যে যেখানে সংখ্যালঘু, তাদের পক্ষে দরদি হয়ে কথা বলাই কি ‘নিরপেক্ষতা’, কিংবা বৃহৎ অর্থে ‘সেকুলারিজম’? নিজেকে রক্ষার অভিসন্ধিই কি প্রকৃত ধর্মাবস্থান? ভারতকে ‘ভূখণ্ড’ হিসাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভারতকে একটি ‘সত্তা’ হিসাবে দেখার অনুভবকে সঙ্গী করে ‘দক্ষিণপন্থা’ বলে যা আজ বাজারে খুব চলছে তা আদৌ কতটা ‘দক্ষিণ’, সেসব বিতর্কাগ্নির উদরে ঘনঘোর ফুঁ দিয়েছেন স্বপন দাশগুপ্ত। তাঁর ‘Awakening Bharat Mata: The Political Beliefs of The Indian Right’ গ্রন্থে। আটের দশক থেকে আবর্তমান রাজনীতির পটভূমিতে বিচরণ করেছেন তাঁর ভাবনা-যুক্তির রণ-পায়ে। লিখেছেন বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়।
স্বপন দাশগুপ্তর ‘Awakening Bharat Mata: The Political Beliefs of The Indian Right’ হাতে নিয়ে অনেক পুরনো একটা ঘটনার কথা মনে পড়ে গেল। সাল ১৯৭৫। ‘জরুরি অবস্থা’-র হলকা বইছে ভারতজুড়ে। সেই সময়ই কলকাতার উপকণ্ঠে অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের এক গৃহবধূ, দু’-থালা ভাত শাড়ির আঁচলে যতটা সম্ভব ঢেকে বাড়ির পিছনের একটা পরিত্যক্ত গলি দিয়ে দ্রুত পায়ে তিন-চার মিনিট দূরের এক গন্তব্যের দিকে হাঁটতে শুরু করে। বিগত তিনমাস যাবৎ এই করে আসছে বলে কাজটা নতুন কিছু নয় তার জন্য, ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’-এ থাকা পার্টির দু’জন নেতাকে রাতের খাবার পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব তার। এবার ‘আন্ডারগ্রাউন্ড’ মানে তো আর পাতাল নয়, সেটাও একটা না একটা বাড়ি, যার হদিশ খুব কম লোক জানে। পুরো পাড়াটাই মোটামুটি একটিই দলের সমর্থক বলে লুকিয়ে থাকা নেতাদের খানিকটা সুবিধা হত। কিন্তু তাদের মধ্যে এই গৃহবধূ ও তার স্বামীর মতো দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেওয়ার বিশেষ কাউকে পাওয়া যায়নি। সে না যাক, কাজটা করে যে তারা জগৎ উদ্ধার করছে, তেমন কোনও ভাবনাও তাদের মাথায় আসেনি কখনও; কাউকে না কাউকে তো করতেই হবে, তারা করছে, এই ছিল ব্যাপার। কিন্তু সেই রাতে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে, ওই বাড়িটির উঠোন পেরনোর সময় গৃহবধূটিকে একটা কিছু কামড়ায়। আর সেটা যে সাপ, তা বুঝতে খুব বেশি সময় লাগে না। কিন্তু ততক্ষণে থালা দুটো হাতে ঘরের ভিতরে ঢুকে এসেছে সে এবং দু’জন নেতাই বুঝে গিয়েছে, ঠিক কী ঘটেছে। এরপরের ঘটনাটা বহুদূর থেকে দেখলে বেশ মজাই লাগে। সেই দুই নেতার একজন চুপ করেই থাকেন। অন্যজন ঘরে থাকা ডেটলের শিশিটা ওই গৃহবধূর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন যে– এসব স্থানীয় সাপে বিষ থাকে না, হাসপাতাল ইত্যাদি করার কোনও প্রয়োজন নেই, গোড়ালির কাছটা ধুয়ে ডেটল লাগিয়ে ন্যাকড়া বেঁধে নিলেই বিষ ছড়াবে না আর।
