মোহনবাগান (Mohun Bagan) তখন সবেমাত্র প্র্যাকটিস শেষ করেছে। অনুশীলনে কখনও কখনও কোচ আন্তোনিও লোপেজ হাবাসকে (Antonio Lopez Habas) হাততালি দিতে দেখা যাচ্ছিল। সহজেই আন্দাজ করা যাচ্ছিল হাবাস দিলখুশ মেজাজেই রয়েছেন। এমন অবস্থাতেই সাক্ষাৎকার দিতে এগিয়ে এলেন তিনি। হাবাসকে জানানো হল যে এই ৬৭ বছর বয়সেও তাঁকে আগের মতোই ফিট দেখাচ্ছে। শুনে হাবাসের মুখ আনন্দে উদ্ভাসিত।
“ফিল ইট, ফিল ইট” বলতে বলতে তিনি আমার হাত নিয়ে নিজের পেটের উপরে রাখলেন। ছুঁয়ে বুঝলাম, পেটের পেশিগুলো রীতিমতো টানটান। এমন সময়ে দিমিত্রি পেত্রাতোসও (Dimitrios Petratos) আমাদের কাছে এগিয়ে এলেন। জিজ্ঞেস করলেন, আমরা সাক্ষাৎকারের জন্য তৈরি কি না। জানালাম তৈরি। হাবাস ও তাঁর সাক্ষাৎকার নেব শুনে দিমিকে হঠাৎই সাবধানী বলেই মনে হল। যতই হোক, তাঁর হেড কোচ যে তাঁর সামনে বসে! দিমিকে বুঝিয়ে বললাম, শিক্ষকের সামনে তাঁর সেরা ছাত্র যখন বসে, তখন বিশেষ এক মুহূর্ত তৈরি হয়। আমরা সেই মুহূর্তটিকেই ধরে রাখতে চাইছি। হাবাসের হাতে পড়ে এই দল এখন সম্পূর্ণ চাঙ্গা। এই কথোপকথন তারই প্রমাণ। দিলদরিয়া মেজাজে কথা বললেন গুরু এবং শিষ্য-আন্তোনিও হাবাস ও দিমিত্রি পেত্রাতোস। শুনলেন বোরিয়া মজুমদার।
মোহনবাগানের রিমোট কন্ট্রোল যখন আপনার হাতে উঠল, তখন টানা তিনটি ম্যাচ হেরে বসে রয়েছে দলটা। দলের মনোবল তলানিতে, ভাঙাচোরা অবস্থা বলতে যা বোঝায় তাই। চলতি মরশুমে প্রথমবার কোচ হিসেবে ডার্বিতেই আপনার আত্মপ্রকাশ ঘটল। ম্যাচের ৮৩ মিনিট পর্যন্ত পিছিয়ে ছিলেন ১-২ গোলে। তার পরে ম্যাচের ছবিটাই আপনি বদলে দিলেন?
হাবাস-না, না শুধু আমি নই। সম্মিলিত প্রয়াসেই এসেছে সাফল্য। পেশাদার কোচ হিসেবে ছেলেদের কাছ থেকে সেরাটা বের করে নেওয়াই আমার প্রধান কাজ। আত্মবিশ্বাসে ভরপুর আমার দল। কিন্তু আমি যখন দলের দায়িত্ব গ্রহণ করি, তখন এই ব্যাপারটাই তো ছিল না। গোড়ায় আমার কাজ ছিল, প্রতিটি ছেলের মধ্যে আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা। দলের ভিতরে সবকিছুই ছিল কিন্তু কিছুই ঠিকঠাক হচ্ছিল না। অনুভব করছিলাম, ছেলেদের মধ্যে একটা অস্বস্তি রয়ে গিয়েছে। যা ভালো বার্তা দিচ্ছে না। নিজেদের ক্ষমতার উপরে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনাই আমার প্রথম কাজ ছিল। ছেলেদের স্বস্তিতে রেখে, যে কাজে ওরা দক্ষ, তার জন্য উৎসাহ জোগানোই আমার কাজ ছিল। মন শক্ত রেখে ছেলেদের পাশে দাঁড়ানোই দরকার ছিল। এটাই আমি করে গিয়েছি।
[আরও পড়ুন: বেন স্টোকসদের বিরুদ্ধে নামার আগে একাধিক রেকর্ড গড়ার অপেক্ষায় অশ্বিন-জয়সওয়াল]
ডার্বিতে মোহনবাগান পিছিয়েছিল, তখন কি চাপ অনুভব করতে শুরু করে দিয়েছিলেন? খেলা চলাকালীন কি মনে হয়েছিল, ভুল সময়ে আমি দায়িত্ব নিয়েছি দলের?
