সৌম্য বন্দ্যোপাধ্যায়: সোনিয়া গান্ধী নিশ্চয়ই এতদিনে স্বস্তির শ্বাস ফেললেন। পুত্রের পায়ের তলার জমি এই প্রথম কিছুটা শক্ত হল বলে। রাহুল গান্ধীরও খুশি হওয়ার কারণ আছে। দলের সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণের ঠিক এক বছরের মাথায় এই প্রথম তিনি মেওয়া ফলাতে পারলেন। এ যেন ধ্বংসস্তূপ থেকে মাথা তুলে দাঁড়ানোর উদাহরণ। ফিনিক্স পাখির মতো জেগে ওঠা। রাহুল প্রমাণ করলেন, ‘কংগ্রেস-মুক্ত ভারত’ গড়ার স্বপ্ন দেখা ও দেখানো বাতুলতা মাত্র। সন্দেহ নেই, দেশের শাসক দলকে মোক্ষম জবাব দিয়ে তিনি দলে নতুন শক্তি সঞ্চার করতে পেরেছেন।
কিন্তু মাথা নোয়ানো সত্ত্বেও বিজেপি কি সেমিফাইনালের লড়াইয়ে হারল? বুক বাজিয়ে কথাটা বলতে বাধো বাধো ঠেকছে। টানা ১৫ বছর রাজত্ব করা সত্ত্বেও মধ্যপ্রদেশে বিজেপি যদি এভাবে মাটি কামড়ে লড়াই করে, সেটাকে আর যাই হোক ‘হার’ হয়তো বলা যায় না! যে রাজ্যের মানুষ প্রতি পাঁচ বছর অন্তর শাসক দলকে ধুয়ে-মুছে সাফ করে দেয়, সেখানে গণনার শেষ পর্যন্ত শাসক দলের আশা জিইয়ে রাখাটা হার হলেও অগৌরবের নয়। রাজস্থানে হয়েছে ঠিক সেটাই। ওই রাজ্যে বিজেপি আজ থেকেই কংগ্রেসের ঘাড়ের উপর শ্বাস ফেলার প্রস্তুতি নেবে। গো-বলয়ে বিজেপি-শাসিত তিন রাজ্যের মধ্যে একমাত্র ছত্তিশগড়ের সুর বিজেপির কাছে নিতান্তই বেসুরো। কিন্তু এটাও মনে রাখা দরকার, ১৫ বছর প্রতীক্ষার পর সেই রাজ্যে কংগ্রেসের প্রত্যাবর্তন ঘটেছে।
[ঘোরতর সমালোচনার পরও দুই রাজ্যে কংগ্রেসকে সমর্থন মায়াবতীর]
তেলেঙ্গানা ও মিজোরামের ভোটও এই সঙ্গে সাঙ্গ হল। প্রত্যাশিত ফল ওই দুই রাজ্যেও। দুই রাজ্যের একটিও বিজেপিকে আশ্বস্ত করেনি। কংগ্রেসকেও ব্যর্থ প্রতিপন্ন করেছে। আকর্ষণের নিরিখে ওই দুই রাজ্য প্রথম থেকেই ছিল যেন এলেবেলে। সব নজর কেড়ে নিয়েছিল হিন্দি—হৃদয়ের তিন রাজ্য। এর প্রধান কারণ, তিন রাজ্যই ছিল বিজেপির দখলে এবং তিন রাজ্যেই লড়াই ছিল দ্বিমুখী। বিজেপি বনাম কংগ্রেস। দ্বিতীয় কারণ, প্রচার যত এগিয়েছে, লড়াই ততই হয়ে দাঁড়িয়েছে নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে রাহুল গান্ধীর। তৃতীয়ত, সবাই বুঝতে চেয়েছে এই তিন রাজ্যের ফল ২০১৯-এর ফাইনাল ম্যাচে বিজেপিকে কতটা কঠিন পরীক্ষার মুখে দাঁড় করাতে পারবে, এবং রাহুল গান্ধী বিরোধী জোটের প্রধান মুখ হয়ে উঠতে পারেন কি না।
শেষের এই উত্তরটা কি পাওয়া গেল? গণনার আগের দিন সোমবার বিরোধী নেতারা বৈঠকে বসলেন। সেই বৈঠকে বহুজন-নেত্রী মায়াবতী ও সমাজবাদী নেতা অখিলেশ সিং যাদব হাজির হলেন না। দু’জনেই কংগ্রেসকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছিলেন গো-বলয়ের তিন রাজ্যে তাঁদের সঙ্গে জোট না-করায়। স্পষ্টতই তাঁরা মঙ্গলবারের ফলের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। ফল দেখাচ্ছে, ছত্তিশগড়ে মায়াবতী-অমিত যোগীর জোট সেভাবে দাঁত ফোটাতে পারেনি। কিন্তু রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে জোট করলে কংগ্রেসকে এভাবে