shono
Advertisement

মা সারদার জন্মতিথি: দেবী আর মাতৃরূপের সাক্ষাৎ সমন্বয়

জানেন কি, জীবদ্দশাতে কী ভাবে পালিত হত সারদা মায়ের জন্মতিথি? ক্লিক করে জেনে নিন! সঙ্গে দেখুন মায়ের অপ্রকাশিত দুষ্প্রাপ্য ছবি। The post মা সারদার জন্মতিথি: দেবী আর মাতৃরূপের সাক্ষাৎ সমন্বয় appeared first on Sangbad Pratidin.
Posted: 05:37 PM Dec 20, 2016Updated: 12:39 PM Dec 21, 2016

অনির্বাণ চৌধুরী: নিজের সম্পর্কে তিনি বলতেন- আমি সতেরও মা, অসতেরও মা। আবার ঠাকুর রামৃষ্ণ পরমহংস তাঁর মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ভক্তদের কাছে বলেছিলেন- ও সারদা, সাক্ষাৎ সরস্বতী!
সারদামণি চট্টোপাধ্যায়ের স্বরূপটি তাহলে কী? তিনি দেবী না মা?

Advertisement


দেবী শব্দটির দিকে এক্ষেত্রে একটু না তাকালেই নয়। আমরাই তো বলছি- সারদা দেবী। কিন্তু তা কি আগেকার দিনের প্রথা মেনে শ্রদ্ধেয়া নারীর সঙ্গে জুড়ে দেওয়া একটা উপাধি মাত্র?
মনে হয় না! কেন না, যতবার জীবদ্দশায়, আধ্যাত্মিক মতে স্থূল শরীরে জন্মতিথি পালিত হয়েছে মায়ের, ততবারই আমরা দেখতে পেয়েছি মাতৃত্ব আর দৈবী মহিমার এক অপূর্ব সমন্বয়। এই দুই সত্তাই অত্যন্ত সাবলীল ভাবে মিশে গিয়েছিল মায়ের চরিত্রে। জন্মলগ্ন থেকেই।
ইতিহাস বলছে, ১৮৫৩ সালের ২২ ডিসেম্বর, বাংলা হিসেবে ১২৬০ সালের ৮ পৌষ, বৃহস্পতিবারে রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এবং শ্যামাসুন্দরী দেবীর সংসারে জন্মগ্রহণ করেন সারদামণি। মা নিজের মুখেই তাঁর যে জন্মবৃত্তান্তটি বলেছেন ভক্তদের, সেই দিকে একবার তাকানো যেতে পারে। তাহলেই চোখে পড়বে যে দৈবী মহিমা কী ভাবে ঘিরে ছিল তাঁকে আজীবন।


“আমার মা শিওড়ে ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলেন। ফেরবার সময় হঠাৎ শৌচে যাবার ইচ্ছা হওয়ায় দেবালয়ের কাছে এক গাছতলায় যান। শৌচের কিছুই হলো না, কিন্তু বোধ করলেন, একটা বায়ু যেন তাঁর উদরমধ্যে ঢোকায় উদর ভয়ানক ভারী হয়ে উঠল। বসেই আছেন। তখন মা দেখেন লাল চেলি পরা একটি পাঁচ-ছ বছরের অতি সুন্দরী মেয়ে গাছ থেকে নেমে তাঁর কাছে এসে কোমল বাহু দুটি পিঠের দিক থেকে তাঁর গলায় জড়িয়ে ধরে বলল, আমি তোমার ঘরে এলাম মা। তখন মা অচৈতন্য হয়ে পড়েন। সকলে গিয়ে তাঁকে ধরাধরি করে নিয়ে এল। সেই মেয়েই মায়ের উদরে প্রবেশ করে; তা থেকেই আমার জন্ম।“


