কৃশানু মজুমদার: ”পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনালের আগের দিন সুরজিতের জ্বর জ্বর ভাব। প্রদীপদাকে আমি বললাম, আপনার সঙ্গে ওকে নিয়ে যান। আমার মনে হচ্ছে বড় ম্যাচের টেনশনেই সুরজিতের এমন হচ্ছে। প্রদীপদা ম্যাচের আগে ওকে খাইয়ে দাইয়ে সুস্থ করে মাঠে নামালেন। প্রথম গোলটা করেছিল সুরজিৎই।”
এক নিশ্বাসে ৪৭ বছর আগের স্মৃতি গড়গড় করে বলে চলছিলেন সমরেশ ‘পিন্টু’ চৌধুরী। তার কিছুক্ষণ আগেই যে চলে গিয়েছেন কলকাতা ময়দানের অন্যতম শিল্পী উইংগার সুরজিৎ সেনগুপ্ত (Surajit Sengupta)। করোনা আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভরতি হয়েছিলেন। অতীতে বহু ডিফেন্ডারের কড়া ট্যাকল এড়িয়েছিলেন। এবার আর পারলেন না তিনি। বৃহস্পতিবার দুপুরে থেমে গেল সব লড়াই। তাঁর প্রয়াণে শোকস্তব্ধ ময়দান, একসময়ের সতীর্থ। শোকাতুর রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও (Mamata Banerjee)। টুইট করেন তিনি, ”বর্ষীয়ান ফুটবলার সুরজিৎ সেনগুপ্তকে আজ হারালাম। ফুটবলপ্রেমীদের হার্টথ্রব ছিলেন। সুভদ্র এবং অসামান্য এক জাতীয় ক্রীড়াবিদ তিনি। আমাদের হৃদয়ে চিরকাল থেকে যাবেন সুরজিৎ সেনগুপ্ত।”
[আরও পড়ুন: দৌড় থেমে গেল সত্তরে, প্রয়াত প্রাক্তন ফুটবলার সুরজিৎ সেনগুপ্ত]
প্রথমে সুভাষ ভৌমিক। আজ সুরজিৎ সেনগুপ্ত। পঁচাত্তরের শিল্ড ফাইনালের দুই সদস্যই প্রয়াত। সুভাষ ভৌমিক সম্পর্কে কিংবদন্তি শোনা যায়, পঁচাত্তরের সেই ডার্বিতে তিনি ডেকে ডেকে গোল করেছিলেন। আর সুরজিৎ সেনগুপ্ত অতীতে স্মৃতিচারণ করে একবার বলেছিলেন, সেই ম্যাচে তিনি মোহনবাগানের স্বাস্থ্যবান ডিফেন্ডার বিজয় দিকপতির ভয়ে একসময়ে পালিয়ে পালিয়ে যাচ্ছিলেন। কলকাতা ময়দানের পরিচিত পিন্টুদা হাসতে হাসতে বলছিলেন,”বিজয় দিকপতি কড়া ট্যাকল করত। সেই কারণেই ওকে অনেকেই হয়তো একটু ভয় পেত। তবে ওই ম্যাচে সুরজিৎ খুবই ভাল খেলেছিল। ওর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল শ্যামল (ঘোষ)। আমাকে ডেকে শ্যামল বলেছিল. ও তো বলছে জ্বর জ্বর হয়েছে, খেলবে না। আমিই ধমক দিয়েছিলাম সুরজিৎকে।” আবেগের বাষ্প গলায় জড়িয়ে পিন্টু চৌধুরী বলছিলেন, ”খুব খারাপ সব খবর পাচ্ছি। এই সংবাদটা আমার কাছে অত্যন্ত বেদনায়দায়ক।”
‘৭৯ সালের আইএফএ শিল্ড সেমিফাইনালে সুরজিতের অসাধারণ গোল নিয়েও চর্চা জারি ময়দানে। চায়ের পেয়ালায় তুফান ওঠে সেই অবিস্মরণীয় কীর্তি নিয়ে। সেবার শিল্ড খেলতে এসেছিল কোরিয়ার একটি দল। কোরিয়া একাদশের বিরুদ্ধে কঠিন এক কোণ থেকে গোল করেছিলেন শিল্পী উইংগার। তখন তিনি ইস্টবেঙ্গলের খেলোয়াড়। কোরিয়া একাদশের বিরুদ্ধে সেই ম্যাচের আগে খিদিরপুরের কোচ অচ্যুৎ ব্যানার্জির কাছে প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন তিনি। কোনও কারণে ম্যাচের আগের দিন অনুশীলন বিঘ্নিত হয়েছিল ইস্টবেঙ্গলে। সেই কারণে সুরজিৎ সেনগুপ্ত-সহ কয়েকজন অনুশীলন করেছিলেন অচ্যুৎ ব্যানার্জির কাছে। মাঠের দুরূহ কোণ থেকে সুরজিৎ সেনগুপ্তকে শট প্র্যাকটিস করাচ্ছিলেন তিনি।