এতক্ষণ চুপ করে থাকা দ্বিতীয়জন এবার মনে করিয়ে দেন যে, দেশভাগের সময় পালিয়ে এলেও পূর্ববঙ্গের বিরাট ঠাকুরবাড়ির সন্তান তিনি, তাঁদের আশীর্বাদে মরা মানুষ বেঁচে উঠত, এই ক’দিন আগেও। অতএব একটুকরো কাগজে তিনি যে মন্ত্র লিখে দিচ্ছেন, ঘরে ফিরে গিয়ে তা পাঠ করলেই সাপের বিষ একেবারে হোমিওপ্যাথি ওষুধের মতো ‘পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন’ হয়ে যাবে। সেই রাত্রে দুই বিপ্লবীকে খাবার দিয়ে ঘরে ফিরে এসে খানিকক্ষণ চুপ করেই বসেছিল ওই গৃহবধূ আর তারপর শরীর অস্থির করতে শুরু করায় নিজের স্বামীকে খানিকটা ঢেকেচুপে ঘটনাটার কথা বলে সে। তারপর কীভাবে, কারও কোনওরকম সাহায্য ছাড়া বাঙুর হাসপাতাল অবধি পৌঁছয় তারা, টালিগঞ্জ চত্বরের এক পরিচিত কংগ্রেসি আধা-গুন্ডা, দরজা ধাক্কিয়ে একজন অভিজ্ঞ ডাক্তারকে ঘুম থেকে তুলে এনে, গৃহবধূটির প্রাণ বাঁচিয়ে তার পরিবারের চিরকালীন কৃতজ্ঞতাভাজন হয়েছিল– সে গল্প করতে বসলে মহাভারত হয়ে যাবে। যেটা বলার, ঘটনাটা ঘটার ৩০ বছর পরে, সেই গৃহবধূর ছেলের সঙ্গে, (যে জন্ম-ইস্তক ওই ঘটনার কথা শুনে আসছে) সেই মন্ত্র লিখে সাপের কামড় সারিয়ে দেওয়া বিপ্লবীর কথা বলার সুযোগ হয় একটু। প্রথমটা এড়িয়ে যেতে চাইলেও পরে তিনি স্বীকার করেন যে, ওই গৃহবধূর প্রাণের চাইতেও নিজের পুলিশের হাতে ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় তাঁকে পেড়ে ফেলেছিল। তাই ওই নিদান দিয়েছিলেন তিনি।
তারপর খানিকটা আত্মগ্লানির কন্ঠস্বরেই বলেন, ‘আত্মানং সততং রক্ষে’… ব্যস! ওই তিনটে শব্দই সেই ছেলেটিকে জন্মাবধি শুনে আসা আদর্শ, অবস্থান ইত্যাদি চিনিয়ে দিয়েছিল অনেকটা। বজ্রশিখার এক নিমেষেই সাদা-কালো মিলিয়ে গিয়েছিল। ‘নিশার খদ্যোত’ হেন যা জেগে ছিল তা যে কোনও মূল্যে আপন প্রাণ বাঁচানোর চাচাতুতো ভীষণ প্রতিজ্ঞা। এই প্রতিজ্ঞাই হয়তো তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় মানুষকে আর তার সামনে পূর্বাপর সবকিছুই ফিকে হয়ে যায়। তাই ভারতেও ‘দক্ষিণপন্থা’ বলে যা আজ বাজারে খুব চলছে, তা আদৌ কতটা ‘দক্ষিণ’, তা নিয়ে বিতর্কের ঘনঘোর অবকাশ থেকে যায়। স্বপন দাশগুপ্তর বইটি আদতে একটি সম্পাদিত গ্রন্থ যেটি শুরু হচ্ছে স্বপনের লেখা তিনটি অধ্যায় দিয়ে, যেগুলোকে তিনটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধও বলা যায়, যেগুলি আবার একই ভাবনার সূত্রে গ্রথিত। তিনপাতার ছোট্ট মুখবন্ধের শেষেই স্বপন জানিয়েছেন, ‘This book is not about Hindu Nationalism in power, but as a social and political movement…’। তার একটু আগেই তিনি বলেছেন, ‘In the course of the introductory essay and the collection of readings that accompany it, I have attempted to locate some of the ideas, attitudes and beliefs that define the Indian right. I have also sought to identify the nature of Indian conservatism and
identify its similarities and
differences with political thought in the west…’
(introductory essay)