সেই শুরু! এর পর বার বার দেখা যাবে, মায়ের থেকে কিছুতেই আলাদা করা যাচ্ছে দৈবী মহিমার ব্যাপার-স্যাপার। এমনকী এই যে তাঁর নাম সারদা, যার সূত্রে পরবর্তীকালে ঠাকুর তাঁকে বলবেন সরস্বতী, তার পিছনেও কাজ করছে ঐশ্বরিক অভিপ্রায়। কেন না, রামচন্দ্র বা শ্যামাসুন্দরী- কেউই মেয়েকে সারদা নামে চেনেননি। তাঁরা রেখেছিলেন অন্য নাম- ক্ষেমঙ্করী। কী ভাবে ক্ষেমঙ্করী থেকে সারদায় পৌঁছল জীবন, সে কথাও নিজেই বলেছেন মা। “আমার মা আমার নাম রেখেছিলেন ক্ষেমঙ্করী। আমি হবার আগে, আমার যে মাসিমা এখানে (জয়রামবাটীতে) সেদিন এসেছিলেন, তাঁর একটি মেয়ে হয়। মাসিমা তার নাম রেখেছিলেন সারদা। সেই মেয়ে মারা যাবার পরেই আমি হই। মাসিমা আমার মাকে বলেন, দিদি, তোর মেয়ের নামটি বদলে সারদা রাখ; তাহলে আমি মনে করব আমার সারদাই তোর কাছে এসেছে এবং আমি ওকে দেখে ভুলে থাকব। তাইতে আমার মা আমার নাম সারদা রাখলেন।“ সেই রূপেই তাঁকে চিনেছিলেন ঠাকুর রামকৃষ্ণ। আর পরে ভক্তরা চিনলেন শক্তির বিশুদ্ধ প্রকাশ হিসেবে। যার ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন স্বয়ং ঠাকুরই! জানিয়ে গিয়েছিলেন- তাঁর অবর্তমানে ছেলেদের সহায় হবেন এই মা!


শক্তি যে, সে বিষয়ে কোনও সন্দেহই করা চলে না। বিশেষ করে জন্মতিথির উৎসবের দিকে তাকালে। এ সেই সময়ের ব্যাপার, যখন ঠাকুর দেহ রেখেছেন। প্রতিষ্ঠা হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশনেরও। ঠাকুরের অবর্তমানে মাকে ঘিরেই চলছে ছেলেদের যাবতীয় কাজকর্ম। তাঁদের কাজ, আনন্দ- সবেরই মধ্যমণি তখন সারদা। দেবী আর মাতৃত্ব- এই দুই অনায়াসে দুই হাতে বহন করে চলেছেন তিনি। ফলে, তাঁর জন্মতিথি ঘিরেও চলছে সাড়ম্বর প্রস্তুতি।
জন্মতিথির বেশির ভাগ সময়েই মা থাকতেন বাপের বাড়ি জয়রামবাটিতে। জগদ্ধাত্রী পুজোর কিছু দিন পরেই তাঁর জন্ম হয়। ও দিকে, স্বপ্নাদেশ পেয়ে তাঁর মা শ্যামাসুন্দরী দেবী শুরু করেছিলেন জগদ্ধাত্রী আরাধনা। তাই এই সময়টা সচরাচর জয়রামবাটি ছেড়ে অন্য কোথাও যেতেন না তিনি। সেখানে যখন তাঁর জন্মতিথি পালনের তোড়জোর চলত, তখনও মুখ্য ভূমিকা নিতেন তিনিই। আত্মীয়রা যাতে জন্মতিথিতে কোনও কারণে অসন্তুষ্ট না হয়, সে দিকে সজাগ নজর রাখতেন মা। আবার, গ্রামবাসীরাও যাতে মনঃক্ষুণ্ণ না হয়, সেই দিকে দৃষ্টি রেখে সাধ্যমতো আয়োজন করতে হত উৎসবের। সামান্য মানুষের সাধ্য কী, এমন ভাবে সব দিকেই ভারসাম্য রক্ষা করা!


যেমন, স্বামী ঈশানানন্দের লেখা থেকে জানা যায়, মায়ের ভাই, যাঁকে সবাই কালীমামা বলেই চিনতেন, তিনি ছিলেন কলহপরায়ণ। মায়ের জন্মতিথির সব আয়োজনের ভার তিনি নিজেই বহন করতে চাইতেন। দেখা গিয়েছে একাধিকবার তিনি যাতে কলহ না করেন, সেই দিকে বিশেষ সজাগ থাকতেন মা। সেই জন্য একবার বরদা মহারাজকে ছোট করে উৎসব করার ভার দেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও শেষ মুহূর্তে সেই পরিকল্পনা বাতিল করে দেন মা স্বয়ং। বরদা মহারাজকে ডেকে বলেন- “দেখ বরদা, এবারে কোতলপুরের হাট কালীকে দিয়েই করাতে হবে, কদিন থেকে এর জন্য সে ঘোরাঘুরি করছে…. শেষে চটেমটে একটা কাণ্ড বাধাবে।“ এ শুধুই মায়ের তুখোড় বুদ্ধির নিদর্শন নয়, সেই সঙ্গে করুণাও। তিনি ভালই জানেন- ভাইয়ের উৎসবের সর্বময় কর্তা হওয়ার বাসনা যতখানি, তার চেয়ে ঢের বেশি ইচ্ছা দিদির জন্মতিথিটি নিজের উদ্যোগে সুসম্পন্ন করা। বুঝতে পেরে সেই ইচ্ছাও পূরণ করেছেন মা।