পরের দিন ম্যাচে লাল-হলুদ জার্সিতে ওরকমই কঠিন এক কোণ থেকে গোল করেছিলেন সুরজিৎ। সেই সময়ে ইস্টবেঙ্গলে তাঁর সতীর্থ ছিলেন সাবির আলি। তিনি নিজেও ভেবেছিলেন, উইং থেকে তাঁর উদ্দেশে বল ভাসিয়ে দেবেন সুরজিৎ। হেড করার জন্য তৈরিও ছিলেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে সুরজিতের বাঁক খাওয়ানো শট কোরিয়া একাদশের জালে জড়িয়ে গিয়েছিল।
সাবির আলি এদিন বলছিলেন, ”ওই গোলটা এখনও আমার চোখে ভাসে। সুরজিতের সঙ্গে খেলার অনেক মুহূর্ত মনে পড়ছে। ১৯৭৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরশাহী-বাহরিন সফরে আমরা গিয়েছিলাম। বাহরিনের বিরুদ্ধে আমরা হেরে গিয়েছিলাম। পরের দিন বিশ্রাম ছিল। তার পরের দিন আবার খেলা ছিল। সেই ম্যাচে আমরা ২-০ গোলে হারিয়েছিলাম বাহরিনকে। আমি গোল করেছিলাম। খেলার শেষে অবাক হয়ে সুরজিৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করছিল, তুই কী করে অতটা লাফিয়ে গোল করলি রে?”
খেলার জগতের মতো সঙ্গীত জগতেও ইন্দ্রপতন ঘটেছে। সুরলোকে সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর। নস্ট্যালজিক সাবির আলি বলছিলেন, ”বম্বের অ্যালবার্ট হলে দিলীপ কুমার একবার লতা মঙ্গেশকর সম্পর্কে বলছিলেন। একটা জায়গায় উনি উর্দুতে বলেছিলেন, লতাজি ঈশ্বরদত্ত প্রতিভা। শিল্পীর কোনও দেশ হয় না। আমি সুরজিৎকে জিজ্ঞাসা করি, কী রে কিছু বুঝতে পারলি? সুরজিৎ যে বুঝতে পারেনি তা বুঝেছিলাম। আমি বলেছিলাম, দিলীপ কুমার বলতে চেয়েছেন, লতাজির কণ্ঠ শিশুর মতো। দেশ-কালের সীমারেখার অনেক ঊর্ধ্বে। সূর্যের রশ্মি, আকাশ যেমন কোনও দেশ, গ্রামের সীমানা মানে না, লতা মঙ্গেশকরের কণ্ঠস্বরও তেমনই। আজ মনটা খুবই বিষন্ন। একসময়ের সতীর্থরা সব চলে যাচ্ছে। একা হয়ে পড়ছি।”
সাবিরের মতোই মনোকষ্টে দেশের আরেক ফুটবল দিকপাল বিদেশ বসু। ডার্বির টেনশনের মধ্যেও যে সময় বিশেষে সুরজিৎ সেনগুপ্ত রসিকতা করতেন, সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করেন প্রাক্তন উইংগার। বিদেশ বলছিলেন, ”এরকম শিল্পী খেলোয়াড় খুব একটা দেখা যায় না। যাঁরা ওঁর খেলা দেখেছেন, তাঁরা কোনওদিন ভুলতে পারবেন না। সুরজিৎদার সঙ্গে অজস্র স্মৃতি রয়েছে। বড় ম্যাচে আমরা বিপরীত দলে। সুরজিৎদা রাইট আউট আর আমি লেফট আউট। মাঠে আমাকে মজা করে বলতেন, কী রে, আমার সঙ্গে কথা বলবি না। তাকাবি না। প্রদীপদা নিশ্চয় বলে দিয়েছেন, একটু নীচে নেমে খেলতে হবে তোকে। কারণ সুরজিৎ আছে উলটো দিকে।”
সবার প্রিয়, ভালবাসার সুরজিৎ সেনগুপ্ত একবার বলেছিলেন, ”উইংগারের কাজ খুব কঠিন। বলে স্ট্রোক বেশি হলে মাঠের বাইরে চলে যেতে হয়।” গোটা কেরিয়ারে সবুজ ঘাসের মাঠে তেমন পরিস্থিতিতে অবশ্য পড়তে হয়নি তাঁকে। কিন্তু জীবনখেলার অমোঘ নিয়ম ময়দানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ উইংগারকেও ছিটকে দিল মাঠের বাইরে। পার্থিব জগৎ থেকে বিদায় নিলেও সবুজ ঘাসের গালিচায় যে রূপকথা লিখেছিলেন সুরজিৎ তা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। সুরজিৎরা যে শেষপর্যন্ত অপরাজিতই থেকে যান। থেকে যান সবার হৃদয়ে।