এরপর ভারতীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে নরেন্দ্র মোদির আগমন এবং উত্থান কেন্দ্র করে প্রথম অধ্যায়টি রচিত, যার নাম স্বপন দিয়েছেন, ‘The Political Context’. এই অধ্যায়ে তিনি নয়ের দশকের মাঝামাঝি অটলবিহারী বাজপেয়ীর প্রধানমন্ত্রিত্বে আরোহণের সময়কালকে ছুঁয়ে গিয়েছেন, মুরলী মনোহর যোশী মানবসম্পদ উন্নয়নমন্ত্রী হিসাবে দায়ভার নিয়ে কীভাবে ভারতের ইতিহাসের বিকৃতি প্রসঙ্গে সরব হয়েছিলেন, যে-অভিযোগ বামপন্থীরা তাঁর সরকারের দিকেই ছুঁড়ে মারবে পালটা– সেসব নিয়ে আলোচনা করেছেন। যে ব্যাপারটা উঠে এসেছে তা এককথায়: ভারতকে ‘ভূখণ্ড’ হিসাবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ভারতকে একটি ‘সত্তা’ হিসাবে দেখার অনুভব। ভারতকে ‘রাষ্ট্র’ হিসাবে মানতে নারাজ অনেক ইতিহাসবিদের চোখে কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারিকা একটি ‘ভৌগোলিক বিস্তার’ মাত্র, যার আর্যাবর্ত এবং দাক্ষিণাত্যে যোজন তফাত। অন্যদিকে ভারতকে, মহামানবের বিস্তৃত সাগরতীর ভেবে নেওয়া মানুষের কাছে, ‘গঙ্গেচ যমুনেচৈব গোদাবরী, সরস্বতী/ নর্মদা, সিন্ধু, কাবেরী/ জলেহস্মিন সন্নিধিং কুরু’ শ্লোকটাই যথেষ্ট, আসমুদ্র হিমাচল চিরকালই একটি একচালার প্রতিমা ছিল, বিশ্বাস করার জন্য।
‘Motherland, Religion and Community’ শীর্ষক দ্বিতীয় অধ্যায়ে স্বপন ‘বন্দে মাতরম্’ কেন্দ্র করে জেগে ওঠা বিরোধ দিয়ে শুরু করেছেন। ‘বন্দে মাতরম্’-এর মতো একটি গানের ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক আপত্তি কীভাবে উঠতে পারে তাই নিয়ে গান্ধীজির মনোবেদনার কথাও উদ্ধৃত হয়েছে। মুসলিম লিগ এবং মহম্মদ আলি জিন্না বন্দে মাতরমের তীব্র বিরোধিতাকে প্রায় প্রেস্টিজ ইস্যুতে নিয়ে গিয়েছিলেন– সে কথা জানিয়েছেন লেখক। কিন্তু একই সঙ্গে মুসলিম সমাজের একটি ক্ষুদ্র অংশ যে মনে করত– কেবলমাত্র জীবনে নয়, মৃত্যুর পরেও ভারতের মাটি একজন মুসলমানের আশ্রয়, সেই ভারতের উদ্দেশে ‘বন্দে মাতরম্’ গাওয়া দোষের কিছু নয়, তার উল্লেখও জরুরি ছিল। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উঠে এসেছে এই অংশে। তা হল: গরু নিয়ে রাজনীতি। অনেকে মনে করেন, গরু নিয়ে এই বিবাদ-বিসম্বাদ সাম্প্রতিক। কিন্তু ভারতেতিহাসের ইশারা অন্যরকম। সেই বিরাট রাজার রাজত্বে অজ্ঞাতবাসে থাকাকালীন পাণ্ডবরা বিরাটের গোধন বাঁচাতে যুদ্ধে নেমেছিলেন। তারপর গোটা মধ্যযুগ গরুকে মাঝখানে রেখে অত্যাচারের যে পরম্পরা চলে এসেছে, ‘চৈতন্য চরিতামৃত’ থেকে রাহুল সাংকৃত্যায়ণের লেখায় তার অজস্র উদাহরণ। সেই বিষফোড়া আজ আবার অন্যভাবে নিজেকে প্রকাশ করছে। কাউকে গোমাংস খাইয়ে ধর্মান্তরিত করা, না-খেতে চাইলে খুন করার ব্যাপ্ত ইতিহাস, কারও বাড়িতে গোমাংস আছে সন্দেহ করে তাকে পিটিয়ে মারার বীভৎসতা এসে ব্যালান্স করতে চাইছে কি না বোঝা দায়। ভারতীয় সমাজ জীবনে গরু যে কতটা গুরুত্বের জায়গা দখল করে ছিল, তা বোঝা যায় যখন হাজার হাজার সাধু দিল্লির রাজপথে নেমে পড়েছিলেন ১৯৬৬ সালের ৭ নভেম্বর। সংসদ ভবনের সামনে সাধুদের সেই মিছিলে গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছিল ইন্দিরা গান্ধীর সরকার, যার ফলে আটজনের মৃত্যু হয় সেদিন, দিল্লির