তবে ব্যক্তিগত ভাবে জন্মতিথিতে বিশেষ আয়োজন করা তেমন মনঃপূত ছিল না মায়ের। জানা যায়, ১৯০৭ সালে জয়রামবাটিতে জন্মদিনে কী হবে জানতে চাইলে মা বলেছিলেন- “আমি একখানা নতুন কাপড় পরব, ঠাকুরকে একটু মিষ্টান্নাদি করে ভোগ দেওয়া হবে, আমি প্রসাদ পাব। এই আর কি।” এই অনাড়ম্বড় মনোভাব নিয়েই নিজের জন্মতিথিটি বরাবর কাটিয়ে গিয়েছেন মা। মাঝে মাঝে আবার তাঁর জন্মতিথির কথা খেয়ালও থাকত না। সেই প্রসঙ্গও উঠে এসেছে স্বামী নির্লেপানন্দের লেখায়। সেই জন্মতিথিতে মা ছিলেন কলকাতায়। গঙ্গাস্নান সেরে, উদ্বোধন কার্যালয়ের বাড়িতে ফিরে তিনি লক্ষ্য করেন যোগীন-মায়ের ব্যস্ততা। মা অবাক হয়ে প্রশ্ন করেছিলেন,  “এসব কি গো যোগেন? মায়ের দিকে একটু চেয়ে থেকে, গভীর প্রীতির সঙ্গে মার চিবুক স্পর্শ করে যোগীন-মা বললেন,, আজ যে তোমার জন্মতিথি, মা!” ভুবনভোলানো হাসি হেসে মা বললেন, “ও মা তাই? ” এরকমই ছিল তাঁর উদাসীনতা!


আর পুজো হয়ে গেলে এক ভক্তের দেওয়া তসরের কাপড় আর রুদ্রাক্ষের মালা পরে মা বসেছিলেন তাঁর ঘরে খাটের দক্ষিণ দিকে মাটিতে পা রেখে। ভক্তরা একে একে এসে দিয়ে যাচ্ছিলেন পুষ্পাঞ্জলি। মায়ের পায়ে ফুল দিয়ে প্রণাম করছিলেন। যা ছিল তাঁর জন্মতিথি পালনের দস্তুর। সেটুকুতেই লুকিয়ে ছিল দৈবী মহিমা। যা মাঝে মাঝে লক্ষ্য করা যেত জন্মতিথিতে তাঁর ভাবসমাধি হলে। জয়রামবাটির যামিনী দেবী স্মৃতিকথায় মায়ের সেই ভাবসমাধির বর্ণনা দিয়েছেন- “মা স্নান করিয়া ভক্তদের দেওয়া অনেকগুলি কাপড়ের ভিতর হইতে শরৎ মহারাজের দেওয়া কাপড়খানি বাহির করিয়া পরিলেন। আমি মার কপালে সিঁদূর, চন্দন, গলায় ফুলের মালা ও পায়ে পুষ্পাঞ্জলি দিয়া প্রণাম করিয়া মুখের দিকে চাইতেই দেখি, তাঁহার আগেকার রূপ যেন নাই, চকিতের মধ্যে এক ভীষণ সুন্দর, অপূর্ব, অপার্থিব রূপ ফুটিয়া উঠিয়াছে। সে রূপের বর্ণনা ভাষায় দিতে পারি না। খানিক পরেই তিনি পূর্বের মত হইয়া গেলেন, আমাকে বলিলেন, এস মা, প্রণাম কর।“