হাবাস-কখনওই না। একবারের জন্যও মনে হয়নি। আমি একজন পেশাদার কোচ। দুবার আইএসএল খেতাব জিতেছি। একবার ফাইনালে পৌঁছেছি, একবার সেমিফাইনালে। সুযোগ সময়েই আসে। আমি সেই সুযোগ গ্রহণ করেছি বলতে পারেন। যে কোনও ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে ভয় আমি পাই না। ফলে এক মুহূর্তের জন্যও আমার মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব কাজ করেনি। নেতিবাচক মানসিকতাও মনকে গ্রাস করেনি।
দিমি, আপনি এখন মোহনবাগান সমর্থকদের নতুন হার্টথ্রব। সমর্থকদের হাতে হাতে এখন আপনার কাটআউট, ছবি। আপনাকে নিয়ে বীরপুজো চলছে। এই ভালোবাসা
পাওয়ার পরে আপনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইছি।
দিমি-নিজের ক্লাব, অনুরাগী, সমর্থকদের জন্য ভালো কিছু করতে পারা নিঃসন্দেহে একটি দারুণ অনুভূতি। পেশাদার খেলোয়াড় হিসেবে এটা আমাদের কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। কিন্তু তাতেই আমাদের সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। শেষ পর্যন্ত যেটা গুরুত্বপূর্ণ, তা হল, ম্যাচটা জেতা। গোলের প্রসঙ্গ যখন আসে তখন দেখা যায়, ঠিক জায়গায় ঠিক সময়ে ঘটনাচক্রে আমিই ছিলাম। কিন্তু খেলাটা তো কেবলমাত্র একজনের ওপর নির্ভর করে না। একটা গোল একটা সামগ্রিক প্রক্রিয়া, যেখানে প্রত্যেক খেলোয়াড় নিজের-নিজের দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছে এবং ঘটনাচক্রে আমার পা থেকেই গোলটা এসেছে। যে কোনও টিম গেমে এই ভাবেই গোটা বিষয়টা চালিত হয়।
যদি একটা স্পেশাল গোল আপনাকে বাছতে বলি, তাহলে কোন আপনি কোন গোলটার কথা বলবেন। যদিও সব ফুটবলারের কাছে সবকটি গোলই স্পেশাল। কিন্তু এমন তো একটা গোল হয় যা হৃদয়ে চিরকাল দাগ কেটে যায়। সেটা কোন গোল?
দিমি- আপনি ঠিকই বলেছেন সব গোলই স্পেশাল। প্রতিটি গোলই কঠিন পরিশ্রমের ফসল। কিন্তু যদি একটাই গোল বাছতে বলেন, তাহলে ডুরান্ড কাপ ফাইনালে ইস্টবেঙ্গলের
বিরুদ্ধে ডার্বি ম্যাচটার কথাই আমি বলবো। ওই গোলেই আমরা চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলাম। সেইকারণেই ওই গোলটাকে আমি স্পেশাল বলব।
কোচ, দিমি বললেন ডার্বি ম্যাচের কথা। ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচের অনুভূতি আপনার কাছে কীরকম? অন্য আর পাঁচটা ম্যাচের থেকে এই ম্যাচটা আলাদা কেন?
