সব্যসাচী বাগচী: পাকিস্তানের (Pakistan) বিরুদ্ধে তাঁর মাঠে নামার কথাই ছিল না! কেএল রাহুল (KL Rahul) ফিট থাকলে তিনিই চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দলের বিরুদ্ধে এশিয়া কাপের (Asia Cup 2023) মঞ্চে নামতেন। কিন্তু কেএল রাহুল আনফিট ঘোষণা হতেই ঈশান কিষাণের (Ishan Kishan) ভাগ্য খুলে গেল। শাহিন শাহ আফ্রিদি (Saheen Shah Afridi)-হ্যারিস রাউফদের (Harsi Rauf) বিরুদ্ধে বিরাট কোহলি (Virat Kohli)-রোহিত শর্মারা (Rohit Sharma) ব্যর্থ হলেও, টিম ইন্ডিয়ার (Team India) তরুণ তারকা বাইশ গজের যুদ্ধে নিজের জাত চেনালেন। ঈশানের ৮১ বলে ৮২ রানের লড়াকু ইনিংসে মজেছেন তাঁর ছোটবেলার কোচ উত্তম মজুমদার (Uttam Majumdar)। ছাত্র শতরান মাঠে ফেলে এলেও, তাঁর ‘গুরু’ মনে করেন ঈশান স্বার্থপর নন।
৬৬ রানে ৪ উইকেট হারিয়ে টিম ইন্ডিয়া তখন প্রবল সঙ্কটে। ঠিক এমন সময় হার্দিক পাণ্ডিয়াকে (Hardik Pandya) নিয়ে শুরু হল লড়াই। চাপের মুখে চুপসে না গিয়ে দু’জন পঞ্চম উইকেটে যোগ করলেন মহামূল্যবান ১৩৮ রান। ভারতীয় দল তখন ছন্দে ফিরেছে, ঠিক এমন সময় হ্যারিস রাউফের একটি গুড লেন্থ স্পট থেকে ওঠা ডেলিভারিকে পুল করতে গেলে, বাবর আজমের হাতে ধরা পড়েন ঈশান। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শতরান হাতছাড়া করার হতাশা তাঁর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে স্পষ্ট ছিল।
[আরও পড়ুন: শাহিনের আগুনে বোলিং দেখে বিরাটের চক্ষু ছানাবড়া! ভাইরাল ভিডিও]
তবে ঈশান শতরান ফেলে এলেও হতাশ নন উত্তম মজুমদার। বৃষ্টির দাপটে যখন ‘মাদার অফ অল ব্যাটল’ বন্ধ, ঠিক সেই সময় সংবাদ প্রতিদিন.ইন-কে উত্তম বলেন, “ঈশান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রথম শতরান করতে না পারার জন্য খারাপ লাগছে। তবে এমন শট খেলে আউট হলেও ওর প্রতি ক্ষুব্ধ নই। বরং আমরা সবাই গর্বিত। পাকিস্তানের বোলিং অ্যাটাক, বিশেষ করে ওদের পেস বোলিং এই মুহূর্তে বিশ্বসেরা। এমন বোলিং লাইন আপের বিরুদ্ধে চাপের মুখে পারফরম্যান্স করতে হলে দম লাগে। আমার ছাত্র সেটা করে দেখিয়েছে। ওর জন্য গর্বিত।”
ইনিংসের শুরুতে ধরে খেলছিলেন ঈশান। তাড়াহুড়ো করেননি। অহেতুক ঝুঁকি নেননি। সঠিক বলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। দৌড়ে রান নিচ্ছিলেন। তবে খারাপ বল পেলে রেয়াত করছিলেন না। তার ফলে ঝুঁকি না নিয়েও ১০০-র স্ট্রাইক রেটে রান করছিলেন তিনি। এরপর যত সময় এগোল তত হাত খুলে খেলা শুরু করেন ঈশান। নিজের অর্ধশতরান পূরণ করেন। এশিয়া কাপ অভিষেকেই দায়িত্ব নিয়ে খেললেন এই বাঁহাতি ব্যাটার। তবে একটা সময় পড়ে হ্যামস্ট্রিংয়ে টান অনুভব করেন ঈশান। ফলে দৌড়তে পারছিলেন না। বড় রানের উপরেই নির্ভর করছিলেন। শেষ পর্যন্ত শতরান করতে পারেননি ঈশান। ৮১ বলে ৮২ রান করে হ্যারিসের বলে পুল মারতে গিয়ে আউট হয়ে যান ঈশান।
