্মির বিরুদ্ধে তাঁর ভুলেই তিন পয়েন্ট মাঠে ফেলে এসেছিল ইস্টবেঙ্গল (East Bengal)। স্বভাবতই ৩৬ বছরের মিডফিল্ড জেনারেল ছিলেন কটাক্ষের কেন্দ্রে। নিন্দুকরা সুযোগ বুঝেই গোলাগুলি ছুঁড়ছিলেন। তবে সুযোগ পেয়েই জুয়ান ফেরান্দোর (Juan Ferando) ছেলেদের বিরুদ্ধে সব হিসেব বদলে দিলেন অতীতের বহু ডার্বি যুদ্ধের নায়ক।
এক সময় লাল হলুদ জার্সি গায়ে চুটিয়ে ফুটবল খেলেছিলেন। ট্রেভর জেমস মরগ্যানের (Travor James Morgan) আমলে খাবরা ছিলেন মাঝমাঠের অন্যতম স্তম্ভ। ৭ বছর পর ফের একবার লাল-হলুদ জার্সি গায়ে চাপিয়েই ঘটালেন ম্যাজিক। ডার্বি যুদ্ধে তারকাখচিত মোহনবাগানের (Mohun Bagan) লিস্টন কোলাসোকে (Liston Colaco) বুঝে নিলেন দলের অধিনায়ক। মর্যাদার ডার্বি জয়ের ঘোর এখনও কাটেনি। এরমধ্যেই সংবাদ প্রতিদিন ডট ইন-কে টেলিফোনে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন কার্লেস কুয়াদ্রাতের (Carles Cuadrat) নম্বর ‘সেভেন’।
প্রশ্ন: আট বছর পর ডার্বি খেললেন। অনুভূতি কেমন ছিল? চাপে ছিলেন?
খাবরা: অবশ্যই চাপে ছিলাম। প্রথম ম্যাচে আমার ভুলেই তো দল তিন পয়েন্ট হারিয়েছিল। সেটা নিয়ে মন খারাপ ছিল। এরসঙ্গে যোগ হয়েছিল অনেকদিন পর ডার্বি খেলার উত্তেজনা। সব মিলিয়ে আমি চাপে ছিলাম। তবে একইসঙ্গে একাধিক ডার্বি খেলার অভিজ্ঞতা ও এবার বাড়তি কিছু করে দেখানোর তাগিদ ছিল। সেটা তো ম্যাচের শেষে স্কোরবোর্ড বলে দিচ্ছে।
প্রশ্ন: একটা সময় ডার্বিতে আপনার পার্টনার ছিলেন উগা ওপারা, মেহতাব হোসেন, সৌমিক দে, টোলগে। ওঁদের কতটা মিস করেন?
খাবরা: আমাদের সেই সময় দারুণ দল ছিল। আই লিগ জিততে না পারলেও, সেই সময় আমরা অনেক কঠিন লড়াই জিতেছিলেন। কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াই করতাম। তাই সেই সতীর্থদের খুব মিস করি। বিশেষ করে সৌমিক ও মেহতাবকে এখনও মিস করি। তবে এই ছেলেগুলোর মধ্যেও দম আছে। সেটা ডার্বিতেই সবাই প্রমাণ পেয়েছে।
প্রশ্ন: এবার তো একাধিক আনকোরাদের নিয়ে খেলতে হল? তরুণদের কীভাবে উদবুদ্ধ করেছিলেন?
খাবরা: ড্রেসিংরুমে সবাইকে অতীতের ডার্বি নিয়ে পেপটক দিয়েছিলাম। বুঝিয়েছিলাম চাপের মধ্যেও কীভাবে পারফর্ম করতে হয়। বাকিটা সতীর্থরা বুঝে নিয়েছিল।
[আরও পড়ুন: Carles Cuadrat: ১৬৫৭ দিন পর লাল-হলুদের ডার্বি জয়ে হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা কার্লেস কুয়াদ্রাত]
প্রশ্ন: অনেক ডার্বি খেলেছেন। ডার্বিতে অনেক গোল দেখেছেন। নন্দকুমারের গোল কোন জায়গায় রাখবেন?
খাবরা: দেখুন সময় ও পরিস্থিতির বিচারে বিভিন্ন ডার্বির আলাদা প্রেক্ষাপট আছে। তাই কোন ডার্বি গোল আমার কাছে সেরা সেটা নিয়ে আলোচনা করে লাভ নেই। কারণ আমি এবং আমার মতো বাকিরা এই মুহূর্তে নন্দকুমারের গোলেই মজে আছি। এমন গোল কিন্তু সবসময় দেখা যায় না। একজন ফুটবলার স্কিলফুল হলে তবেই এভাবে গোল করতে পারে।
প্রশ্ন: ম্যাচ জয়ের পর নন্দকুমারকে কিছু বলেছিলেন?
খাবরা: ম্যাচ জয়ের পর ওকে অভিনন্দন জানিয়েছি। তবে ডার্বি খেলতে নামার আগে নন্দকুমারের সঙ্গে অনেকক্ষণ কথা বলেছিলাম। বলেছিলাম, ও অনেক বড় মাপের ফুটবলার। তবে অবাক করা ব্যাপার হল নন্দকুমার নিজের প্রতিভা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নয়। ও নিজের ক্ষমতায় কীভাবে ম্যাচে রং বদলে দিতে পারে সেটাই বোঝাতে চেয়েছিলাম। ভাল লাগছে নন্দকুমার নিজের প্রতিভার প্রমাণ দিল।
প্রশ্ন: মাঠে আপনারা পারফর্ম করলেন। মাঠের বাইরে কার্লসে কুয়াদ্রাত সবুজ-মেরুনকে টেক্কা দিলেন। এই ডার্বি জয়ে কোচ তো অনেক বড় ভূমিকা পালন করলেন?