চিন্তায় থাকতে হত না। কংগ্রেসের সঙ্গে জোটে না-যাওয়ার জন্য বিজেপি যদি ‘বিএসপি’-কে বিচ্ছিন্ন করে থাকে, তাহলে বলতে হবে তারা যথেষ্ট সফল। এই সাফল্য ধরে রাখতে হলে ফাইনালে তাদের আরও সক্রিয় হতে হবে। সেজন্য মায়াবতীকে গ্রহণযোগ্য, বিশ্বাসযোগ্য ও যুক্তিগ্রাহ্য কোনও ব্যাখ্যা খাড়া করতে হবে। সোমবারের বৈঠকের পর মায়াবতী ও অখিলেশের গরহাজিরা নিয়ে রাহুলকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। রাহুলের জবাব ছিল, কথাবার্তা এখনও চলছে।
[রাতভর টানটান উত্তেজনার পর মধ্যপ্রদেশেও শেষ হাসি কংগ্রেসের]
শেষ প্রশ্নটির দ্বিতীয় ভাগ রাহুলের নেতৃত্বকেন্দ্রিক। শরদ পাওয়ার এখনও এই প্রশ্নের উত্তর দেননি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ভোটের এই ফলকে ‘গণতন্ত্রের জয়’ আখ্যা দিয়ে কংগ্রেস ও রাহুল সম্পর্কে নিরুচ্চার । বিরোধীদের বৈঠকে যোগ দিলেও রাহুলের নেতৃত্ব নিয়ে চন্দ্রবাবু নায়ডু সবাইকে হেঁয়ালিতে রেখেছেন। স্পষ্টতই, রাহুল সম্পর্কে আড়ষ্টতা এই নেতাদের এখনও কাটেনি। সেমিফাইনালের ফল সেই আড়ষ্টতা কাটাতে কতটা সাহায্য করবে, তা বোঝা যাবে রাহুলের ব্যক্তিগত উদ্যোগের উপর। সেই উদ্যোগই বোঝাবে, ফাইনালে কতটা প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে বিজেপিকে সম্মিলিতভাবে বিরোধীরা ফেলতে পারবে।
গত সাড়ে চার বছর ধরে বিজেপির অগ্রগতি বিচার করলে দেখা যাবে ‘চ্যালেঞ্জার’ হিসাবেই তাদের সাফল্য প্রবল। অর্থাৎ, যে রাজ্যে তারা ক্ষমতায় ছিল না, ২০১৪ সালের পর সেখানে তাদের ঠেকানো যায়নি। উত্তরপ্রদেশ, হরিয়ানা, উত্তরাখণ্ড, হিমাচলপ্রদেশ, ঝাড়খণ্ড, গোয়া, মণিপুর, অসম, মেঘালয়, ত্রিপুরা সব রাজ্যেই চ্যালেঞ্জার হিসাবে তারা প্রতিপক্ষকে ধরাশায়ী করেছে। এমনকী, কর্নাটকেও। কংগ্রেসের তৎপরতায় সরকার হয়তো তারা গড়তে পারেনি, কিন্তু ‘একক গরিষ্ঠ দল’ হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করেছে। তুলনায় যে রাজ্যে বিজেপি ক্ষমতায় ছিল, অর্থাৎ ডিফেন্ডার, সেখানে তারা বিশেষ সুবিধা করতে পারেনি। গুজরাত থেকে সেই উদাহরণ শুরু। রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে তার শেষ।
গো-বলয়ের এই ফল বিজেপিকে কী শিক্ষা দিল? তিন রাজ্যেই গ্রামাঞ্চলে তারা ব্যাপক ধাক্কা খেয়েছে। কৃষক ক্ষোভ কতটা প্রবল এটা প্রমাণ। কংগ্রেসের প্রচারের অভিমুখে ছিল: কৃষক ক্ষোভ, নোট বাতিল, জিএসটি, সামাজিক অসন্তোষ সৃষ্টি, ঔদ্ধত্য, রাফাল দুর্নীতি ও মোদি-ঘনিষ্ঠ শিল্পবন্ধু তোষণ। সরকারের জনমুখী কর্মসূচির সাতকাহন প্রচার, কংগ্রেসকে হেলাফেলা করা ও প্রধানমন্ত্রীর ভাবমূর্তিতে অতিরিক্ত নির্ভরতা এই প্রচার কাটানোর পক্ষে যথেষ্ট নয়। এই ফলের পর উজ্জীবিত কংগ্রেস আরও আক্রমণাত্মক হবে। ফাইনালের জন্য এই ফল বিজেপির কাছে ‘ওয়েক আপ কল’। সাংগঠনিক শক্তি ও অঢেল সম্পদ-প্রাচুর্য ফাইনালের বাধা কাটাতে যথেষ্ট কি না, সেই উত্তর বিজেপিকেই খুঁজে বের করতে হবে।