রাস্তায়। স্বপন যথার্থই ইঙ্গিত করেছেন, ইউরোপের কোনও শহরে পাদ্রিদের উপরে গুলি চললে সেদিনই সরকার পড়ে যেত, কিন্তু ভারতের সাধুরা এমনই তৃতীয় শ্রেণির নাগরিক যে এত বড় ঘটনার পরেও কেউ প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেনি। কিন্তু ধীরে ধীরে সনাতন ধর্ম এবং সংস্কৃতির সঙ্গে জড়িত সমস্ত ব্যাপারেই কংগ্রেস নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা হারাতে শুরু করে, ’৬৭-র নির্বাচনে উত্তর এবং মধ্যভারতের ভোটে যার প্রমাণ মেলে।
ইতিহাস খুব নির্মম। জিন্না সাহেবের মেয়ে একজন পারসিকে বিয়ে করে ভারতে থেকে গেলেও জিন্না তার নাম এবং পদবি পরিবর্তনের কোনও চেষ্টা করেননি। অন্যদিকে ইন্দিরার ক্ষেত্রে একই পরিস্থিতিতে কেন ‘গান্ধী’ পদবি ব্যবহার করতে হয়েছিল, তার কারণ সহজেই অনুমেয়। সেই একই কারণে হয়তো সোমনাথ মন্দির পুনর্নির্মাণের ঘোরতর বিরুদ্ধে থাকা নেহরুকে ’৬২-র লোকসভা নির্বাচনে, কোনও এক ব্রহ্মচারী বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছেন বলে, গঙ্গায় ডুব দিয়ে নিজের ধর্মের প্রমাণ দিতে হয়। আর তাঁর প্রনাতিকে নিজেকে শিবভক্ত পৈতেধারী বলে জাহির করতে হয়। পুরোটাই এই আলোচনার প্রথমে উল্লিখিত সেই গল্পের মতো যেখানে বিপদ কাটাতে বিপ্লবীও মন্ত্রের শরণ নেয়। ‘Politics and the Hindu Narrative’ শীর্ষক তৃতীয় অধ্যায়ে শ্রী অরবিন্দ, তিলক, সাভারকার প্রমুখ অনেকের উদাহরণ টেনে এনে স্বপ্ন দাশগুপ্ত ভারতীয় পরম্পরার সংকট ও সম্ভাবনাকে বুঝতে চেয়েছেন। গভীরে যেতে চেয়েছেন, ‘সেকুলারিজম’ বনাম ‘হিন্দু’ বিতর্কের যা ক্ষুদ্র পরিসরে প্রায় অসম্ভব একটি কাজ। সেখান থেকে ‘শাহবানো মামলা’-র প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের রায় উলটে দিয়ে রাজীব গান্ধীর সরকার যে-পদক্ষেপ করেছিল এবং সেই আবহে রাম জন্মভূমি বাবরি মসজিদ বিতর্কে নতুন করে শক্তিসঞ্চারের দিকে ঘুরে গিয়েছে আলোচনা।
সেখান থেকে আবার মোদিতে ফিরে এসেছেন স্বপন। ২০১৪-র নির্বাচন যে ভারতের ইতিহাসে একটি জলবিভাজিকার মুহূর্ত তা উল্লেখ করে ’১৯-এর নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রকাশিত এই বই ভারত ইতিহাসের ধারা কোনদিকে বইবে, এই, এর-ওকে ‘কমিউনাল’ এবং ওর তাকে ‘সিউডো-সেকুলার’ বলার যুদ্ধে, শেষমেষ কি ভারতীয় শাসনব্যবস্থায় ভারতের মাটির ছাপ থাকবে না কি বিলেতি ধাঁচে পরিচালিত হবে ভারতের ‘সিস্টেম’, বংশবাদী আভিজাত্যের গরিমা পুনর্দখল করবে দিল্লির মসনদ– এই প্রশ্ন নিয়ে শেষ করেছেন তিনি। বইয়ের পরের অংশ জুড়ে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিশ্বের উন্মোচন। সেখানে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় থেকে শ্রী অরবিন্দ, সিস্টার নিবেদিতা থেকে নির্মলচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, আনন্দ কুমারস্বামী থেকে অটলবিহারী বাজপেয়ীর উজ্জ্বল উপস্থিতি। রয়েছেন রমেশ্চন্দ্র মজুমদার, এম. জি. রানাডে, আর. জি. ভাণ্ডারকর, যদুনাথ সরকার, ভি. ডি. সাভারকর, সর্দার বল্লভভাই