ডগলাস ডি সিলভা: এও কী সম্ভব! বিশ্বাস করুন, আমরা ব্রাজিলিয়ানরা কেউ মেনে নিতে পারছি না। কারণ, পেলে (Pele) তো শুধু আমাদের ব্রাজিলিয়ানদের হিরো নন। সারা বিশ্বের হিরো। তাঁর শেষ যাত্রায় উপস্থিতি মাত্র দু’জন বিশ্বকাপ খেলা ফুটবলার! স্যান্টোস থেকে গাড়িতে আড়াই ঘন্টা দূরত্বে সাওপাওলোতে থাকেন কাফু, রবার্তো কার্লোসরা। তাঁরাও পেলের শেষকৃত্যে আসার সময় পেলেন না? কিংবা জিকো, রোনাল্ডো, দুঙ্গা, অথবা এবারের বিশ্বকাপে খেলা দলের ফুটবলার, কোচ কেউ না! পেলের মৃত্যুর সঙ্গে জড়িয়ে গেল ব্রাজিলের একটা কালো দিনও। যেখানে পৃথিবী দেখল, ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলার পাশাপাশি বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা পর্যন্ত উপস্থিত। পেলের শেষকৃত্যর জন্য দু’দিন ধরে স্যান্টোসে পড়ে আছেন খোদ ফিফা সভাপতি ইনফান্তিনো। আর আমাদের দেশে থাকা শয়ে শয়ে বিশ্বকাপাররা স্যান্টোসে আসার সময় পেলেন না?
ছিলেন ৭০ এর বিশ্বকাপ দলের প্রতিনিধি ক্লোডোয়াল্ডো এবং ৯৪’এর বিশ্বকাপ দলে থাকা মৌরো সিলভা। প্রাক্তন ফুটবলারদের মধ্যে ছিলেন জি রবার্তো এবং ভারতে খেলে যাওয়া এলানো। আসলে এদিন দু’জনেই উপস্থিত ছিলেন স্যান্টোসের প্রাক্তন ফুটবলার হিসেবে। পেলের সঙ্গে যাঁরা একটা সময় স্যান্টোসে খেলেছেন, তাঁদের মধ্যে যাঁরা বেঁচে আছেন, তাঁরা অবশ্য শেষে যাত্রাতেও ফুটবল সম্রাটের সঙ্গী ছিলেন। কিন্তু ব্রাজিলের বাকি বিখ্যাত ফুটবলাররা? বিশ্বাস করুন, এদিন পেলের শেষকৃত্যে প্রাক্তন ফুটবলারদের এই আচরণ দেখে সারা ব্রাজিলে ছিঃছিঃ পড়ে গিয়েছে।
ফুটবল সম্রাটের শেষকৃত্যে প্রাক্তন-বর্তমান ফুটবলাররা উপস্থিত না থাকতে পারেন, কিন্তু সাধারণ মানুষদের ভিড়ে এদিন স্যান্টোসের রাস্তায় পা ফেলাই মুশকিল। যাঁদের জন্য পেলে ফুটবল সম্রাট হয়েছেন, সেই সাধারণ মানুষের চোখের জলে বিদায় নিলেন পেলে।
[আরও পড়ুন: বইমেলায় মমতার ‘কবিতাবিতান’-এর ইংরাজি অনুবাদ, প্রকাশিত হবে রাজনৈতিক প্রবন্ধের বইও]
এই কিছুদিন আগেই কাতার বিশ্বকাপের সময় কোচ তিতে-সহ ফুটবলাররা বারবার পেলের সুস্থতা কামনায় বার্তা দিয়েছেন। আর পেলেও হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে কখনও নেমার, কখনও পুরো দলের সমর্থনে অসুস্থ অবস্থাতেও সমর্থন দিয়েছেন। কিন্তু আজ পেলের শেষকৃত্যে কোথায় তিতে? কোথায় নেমার? কোথাও ইউরোপে খেলা ফুটবলাররা? প্রাক্তন ফুটবলার নেটো, এদিন একটি চ্যানেলের ধারাভাষ্যকার হিসেবে স্যান্টোসে উপস্থিত ছিলেন। তিনি রীতিমতো চাচাছোঁলা ভাষায় তিতের দলকে সমালোচনা করে বলছিলেন, ‘ব্রাজিলের শিক্ষা, সংস্কৃতি বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। যে ফুটবল দিয়ে সারা বিশ্বে আমাদের দেশকে পরিচিত করল, সেই পেলের শেষকৃত্যে কেউ আসার সময় পেল না! নেমারসহ ইউরোপে খেলা ফুটবলাররা তো ক্লাব থেকে ছুটি নিয়ে অনায়াসে হাজির হতে পারত। পেলের শেষকৃত্যে থাকার জন্য ছুটি চাইলে ক্লাব দিত না, বিশ্বাস করি না।’
বিশ্বাস করুন, এই কথাগুলি শুধু নেটোর নয়। এই মুহূর্তে ফুটবল সম্রাটের শেষকৃত্যে স্যান্টোসে উপস্থিত হওয়া সব সাধারণ মানুষের। তবে পেলেকে শেষবারের মতো দেখার জন্য গতকাল রাত থেকে স্যান্টোস স্টেডিয়ামের বাইরে লোকে লোকারণ্য। ধরুন, পেলেকে রাখা হয়েছে যুবভারতীর মাঠে। আর তাঁকে দেখার জন্য সাধারণ মানুষের লাইন চলে গিয়েছে সেই ময়দান পর্যন্ত। আমিও সারা রাত জেগে এদিন পেলের শরীরে ফুলের মালা দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে পেরেছি। তবে শেষ যাত্রায় সবেচেয়ে আবেগঘন মুহূর্ত তৈরি হয় যখন পেলেকে নিয়ে যাওয়া হয়, তাঁর মা’র বাড়ির সামনে থেকে। অনেকক্ষণ ধরে দোতলার ব্যালকনিতে অপেক্ষা করছিলেন, তাঁর বিশ্বখ্যাত পুত্রের জন্য। বাড়ির পাশে পেলের কফিন পৌঁছলে ব্যালকনি থেকে নেমে আসেন ১০০ বছরের বৃদ্ধা। শুরুতে কেঁদে ফেলেন। তারপর প্রিয় পুত্রকে জড়িয়ে ধকে আবেগমথিত গলায় বলে ওঠেন, ‘সাবধানে যাও। শান্তিতে থাক।’
আমরাও পেলের শেষ যাত্রায় পা মিলিয়েছিলাম। সঙ্গে স্যান্টোসের একাধিক প্রাক্তন ফুটবলার সহ, বর্তমান দলের ফুটবলাররা। ছিলেন, সাওপাওলো, কোরিয়েন্থাস, ভাস্কোর জার্সি পরা প্রচুর সমর্থকও। ফুটবল সম্রাটের মা’র বাড়ির সামনে পেলের কফিন পৌঁছতেই তাঁর মা’ সবাইকে ধন্যবাদ দিতে লাগলেন, তাঁর ছেলেকে ভালভাবে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এরপর সমাধিস্থলের দিকে এগিয়ে যাওয়া। পিছনে তখন কাতারে কাতারে মানুষ। জীবিত অবস্থাতেই ফুটবল সম্রাট ইচ্ছেপ্রকাশ করেছিলেন, স্যান্টোসের এই সমাধিস্থলে তাঁকে নিয়ে আসার জন্য। ভিতরে তখন শুধুই পরিবারের লোকজন। বাইরে অসংখ্য গুণমুগ্ধ। চিরবিদায় নিলেন ফুটবল সম্রাট।