খাবরা: একদম। কার্লেস কুয়াদ্রাত এই ডার্বি জয়ে অনেক বড় ভূমিকা পালন করেছেন। অনেকের দাবি ছিল কেরিয়ারের প্রথম ডার্বি বলে আমাদের কোচ চাপে থাকবে। কিন্তু নিন্দুকরা ভুলে গিয়েছিল যে, আমাদের কোচ কিন্তু বার্সেলোনা, এল সালভাডোর, বেঙ্গালুরু এফসি-র মতো দলকে কোচিং করিয়ে এসেছেন। সেই অভিজ্ঞতাই কিন্তু কার্লেস এবার কাজে লাগালেন।
প্রশ্ন: কোচ কি ড্রেসিংরুমে বিশেষ কিছু পেপটক দিয়েছিলেন?
খাবরা: আমাদের কোচ কিন্তু অনুশীলন শেষ হলেই হোটেলে ফিরে বিশ্রামে চলে যান না। বরং ম্যাচের কয়েক দিন আগে থেকে বিপক্ষের সব দিক পোস্টমর্টেম করেন। সব তথ্য তাঁর নোটবুকে তোলা থাকে। মোহনবাগান ধারে ও ভারে এগিয়ে থাকলেও, বিপক্ষের বেশ কিছু দুর্বলতা আছে। সেগুলো আমাদের কাছে তুলে ধরে পারফর্ম করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। ছেলেরা ঠিকঠাক ভাবে নিজেদের ভূমিকা পালন করার জন্য আমাদের থেকে অনেক বেশি দামী ও শক্তিশালী মোহনবাগানকে হারাতে পারলাম।
[আরও পড়ুন: Nandhakumar Sekhar: প্রথম গোল করেছিলেন ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে, সেই নন্দকুমারের পায়েই লাল-হলুদের শাপমুক্তি]
প্রশ্ন: কার্লেস কুয়াদ্রাত ও আপনার জুটি কিন্তু প্রথম ডার্বিতেই হিট। কী বলেন?
খাবরা: ইস্টবেঙ্গলে আমরা প্রথমবার একসঙ্গে থাকলেও, ওঁর কোচিংয়ে বেঙ্গালুরু এফসি-তে পাঁচ বছর খেলেছিলাম। ফলে কার্লেসের সঙ্গে আমার বোঝাপড়া কোন পর্যায়ের সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আশাকরি আমাদের কম্বিনেশন চলতি মরশুমে ইস্টবেঙ্গলকে অনেক সাফল্য দেবে।
প্রশ্ন: লিস্টন কোলাসোকে কীভাবে বোতলবন্দি করলেন?
খাবরা: একজন সিনিয়র ফুটবলার বিশেষ করে অধিনায়ক হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। মনে রাখবেন অতীতেও একাধিক ডার্বিতে আমি পারফর্ম করেছি। সেই সুন্দর স্মৃতি মনে রেখে নিজেকে উদ্বুদ্ধ করেছিলাম। তাছাড়া আমি বরাবরই ডার্বিতে ভাল খেলেছি। বিপক্ষে ওডাফা, সনি নর্দি, কাটসুমি, ড্যারেল ডাফি থেকে শুরু করে এবারের মোহনবাগান দল। আমি সবসময় নিজেকে তুলে ধরতে চেয়েছি। নিজের দলের জন্য পারফর্ম করতে পেরে ভাল লাগছে।
প্রশ্ন: অনেকেই আপনাকে ‘বুড়ো’ তকমা দিয়েছিলেন। নিন্দুকদের উদ্দেশে কিছু বলবেন?
খাবরা: দেখুন পেশাদার ফুটবলার হিসেবে একাধিক ক্লাবে খেললেও, ইস্টবেঙ্গলের প্রতি আলাদা আবেগ আছে। আর সেই তাগিদেই আবার কলকাতায় ফিরেছি। বয়স একটা ফ্যাক্টর। তাই অনেকে কটাক্ষ করতেই পারেন। তবে যারা আমাকে কটাক্ষ করছেন, তাঁরা জানেন না যে ৩৬ বছর বয়সেও তরুণদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খেলার জন্য নিজের ফিটনেস নিয়ে কতটা পরিশ্রম করি। নিন্দুকদের কটাক্ষে কান না দিয়ে প্রতিদিন নিজেকে আরও ভাল ফুটবলার হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। এটাই আমার একমাত্র লক্ষ্য।
প্রশ্ন: এই ডার্বি জয়ের ইস্টবেঙ্গল ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে হয়?
খাবরা: প্লিজ এত তাড়াতাড়ি আমাদের আকাশে তুলে দেবেন না। পরের ম্যাচগুলোতে ফলাফল ভাল না হলেই, গালাগালি দেওয়া শুরু হবে। এটাও কিন্তু কলকাতার ফুটবল কালচার। তাই মাথাঠাণ্ডা রেখে আমরা কাজ করতে চাই। বাকিটা সময় বলবে। আগামী লক্ষ্য পাঞ্জাবকে হারিয়ে ডুরান্ড কাপের নক-আউটে কোয়ালিফাই করা। সেটা করতে পারলেই যথেষ্ট।