প্যাটেল, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়, নিরোদ সি. চৌধুরী, সীতারাম গোয়েল প্রমুখ। দিলীপ পদগাঁওকরের সঙ্গে কথোপকথন সূত্রে আছেন ভি. এস. নইপল। প্রত্যেকের রচনার মধ্যে থেকে একটা মূল সুর যদি থেকে থাকে, তাহলে তা আবহমান ভারতের বহতা সংস্কৃতি যার উৎপত্তি ভারতে সুলতানি বা মোগল শাসন শুরু হওয়ার অনেক আগে। আর অধিকাংশ রচনার ভিতর দিয়ে যে যন্ত্রণা ও ক্ষোভ ব্যক্ত হয়েছে তা হল, ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হয়ে যাওয়ার পরও খণ্ডিত ভারতে, ‘হিন্দু’ শব্দটিকেই একটি ‘অপশব্দ’ হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার প্রবণতা।
হিন্দু-বিরোধী রাষ্ট্রে অত্যাচারিত হিন্দুদের কথা বলাই ‘ধর্মনিরপেক্ষতা’ এমন একটা অন্তর্লীন সুর বইটির ভিতর থেকে বেজে ওঠে। ইন্দিরা গান্ধী সংসদে একটি বক্তৃতায় বলেছিলেন যে, ভারতে যে-যেখানে সংখ্যাগুরু সেখানে সংখ্যালঘুকে রক্ষা করার দায়িত্ব তার। আজকের ভারতে এটা অবশ্যমান্য। গুজরাটে এই কর্তব্যপালনে বিচ্যুতি হয়েছে ২০০২-তে। আর কাশ্মীরে পুরো এথনিক ক্লিনজিং হয়েছে। অতএব গুজরাটের কথা বলে কাশ্মীরের কথা বলবেন না যাঁরা, তাঁরা প্রকৃত প্রস্তাবে বিভাজনকেই প্রশ্রয় দেবেন। আর তার ফল মাইনরিটি ভোট ব্যাংকের বিপরীত একটি কনসলিডেশনের চেহারা নেবেই নেবে। স্বপন দাশগুপ্তর এই যুক্তিগুলি একটাও ফেলে দেওয়ার নয়, উনিশের লোকসভার ফলাফলই তার প্রমাণ। কিন্তু তারপরও একটা কথা থাকে। ‘Rise of the right’– যাকে বলছেন স্বপন তা কি কোথাও একটা ‘rise of the left’-ও নয়? শ্রী অরবিন্দ কিংবা নিবেদিতা কি তাঁদের কাজের বিচারে বামপন্থীই নন? বামপন্থাকে হাইজ্যাক করে যাঁরা নিজেদের স্কচ এবং বাড়ির বউদের লুকিয়ে লোকনাথ পুজোকে জাস্টিফাই করে এসেছেন দীর্ঘদিন ধরে, এবারের নির্বাচন সেই লুকিয়ে সত্যনারায়ণ এবং হজযাত্রার দ্বিচারিতার বিরুদ্ধেও জনবিস্ফোরণ। মাওবাদী থিঙ্ক ট্যাঙ্ক নিয়ে কংগ্রেস জনতার সেই মুড বুঝতে পারেনি, পারলে জাতীয়তাবাদকে আর একটু গুরুত্ব দিত।
কিন্তু নির্বাচনোত্তর পরিস্থিতিতে চ্যালেঞ্জটা অন্য। একপেশে বিচারধারার সমস্যা মেনে নিয়েই বলতে হয়, জোর করে কাউকে ‘রামনাম’ করাতে চাওয়া, আর না-করলে পেটানো অপরাধ, অপরাধ এবং অপরাধ। একইভাবে কলকাতার কাছেই, ছাত্রদের জাতীয় সংগীত গাওয়ানোর অপরাধে, ‘ও মাস্টার, হিন্দুদের গান গাওয়াচ্ছ কেন’ বলে লোহার রড মেরে প্রধান শিক্ষকের মাথা ফাটিয়ে দেওয়াও জঘন্য অপরাধ। দু’ক্ষেত্রেই লুম্পেনদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দরকার। ‘ভারতমাতার জয়’ কেবলমাত্র আকাশে মিসাইল পাঠিয়ে সম্পন্ন হবে না, মাটির পৃথিবীতে দৃঢ় এবং পক্ষপাতহীন শাসনও প্রয়োজনীয় তার জন্য। স্বপন দাশগুপ্ত তাঁর আগামী কোনও বইতে এই ব্যাপারগুলো নিয়েও আলোচনা করবেন, আশা রইল। তবে তার আগে এই বইটার জন্য তাঁর একটি ধন্যবাদ প্রাপ্য। দু’দিকের আয়না ছাড়া হেয়ার কাটিং সেলুনই চলে না, দেশ চলবে কী করে?
The post ‘আত্মানং সততং রক্ষে’… appeared first on Sangbad Pratidin.