[আরও পড়ুন: পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কেন বাদ শামি? ক্ষুব্ধ সমর্থকদের প্রশ্নে বিদ্ধ রোহিতরা]
তাঁর কোচ ফের জুড়ে দিলেন, “কয়েক দিন আগে ঈশানের সঙ্গে কথা হচ্ছিল। এই সময় শ্রীলঙ্কায় খুব গরম। এমন আবহাওয়াতে হ্যামস্ট্রিং-এ চোট পাওয়া খুব স্বাভাবিক। সেইজন্য ঈশান দ্রুত রান তুলতে চেয়েছিল। সেটা মনে রাখা দরকার। বাইরে থেকে অনেক মন্তব্য করে দেওয়া জায়। কিন্তু মনে রাখতে হবে ঈশান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে খেলছিল। এমন একটা দলের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে ব্যাট করা কিন্তু মুখের কথা নয়। তাই শতরান না করলেও এই ইনিংস কিন্তু ওর দ্বিশতরানের থেকেও মূল্যবান। এই ইনিংসের জন্য ওর উপর টিম ম্যানেজমেন্টের ভরসা বেড়ে গেল। ও পরিবর্ত হিসাবে নয়, নিজের যোগ্যতায় প্রথম একাদশে সুযোগ পেয়েছে প্রমাণ করে দিল।”
একটা সময় উত্তম ময়দানের টাউন, ইয়ংবেঙ্গলের মতো ক্লাবে দাপিয়ে খেলেছেন। মহেন্দ্র সিং ধোনির সঙ্গে বিহার রঞ্জি দলেও ছিলেন। তবে পরিবারের চাপে খেলা চালিয়ে নিয়ে যেতে পারেননি। এখন আর তিনি সেটা নিয়ে আক্ষেপ করেন না। কারণ তিনি যে ঈশানের মত এক প্রতিভাকে তুলে ধরেছেন। বললেন, “আমি তখন পাটনাতে একটা অ্যাকাডেমির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। একদিন ওর বাবা প্রণব পাণ্ডে ঈশানকে নিয়ে এল। সাধারণত ৫ বছরের ছেলেদের আমরা বেশি চাপ দিতাম না। কিন্তু ঈশান ছিল অন্য রকম। সেটা দুই দিন পরেই বুঝতে পারি। বয়সে অনেক বড় ছেলেদের বলকে অনায়াসে সামলাতে পারত। তাই রোজ অনুশীলনের শেষে ওকে ২০০ থেকে ৩০০ বল নক ডাউন করাতাম। সেই ঈশান পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুরন্ত ইনিংস খেলে দিল। ভাবলেই মন ভাল হয়ে যায়।”
মাত্র ১৫ বছরে ধোনির রাজ্য দলের হয়ে অভিষেক। এরপর রাহুল দ্রাবিড়ের প্রশিক্ষণে ২০১৬ সালের বিশ্বকাপ অভিযানে অনূর্ধ্ব-১৯ ভারতীয় দলের অধিনায়ক হয়ে যাওয়া। ধোনি ও ঈশান, রাঁচির দুই কৃতীর মধ্যে বেশ মিল। ২০০৫ সালের কথা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ধোনিকে তিন নম্বরে নামিয়ে দেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। বাকিটা ইতিহাস। ১৮ বছর পর ঈশান সেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করলেন। দুই মায়ের মধ্যেও রয়েছে একটি মিল। ধোনির মা দেবিকা দেবী ছেলের খেলা দেখেন না। সেই সময় ঠাকুরের কাছে প্রার্থনা করেন। ঈশানের মা সুচিত্রা সিং সেই একই সংস্কারে বিশ্বাসী।
এই মিলগুলোকে সঙ্গে নিয়েই ঈশান বাইশ গজের যুদ্ধে আরও অনেক বিস্ফোরক ইনিংস খেলার অঙ্গীকার নিয়েছেন।