হাবাস-তীব্রতাটাই অন্যরকমের। নিঃসন্দেহে বড় ম্যাচ। এর পরিবেশ-আবহাওয়া সম্পূর্ণ অন্যধরনের। প্রচুর সমর্থক মাঠে আসেন। ১০ মার্চও একই ভাবে সমর্থকদের মাঠ ভরানোর আবেদন জানাচ্ছি। মাঠে আসুন, আমাদের সমর্থন করুন। সাপোর্ট, সাপোর্ট অ্যান্ড সাপোর্ট। আপনাদের হৃদয় উজাড় করা সমর্থনই আমাদের থেকে সেরাটা বের করে নেবে। ডার্বি ম্যাচ সব অর্থেই স্পেশাল একটা লড়াই। ভারতীয় ফুটবলকে সমৃদ্ধ করে ডার্বি ম্যাচ। খেলাটারও মানোন্নয়ন হয়।
দিমি আপনি কী বলবেন? এটা অন্য আরেকটা ম্যাচ, প্লিজ এভাবে বলবেন না।
দিমি-জাস্ট অ্যানাদার ম্যাচ (হেসে)। দেখুন আপনি ম্যাচটার কথাই যদি ধরেন, তাহলে বলবো এটা আলদা একটা ম্যাচ ছাড়া আর কিছু নয়। গ্যালারিতে বিশাল সংখ্যক দর্শক উপস্থিত থাকেন। এই সংখ্যটাই তো উল্লেখযোগ্য। চমকে দেওয়ার মতো। ম্যাচ ঘিরে উন্মাদনা, পরিবেশ-পরিস্থিতিও ব্যতিক্রমী। সেই করাণেই এই ম্যাচটা নিজের দলের জন্যই বেশি করে জিততে চাই। এমনকী শেষ ডার্বিটাও আমরা জিততেই চেয়েছিলাম। জিতবো এই উদ্দেশ্য, লক্ষ্য নিয়েই আমরা মাঠে নেমেছিলাম। দিনের শেষে অবশ্য ড্র করে মাঠ ছাড়তে হয়। আমি জানি সমর্থকদের কাছে এই ম্যাচের গুরুত্ব কীরকম। আমাদের চালিকাশক্তি সমর্থকরাই। ওদের জন্যই আমরা জিততে চাই, ভালো করতে চাই।
কোচ, সমর্থকরা আপনাকে ভালোবাসে। সমর্থকদের নিয়ে আপনার অনুভূতি জানতে চাইছি।
হাবাস-একটা ফুটবল ক্লাবের কাছে তার অনুরাগী-সমর্থকরাই সবকিছু। তাঁরাই তো ক্লাবটাকে তার যথার্থ পরিচিতি প্রদান করেন। তাঁদের সমর্থন আমাদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি শুধু এটুকুই বলতে চাই যে, আমাদের প্রতি তাঁদের ভালোবাসা এবং সমর্থনকে আমি নতমস্তকে অভিবাদন জানাই। আশা রাখি, ভবিষ্যতেও তাঁরা এইভাবেই আমাদের পাশে থাকবেন।
দিমি আপনি বলুন?
দিমি-সমর্থকরাই আমাদের দ্বাদশ ব্যক্তি। ওদের জন্যই মাঠে আমরা নিজেদের সেরাটা উজাড় করে দিই আরও অতিরিক্ত কিছু দিয়ে ফেলি। ওদের ভালোবাসা এবং স্নেহ অনেকটাই পার্থক্য গড়ে দেয়। একজন ফুটবলার উৎকর্ষতার দিকে এগিয়ে চলে। আমরাও এর ব্যতিক্রম নই। স্ট্যান্ডে, গ্যালারিতে সমর্থকদের দেখলে আমাদের সেরাটাই বেরিয়ে
আসে।
প্লে অফের দৌড়ে ঢুকে পড়েছেন। শীর্ষে পৌঁছতে পারবেন? কী মনে হচ্ছে আপনার?
হাবাস-এটাই তো আমাদের লক্ষ্য, আমাদের উদ্দেশ্য। ম্যানেজার হিসেবে এই কারণেই তো আমি মোহনবাগানের দায়িত্ব নিয়েছি। আমি নিজের সেরাটা দিয়ে ওই শৃঙ্গে পৌঁছনো নিশ্চিত করতে চাই। এত কথা বলার পরেও একটাই কথা বলবো, একটা করে ম্যাচ নিয়ে ভাবতে চাই। বহু দূরের কথা এখনই ভাবতে চাই না।
দিমি?
দিমি–আমরা ভালো খেলছি। এই ভালো খেলাটাই আমাদের ধরে রাখতে হবে। এও জানি ভালো খেলে যেতে পারলেই ফলাফল আমাদের অনুকূলেই যাবে।
সবশেষে, দিমি, আপনার কাছে জানতে চাইব যে, আপনাদের সবাইকেই তো যথেষ্ট কঠিন প্রশিক্ষণ এবং সুশৃঙ্খল জীবনযাপনের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। সেই শৃঙ্খলা ভেঙে কখনও কি কোনও অনিয়ম করেছেন আপনি? কোচ কি অন্তত একটি ‘চিট মিল’-এর অনুমতি দিয়েছেন? সত্যি করে বলুন তো, কলকাতার বিখ্যাত মিষ্টি কি একবারের জন্যও চেখে দেখেননি এখনও?
দিমি- (দুষ্টু হাসি নিয়ে হাবাসের দিকে তাকিয়ে) আমি কোনও মন্তব্য করব না!!
আর, কোচ, আপনি? ( দিমি ঝাঁপিয়ে প’ড়ে বললেন, কোচের ক্ষেত্রে সাতখুন মাফ্!)
হাবাস- আমিও বলব, নো কমেন্টস(হাসি)।