মায়াবতী ও অখিলেশের কাছেও এই ফল বিশেষ বার্তাবহ। দুই দলেরই বোঝা প্রয়োজন, উত্তরপ্রদেশই তাদের প্রধান ও নির্ভয় বিচরণভূমি। তাদের অস্তিত্ব এই রাজ্যের উপরই নির্ভরশীল। জোটবদ্ধ হলে রাজ্যে বিজেপিকে কীভাবে রোখা যায়, তার হাতেগরম প্রমাণ লোকসভার সাম্প্রতিক উপনির্বাচন দিয়ে গিয়েছে। অত্যধিক আসন দাবি না করে কংগ্রেসের হাত ধরলে তিন রাজ্যেই আখেরে তাদের লাভ যেমন হত, তেমনই আরও কঠিন হয়ে পড়ত বিজেপির অবস্থান। নির্বাচন কমিশন অনুযায়ী, বিজেপি ও কংগ্রেসের প্রাপ্ত ভোটের হার ৪১ শতাংশের কম-বেশি ঘোরাফেরা করছে। বিএসপি ও কংগ্রেস জোটবদ্ধ হলে তাদের প্রাপ্ত ভোট ৪৫ শতাংশ ছাড়িয়ে হত। জোট পেত ১৪০-এর বেশি আসন, বিজেপি থমকে যেত ৮৫-তে। আগামীতে গো-বলয়ের রাজনীতিও নির্ভর করবে জোটের এই সিদ্ধান্তের উপরেই। মায়াবতীর মনে থাকা দরকার, দীর্ঘকাল তাঁর দল উত্তরপ্রদেশে ক্ষমতার বৃত্তের বাইরে। ক্ষমতা থেকে দীর্ঘ অনুপস্থিতিতে কী হাল হয় রাজ্য কংগ্রেসই তার প্রমাণ।
তেলেঙ্গানায় তেলুগু দেশমের সঙ্গে জোট করেও কংগ্রেস হালে পানি পেল না। এই রাজ্য গঠনের কৃতিত্ব দাবি করেও কংগ্রেস ক্ষমতা থেকে সরাতে ব্যর্থ হল ‘তেলেঙ্গানা রাষ্ট্র সমিতি’-কে। একইরকম মিজোরামে শান্তি চুক্তির কৃতিত্বও কংগ্রেসের। অথচ দুই রাজ্যের মানুষ কংগ্রেসকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বিশেষ করে তেলেঙ্গানায়। এই রাজ্যে কংগ্রেসের বিপর্যয়ের একটি ব্যাখ্যা চন্দ্রবাবু নায়ডুর সঙ্গে হাত মেলানো। রাজ্যভাগের বিরোধিতা আদা-জল খেয়ে যে দলটি করেছিল, সেই দলের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা তেলেঙ্গানার মানুষ মেনে নেয়নি। রাহুল কি তা জানতেন না? জানতেন। সেই আশঙ্কাও তাঁর ছিল। কিন্তু তবুও তিনি চন্দ্রবাবুর হাত ধরেছেন জাতীয় স্তরে এই বার্তা পৌঁছে দিতে যে, বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করতে তাঁর ‘কর্ণাটকি সিদ্ধান্ত’ বিচ্ছিন্ন ছিল না।
[মোদির উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি ভুলে গিয়েছিল দল, সমালোচনা বিজেপি সাংসদের]
‘নেতা’ হিসাবে রাহুল গান্ধী নিজেকে প্রতিষ্ঠা হয়তো করলেন, কিন্তু শুরু থেকেই তাঁকে আতশকাচের তলায় দাঁড়াতে হবে। কৃষকদের মন জিততে তিন রাজ্যেই ক্ষমতায় আসার দশদিনের মধ্যে যাবতীয় কৃষিঋণ মকুবের প্রতিশ্রুতি তাঁরই দেওয়া। ফসলের ‘সহায়ক মূল্য’ বাড়ানোর অঙ্গীকারও তিনি করেছেন। রাহুল কিন্তু জানেন না, কোষাগারের হাল কোন অবস্থায় রেখে বিজেপি সরে যাচ্ছে। ফাইনালের চারমাসও বাকি নেই। প্রতিশ্রুতি পালনে রাহুলের হাতে সময় অতএব নিতান্তই কম। তিনি বিলক্ষণ জানেন, ফাইনালে জিততে গেলে এই তিন রাজ্যকে লালন করতে হবে পরম মমতায়। কেননা, তিন রাজ্যের মোট ৬৫টি লোকসভা আসনে ’১৪-য় কংগ্রেসের ভাগ্যে জুটেছিল মাত্র ৩! মা হিসাবে সোনিয়া নিশ্চয় অবশেষে নিশ্চিত। এতদিনে ছেলের পায়ের তলার মাটি বেশ খানিকটা শক্ত হল বলে। কিন্তু রাহুল গান্ধীর আসল পরীক্ষা শুরু হল গতকাল থেকেই।
The post ‘কংগ্রেস-মুক্ত’ ভারত ও কিছু প্রশ্ন appeared first on Sangbad Pratidin.