বোরিয়া মজুমদার: মানকাডিং (Mankading)। ক্রিকেটের ২২ গজে বিতর্কিত এই শব্দটাকে ঘিরে প্রচুর কথা হয়েছে। হয়ে চলেছেও। খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। অনেক ঝড়ঝাপ্টা পেরিয়ে আইসিসিও মান্যতা দিয়েছে ‘মানকাডিং’কে, রানআউট হিসেবে। সেই ঘোষণার আগে লর্ডসে দীপ্তি শর্মার শার্লট ডিনকে ‘মানকাডিং’ করা নিয়ে কম বিতর্ক হয়নি। যেমনটা অতীতে হয়েছিল অশ্বিনকে ঘিরে। আরও আগে ‘মানকাডিং’য়ের প্রণেতা ভিনু মানকড়কে ঘিরে।
শোনা যায়, ১৯৪৭-৪৮-এ সিডনিতে বিল ব্রাউনকে (Bill Brown) যখন মানকাডিং করেন ভিনু মানকড় (Vinoo Mankad ) তখন শোরগোল পড়ে গিয়েছিল ক্রিকেট দুনিয়ায়। সঙ্গে সমালোচনার ঝড় বইতে শুরু করেছিল মানকড় বিরুদ্ধে। সেই পরিস্থিতিতে মানকড়ের স্বপক্ষে দাঁড়াতে এগিয়ে এসেছিলেন একজনই। তিনি, ডব্লিউ জি গ্রেস, ক্রিকেটের জনক।
[আরও পড়ুন: আজ ঘোড়ার গাড়ি চেপে মহামেডান মাঠে ঢুকবেন কাফু]
প্রবল বিরোধী মনোভাবের উল্টো স্রোতে দাঁড়িয়েই মানকড়ের সমর্থনে গ্রেস বলেছিলেন, বিল ব্রাউনকে রান আউট করে কোনও ভুল করেননি মানকড়। সেই সাক্ষাৎকারের পেপার-কাটিং আজও সংক্ষিত মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের লাইব্রেরিতে। সেই অমূল্য সংগ্রহশালা যত্ন করে ধরে রেখেছেন লাইব্রেরিয়ান ডেভিড স্টুডহ্যাম। ‘মানকাডিং’ প্রসঙ্গ উঠতেই তিনি বলেন, ‘‘এটা ক্রিকেট ইতিহাসের একটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। মানকাডিং নিয়ে পরবর্তী সময়ে অনেক চর্চা হয়েছে। অনেক আলোচনা, সমালোচনা হয়েছে ভিনু মানকড়কে নিয়েও। সেই ১৯৪৭-৪৮-এর পেপার কাটিং, স্ক্রাপবুক কালেকশন রয়েছে আমাদের কাছে। অধিকাংশই সংগ্রহ করেছেন স্ট্যান রিচার্ডস।’’ শুধু মানকাডিং-স্বীকৃতির প্রামাণ্য নথি নয়, ১৯৩২, ১৯৩৬ এমনকি ১৯৪৬-এ ভারতের ইংল্যান্ড সফরের অনেক অজানা গুরুত্বপূর্ণ নথি সংরক্ষিত এমসিজি লাইব্রেরিতে।
স্ক্রাপবুকের কথায় আসি। সেইসময়ে অস্ট্রেলিয়ায় ভারতীয় দলের খেলতে আসা থেকে ম্যাচ রিপোর্ট প্রতিটির পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ, পেপার কাটিং রয়েছে তাতে। মজার ব্যাপার হল, সেইসময় প্রতিটি টেস্ট ম্যাচে অন্তত পাঁচ-ছয় কভারেজ থাকত প্রতিদিন। কিন্তু বিল ব্রাউনের ‘মানকাডিং’য়ের ক্ষেত্রে সেটার বর্ণনা রয়েছে অতি সামান্য। ছোট্ট করে লেখা, ব্রাউনকে রান আউট করেছেন মানকড়। কিন্তু ব্যাপারটা তারপরে শোরগোল ফেলতেই ‘অন্যায্য আউট’ নিয়ে সমালোচনার বন্যা বয়ে যায় সংবাদপত্রগুলোয়। এবং ঠিক সেইসময়েই কোণঠাসা মানকড়ের সমর্থনে মুখ খোলেন ডব্লুউজি গ্রেস। দাবি করেন, ক্রিকেটের নিয়মের মধ্যে থেকেই ব্রাউনকে রানআউট করেছেন মানকড়। আর সেটা মোটেও ক্রিকেটীয় স্পিরিটের পরিপন্থী নয়। এমসিজি-র গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান স্টুডহ্যামের কথায় আরও স্পষ্ট, ‘‘মানকড় বিন্দুমাত্র ভুল করেননি। যা করেছেন ক্রিকেটের নিয়ম মেনে। সেটা জানার জন্য এই পেপার কাটিংগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। সেইসময় সংবাদমাধ্যমে গ্রেস ক্রিকেটীয় ব্যাখ্যা দিয়ে এই আউটের স্বপক্ষে যুক্তি সাজিয়ে দিয়েছেন।’’
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, গ্রেসের সেই ঘোষণার পরেও বিতর্কের অবসান ঘটেনি। বরং মানকাডিং আউট নিয়ে নেতিবাচক ভাবনা আরও ডালপালা মেলেছে। এরপিছনে মিডিয়া, আরও স্পষ্ট করে বললে শেতাঙ্গ মিডিয়া, যারা বরাবর ক্রিকেটীয় সমাজে নিজেদের নিয়ন্ত্রা শক্তি বলে মনে করে এসেছে, তাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি। গ্রেসের বিবৃতিতে ‘মানকাডিং’ পক্ষে যে সাপোর্ট দেখা গিয়েছিল, তা তারা মেনে নিতে পারেননি। কার্যত যুদ্ধ ঘোষণা করেই গ্রেসের বিরুদ্ধে তারা কলম ধরেন। বলাবাহুল্য, ৭৫ বছরের বেশি সময় ধরে ‘মানকাডিং’ আউটের গ্রহণযোগ্যতা, ‘জেন্টলম্যান’স গেমে’ তার মান্যতা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শেষপর্যন্ত আইসিসি ‘মানকাডিং’কে স্বীকৃতি দেওয়ায় প্রমাণিত, গ্রেস ভুল বলে যাননি।