সন্দেহ কী, ভক্তদের বিশেষ অবলম্বন ছিল মায়ের এই দৈবীভাব। মা-ই যেন ছিলেন তাঁদের সব সমস্যার প্রতিকার। তাই এক জন্মতিথিতে ছেলেরা চেয়েছিলেন, মা আগে খেয়ে নিলে তবেই তাঁরা খাবেন। সাধারণত ছেলেদের আগে খাইয়ে তার পর মা মেয়েদের নিয়ে খেতে বসতেন। সেদিন প্রথম সেই নিয়মের অন্যথা হল। কিন্তু, বাধা হয়ে দাঁড়াল মাতৃত্বই! মাকে ডাকা হলে তিনি যেন যন্ত্রচালিতের মতো আসনে গিয়ে বসলেন, যা সাজিয়ে দেওয়া হয়েছিল সামনের থালা-বাটিতে, একটু একটু মুখে দিলেন। তারপরেই স্বামী সারদেশানন্দকে বললেন, “ছেলেদের খাওয়ার আগে গলার নিচে যায় না, তাড়াতাড়ি তোমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা কর।” ব্যস! উঠে পড়লেন খাওয়া ছেড়ে! তদারকি করতে লাগলেন ছেলেদের খাওয়ার। জানা যায়, সেদিন না কি আর কিছুই খাননি মা!
শেষ জন্মতিথিটিতেও আমরা দেখেছিলাম এই মাতৃসত্তারই প্রকাশ। সেটা ১৯১৯ সাল। সেবার মায়ের শরীর ভাল ছিল না। স্বামী পরমেশ্বরানন্দ লিখছেন, “তাঁর শুভ জন্মতিথির দিন উপস্থিত হইলে শ্রীশ্রীমা বেশি ঝঞ্জাট করিতে নিষেধ করিয়া বলিলেন, ভক্ত ছেলেগুলি যারা আছে আর প্রসন্ন, কালীদের বাড়ির সবাইকে বলে দাও।“ সেই শেষ জন্মতিথির উৎসবেও আমরা দেখব, তাঁর মধ্যে সমান ভাবে মিশে আছে দেবী আর মাতৃত্বের রসায়ন। সেদিন অল্প তেল মেখে সামান্য গরমজলে গা মুছে, শরৎ মহারাজের পাঠানো শাড়ি পরে মা চৌকিতে বসার পরে একে একে সবাই পায়ে ফুল দিয়ে প্রণাম করতে থাকেন। স্বামী পরমেশ্বরানন্দ মাকে একটি গাঁদাফুলের মালা পরিয়ে প্রার্থনা জানান- যে ভক্তরা তাঁর সাক্ষাৎ দর্শন পায় না, তিনি যেন তাঁদেরও মঙ্গল করেন। তখনও কেউ জানতেন না, মা অচিরেই চলে যাবেন সকলের চোখের আড়ালে। কেউই আর তাঁর সাক্ষাৎ দর্শন পাবে না।


স্বামী সারদেশানন্দ লিখছেন, “সাধুভক্ত সকলেই পূজার আয়োজন, দ্বিপ্রহরে ভোগের জন্য রন্ধন, ভজন-কীর্তন ইত্যাদিতে ব্যস্ত। অদ্য তাঁহাকে কেন্দ্র করিয়া উৎসব চলিতেছে। কিন্তু তাঁহার নিজের দৃষ্টিতে তিনি যেন কিছুই নহেন। তিনি স্বাভাবিক, শান্ত ধীরভাবে মাছ কুটিয়া ঘাটে ধুইয়া আনিলেন, রান্নাঘরের বারান্দায় স্বয়ং ঝোল রান্না করিয়া সেজমামীর বাড়িতে গিয়া দিয়া আসিলেন। এইসব কাজের জন্য তাঁহার সদাপ্রফুল্ল মুখে একটুও বিরক্তির চিহ্ন দেখা গেল না।“
সে দিন বিকেলবেলাতেই তাঁর জ্বর আসে। জ্বরে সেই যে তিনি শয্যা নেন, তার পরে আর ওঠেননি। কিন্তু একটি আদর্শের প্রদীপ তিনি জ্বালিয়ে রেখে গিয়েছিলেন। সেই আলোতেই আজও পথ চিনছে রামৃষ্ণ মিশন। কেন না, তিনিই তো পরমহংসের শক্তি। ছেলেদের জীবনে চলার ভাবটুকুই শুধু ঠাকুরের কাছ থেকে পাওয়া। বাকিটুকু মায়ের দেওয়া শক্তি। যার প্রকাশ কখনও হয়েছে দেবীর রূপে। বেশির ভাগ সময়েই মা হিসেবে।
স্বাভাবিক! মা যেমন করে শিশুকে পথে হাঁটার উপযুক্ত করে তোলেন, তেমনটা কি আর কেউ করতে পারে?

The post মা সারদার জন্মতিথি: দেবী আর মাতৃরূপের সাক্ষাৎ সমন্বয় appeared first on Sangbad Pratidin.

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement